পৌরনীতিতে আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কি?


প্রশ্নঃ পৌরনীতিতে আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কি?  

ভূমিকাঃ আইন নাগরিকের স্বাধীনতা সম্প্রসারিত করে। সুন্দর, শান্তিময়, সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্য যা প্রয়োজন তা আইনের দ্বারা সৃষ্টি হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে যদিও আইন স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বাস্তবে স্বাধীনতা তাতে সম্প্রসারিত হয়। সুতরাং বলা যায়, আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক (Relation between Law and Liberty): আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক সংক্রান্ত পরস্পর বিরোধী দুটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। প্রথম দলটি মনে করেন, স্বাধীনতা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং স্বাধীনতা আইনের ওপর নির্ভরশীল। এরিস্টটল, মন্টেস্কু, রিচি, উইলোবি, বার্কার, লর প্রমুখ মনীষী এই মতের সমর্থক। বার্কারের ভাষায়, “স্বাধীনতা ও আইনের বিরোধ নেই।” (Liberty and law do not quarrel.)

আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী। জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বার্ট স্পেনসার, এ. ভি. ডাইসি, গডউইন প্রমুখ মনীষী এই দলের সমর্থক। ডাইসির মতে, “একটি বেশি হলে, অপরটি কমে যায়।” (The more there is of the one, the less there is of the other) স্পেনসার বলেন, “আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী।"

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উভয় মতবাদেই অযৌক্তিক অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত, অবাধ স্বাধীনতা একদিকে যেমন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর; তেমনি সব আইন স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে না। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়, বরং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের সম্পর্ক নিম্নরূপঃ 

১. আইন স্বাধীনতার শর্ত ও ভিত্তিঃ  আইন স্বাধীনতাকে সহজলভ্য করে তোলে। আইনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যথার্থভাবে স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। আইনের অবর্তমানে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের অধিকার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আইন না থাকলে সমাজজীবনে ভয়াবহ অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলতার রাজত্ব শুরু হয়। উইলোবি বলেছেন, “নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই স্বাধীনতা রক্ষা পায়।” বস্তুত স্বাধীনতার প্রধান ভিত্তি ও শর্তই হলো আইন।

২. আইন স্বাধীনতার রক্ষাকবচঃ আইন আছে বলে স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। আইনের কর্তৃত্ব আছে বলেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। আইনের অবর্তমানে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ থাকার কারণে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ জনগণের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না। স্বাধীনতা লঙ্ঘন ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা চলে। এ জন্যই লক বলেছেন যে, “যেখানে আইন থাকে না, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।'

৩. আইন স্বাধীনতার অভিভাবকঃ আইন শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করে। আইন সংযত ও নির্দিষ্ট সীমারেখার গণ্ডিতে সকলকে আবদ্ধ রেখে স্বাধীনতা বজায় রাখে। আইন আছে বলেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমাজ বিরোধী কার্যকলাপের ফলে স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় না।

৪. আইন স্বাধীনতার রক্ষকঃ আইন আছে বলে স্বাধীনতা উপভোগ করা যায়। আইন না থাকলে প্রকৃত স্বাধীনতা থাকতে পারে না। স্বাধীনতাকে রক্ষা করা এবং সকলের নিকট উপভোগ্য করে তোলাই আইনের লক্ষ্য।

৫. আইন স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রসারিত করেঃ আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরিধি সম্প্রসারিত হয়। রাষ্ট্র আইনের দ্বারা এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে সুন্দর, সভ্য জীবনযাপনের অনুকূল অবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আইন ও স্বাধীনতার এরূপ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ করেই রিচি বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে যদি আত্মবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বোঝায় তা হলে তা নিশ্চিতভাবেই আইনের দ্বারা সৃষ্টি হয়।”

তবে আইন যে সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে একথা বলা যায় না। কিছু সংখ্যক আইন রয়েছে যেগুলো অকারণে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করে। কেবল জনমতের ওপর ভিত্তি করে যেসব আইন গড়ে ওঠেছে সেগুলোই স্বাধীনতা সংরক্ষণ করে।

উপসংহারঃ সুতরাং উপসংহারে বলা যায় যে, আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো বৈরী সম্পর্ক নেই। আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আইন যখন জনসম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই কেবল স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। আইন স্বাধীনতার শর্ত ও ভিত্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক