স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো কি কি? বিস্তারিত আলোচনা কর


প্রশ্নঃ স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো কি কি? বিস্তারিত আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ প্রতিটি উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য যেসকল বিশেষ ব্যবস্থা বলবৎ থাকে সেগুলিকেই বলে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। অধ্যাপক ল্যাস্কি এই সকল বিধি ব্যবস্থাগুলিকে স্বাধীনতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। 

স্বাধীনতার রক্ষাকবচ সমুহ (Safeguards of Liberty): স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন যেমন দুরূহ প্রক্রিয়া, স্বাধীনতা সংরক্ষণ ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কেননা নানা কারণে জনগণের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ জন্যই লাস্কি বলেছেন, সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ব্যতীত অধিকাংশ লোক স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে না।

স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ ও অটুট রাখার জন্য কতগুলো পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতিগুলোকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে। এগুলো সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ 

১. আইন (Law): আইন স্বাধীনতার শর্ত ও প্রধান রক্ষাকবচ। আইন স্বাধীনতা ভোগের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে তোলে। রাষ্ট্র আইনের সাহায্যে মানুষের অবাধ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আইন আছে বলেই স্বাধীনতা সকলের নিকট সমভাবে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। লকের মতে, “যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।” আইনের লক্ষ্য ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করা; খর্ব করা নয়। আইন স্বাধীনতার শর্ত ও সহায়ক।

২. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সমাবেশ (Fundamental rights in the Constitution): নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকলে সেগুলো সম্পর্কে সন্দেহ বা দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না। মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে সেগুলো সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা লাভ করে। সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এসব মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন বা ভঙ্গ করলে জনগণ সাংবিধানিক উপায়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে পারে।

৩. দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা (Responsible Government): দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ তার অনুসৃত নীতি ও কার্যাবলির জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকে। ফলে সরকার স্বৈরাচারী হয়ে অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী কাজে লিপ্ত হতে সাহসী হয় না। সুতরাং জবাবদিহিমূলক বা দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ।

৪. প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি (Direct Democratic method): গণভোট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ করে এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধ করে। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি জনগণের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলে।

৫. আইনের অনুশাসন (Rule of Law): অধ্যাপক এ. ভি. ডাইসি মনে করেন যে, স্বাধীনতা সংরক্ষণে আইনের শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। তার মতে, আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায় (ক) আইনের দৃষ্টিতে সমতা অর্থাৎ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই আইনের দৃষ্টিতে সমান (খ) আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ এবং (গ) শুনানী ব্যতীত কারও বিরুদ্ধে শাস্তি বা ক্ষতিকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। যে সমাজে আইনের অনুশাসন কার্যকর থাকে স্বাধীনতা সেখানে পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করে।

৬. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Separation of Power): কোনো একক কর্তৃপক্ষের ওপর আইন প্রণয়ন, শাসন পরিচালনা ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা অর্পিত হলে ব্যক্তিস্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ কারণে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের এবং শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের তিনটি বিভাগের দায়িত্ব পৃথক ও স্বতন্ত্রভাবে অর্পিত হওয়া উচিত। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, “আইন প্রণয়ন ও শাসন পরিচালনার ক্ষমতা যখন কেন্দ্রীভূত হয় তখন স্বাধীনতা নষ্ট হয়। এর সাথে বিচার বিভাগের ক্ষমতা সংযুক্ত হলে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে মরে।”

৭. বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা (Independence of Judiciary): বিচার বিভাগকে যদি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন করে গড়ে তোলা যায় তাহলে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার লোলুপ আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা সম্ভব। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ আইনের বৈধতা নির্ণয় করে এবং শাসন বিভাগ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাজ কতখানি সংবিধান সম্মত তা যাচাই করে সুতরাং বিচার বিভাগকে শাসন ও আইন বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে।

৮. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization of Power): রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রের ওপর এককভাবে বা চূড়ান্তভাবে ন্যস্ত না করে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা বিভিন্ন পেশাগত ও কার্যভিত্তিক গোষ্ঠীর ওপর অর্পণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। ফলে স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেন যে, “যে রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় পুঞ্জীভূত, সেখানে কোনো প্রকার স্বাধীনতা থাকতে পারে না।”

৯. সামাজিক ন্যায়বিচার (Social Justice): সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাধীনতা ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা পায়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়বিচার স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে স্বীকৃত। সামাজিক ন্যায়বিচার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি।

১০. সাম্য (Equality): সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক। স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাম্য ও স্বাধীনতার সহাবস্থান গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি।

১১. সুসংগঠিত দল ব্যবস্থা (Organized party System): সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত দল ব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম। বিরোধী দলসমূহ সরকারের কার্যাবলির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে এবং সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কাজের তীব্র বিরোধিতা করে। এভাবে সদাজাগ্রত অতন্দ্র প্রহরীর মতো বিরোধী দলসমূহ স্বাধীনতা সংরক্ষণে নিয়োজিত থাকে।

১২. সাংবিধানিক সরকার (Constitutional Government): সাংবিধানিক সরকার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সাংবিধানিক প্রাধান্য ও সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

১৩. সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক (Proper understanding between the Govt. and the People): স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে হলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা আবশ্যক। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য জনকল্যাণ সাধন—এই সত্য সরকার ও জনগণ উভয়কেই উপলব্ধি করতে হবে। যদি উভয় পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক, সহযোগিতা ও সম্প্রীতি বিরাজ না করে, তবে স্বাধীনতা ব্যাহত হতে বাধ্য।

১৪. শোষণমুক্ত সামাজিক কাঠামো (Exploitation free Social structure): শোষণমুক্ত সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।' শোষণমুক্ত সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব। যে সমাজে সুযোগ-সুবিধা একটি নির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ ও ক্ষুদ্র শ্রেণি একচেটিয়াভাবে ভোগ করে সেখানে স্বাধীনতা অর্থহীন। এ জন্য অনেকেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাদের ভাষায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।

১৫. সদা জাগ্ৰত জনমত (Vigilant Public Opinion): স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হলো সদাজাগ্রত জনমত অর্থাৎ নাগরিকদের সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি। স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে সর্বদা সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে, যেন স্বাধীনতার ওপর হুমকি না আসে। যে কোনো মূল্যে, প্রয়োজনবোধে চরমতম ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণের মানসিক প্রস্তুতি তাদের থাকতে হবে। নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় সচেতন, আগ্রহী ও সাহসী না হলে বাহ্যিক কোনো পদ্ধতির দ্বারা স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। এই অর্থে, স্বাধীনতা-সংগ্রাম হলো অন্তহীন। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিসের মতে, “চিরন্তন সতর্কতা স্বাধীনতার মূল্য এবং সাহসিকতা স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।” (Eternal vigilance is the price of liberty and the secret of liberty is courage.) লাঙ্কির মতে, “চিরন্তন সতর্কতার মধ্যেই স্বাধীনতার মূল্য নিহিত।” জনগণ যদি নির্লিপ্ত না হয় এবং নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন থাকে তাহলে স্বাধীনতা সংরক্ষণ অনেক সহজ হয়। সুতরাং স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হেনরি নেভিনসনের মতে, “স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনোদিন শেষ হয় না, এর সংগ্রামের ক্ষেত্র কোনো দিন নীরব থাকে না।

উপসংহারঃ উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন বলবৎ থাকে; এর ফলে রাষ্ট্র বা সরকার নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে নাগরিক অধিকার ভঙ্গ করতে পারেনা। নাগরিকদের স্বাধীনতা আইন কর্তৃক সংরক্ষিত হলে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক