প্রশ্নঃ পৌরনীতির আলোকে সাম্যের বিভিন্ন রূপ বা শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ সাম্যের অর্থ সমান। সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় সব মানুষ সমান। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নীতিগতভাবে, স্বীকার করা হয় যে, সকল মানুষই সমান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সব মানুষ এক সমান নয়। শারীরিক ও মানসিক গঠন এবং ক্ষমতা ও যোগ্যতার দিক থেকে একজনের সাথে অন্যজনের পার্থক্য রয়েছে। এজন্যই রাষ্ট্রের কাছ থেকে সকলেই সমান ব্যবহার দাবি করতে পারে না। একজন ডাক্তার ও একজন ঠিকাদার সমাজের কাছ থেকে সমপরিমাণ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দাবি করতে পারে না।
সাম্যের বিভিন্ন রূপ বা শ্রেণিবিভাগ (Different Forms or Classification of Equality): সাম্য একটি অখণ্ড ধারণা। সাম্যের কোনো প্রকারভেদ হয় না। যেমন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যান্য সাম্য আপনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তবুও বিভিন্ন ধরনের সুযোগের জন্য সাম্যকে নিম্নলিখিত উপায়ে শ্রেণিবিভাগ করা হয়ে থাকে।
১. স্বাভাবিক সাম্য
২. সামাজিক সাম্য
৩.রাজনৈতিক সাম্য
৪. অর্থনৈতিক সাম্য
৫. আইনগত সাম্য
৬. নাগরিক বা ব্যক্তিগত সাম্য
১. স্বাভাবিক সাম্য (Natural Equality): স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক সাম্যের অর্থ হলো জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন এবং সমান। জন্মগতভাবে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণায় স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব প্রচারিত হয়। কিন্তু জন্মগতভাবে সব মানুষ দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে সমান হতে পারে না। এজন্য স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা বর্তমানে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
২. সামাজিক সাম্য (Social Equality): জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও পেশাগত কারণে যখন মানুষে মানুষে কোনো পার্থক করা হয় না তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলে। সামাজিক সাম্যের মূল কথা হলো সমাজে বসবাসরত সকল মানুষ যোগ্যত অনুযায়ী একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে।
৩. রাজনৈতিক সাম্য (Political Equality): রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক অধিকার ভোগের বেলায় সমান সুযোগ থাকাকেই রাজনৈতিক সাম্য বলে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্ক নাগরিক যখন নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে বা সাধারণ ভোটদাতা হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে তখনই কোনো দেশে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. অর্থনৈতিক সাম্য (Economic Equality): অর্থনৈতিক সাম্যের অর্থ সকল সম্পদ সবার মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকল মানুষ যখন কাজ করার, ন্যায্য মজুরি পাবার সুবিধা লাভ তখন তাকে অর্থনৈতিক সাম্য বলে। অর্থনৈতিক সাম্যের মূল কথা হচ্ছে, যোগ্যতা অনুযায়ী সম্পদ ও সুযোগের বণ্টন। লাি মতে, "ধন বৈষম্যের সাথে অর্থনৈতিক সাম্য অসঙ্গতিপূর্ণ হবে না, যদি এই বৈষম্য দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। অর্থনৈতিক নানা ব্যতীত সামাজিক বা রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন।”
৫. আইনগত সাম্য (Legal Equality): 'আইনের চোখে সকলেই সমান' এটিই হচ্ছে আইনগত সাম্যের মূল কথা। সমাজে যখন বৈষম্যমূলক আইন থাকে না, সকল মানুষের আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ থাকে—তখনই আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনের অনুশাসন অর্থাৎ বিনা অপরাধে গ্রেফতার এবং বিনাবিচারে আটক না রাখার বিধান কার্যকর হলে আইন সাম্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
৬. নাগরিক সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্য (Individual Equality): নাগরিক সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্যের অর্থ হলো সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকা। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ নাগরিকের নাগরিক সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্য থাকতে হবে।
উপসংহারঃ পরিশেষে উল্লেখ্য, আদর্শ হিসেবে সাম্য ও স্বাধীনতার সুসমন্বিত রূপ প্রকাশ পায় ১৭৭৬ সালে, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে' এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের' ঘোষণায়।
0 মন্তব্যসমূহ