সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বা ধাপসমূহ বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বা ধাপসমূহ বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাষ্ট্র বা সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিগণকে বৃহত্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হয়, যার উপর একটি সংগঠন, সংস্থা বা একটি জাতি নির্ভরশীল থাকতে পারে। সিদ্ধান্তের উপযুক্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কুশলতার উপরও নির্ভর করে অনেকের ভাগ্য। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় আর কমই আছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট এক অন্যতম অধ্যয়নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা জাতিগতভাবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায় বিষয়টির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্ভুল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরো অনেক বেশি অনুভূত হয়ে চলেছে। তাই হার্বার্ট সাইমন (Herbert Simon) সিদ্ধান্ত গ্রহণকে 'Heart of Administration' বলে অভিহিত করেছেন। একজন প্রশাসকের যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে তার মধ্যে প্রধানতম হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ। দৈনন্দিন কাজের বৃহত্তর অংশ হিসেবে তিনি নানান জটিল ও কঠিন বিষয় ও পরিস্থিতিতে অনেকগুলো বিকল্পের মধ্য হতে সর্বোত্তম সিদ্ধান্তটিকে স্থির করতে হয়। আর কোন পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপই হলো সিদ্ধান্ত। তাই এ সমস্ত দিক বিবেচনায় রেখে বলা যায়, প্রশাসককে ব্যক্তিগত অনেক গুণ, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ, একটি বিশেষ সময়ে যত ধরনের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তার কাজ চলুক না কেন ফলাফলের জন্য তাকে তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হয়। 

সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বা ধাপসমূহ  (The Decision-Making Process): সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি নেই। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট উপায় রয়েছে যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। সাম্প্রতিককালে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে কতকগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ


(ক) সমস্যা নির্ণয় (Diagnosis of the Problem): সমস্যা নির্ধারণ বা নির্ণয়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে প্রথম এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর উচিত সমস্যাকে সঠিক ও সুন্দরভাবে এবং সুনির্দিষ্ট উপায়ে সমাধান করা। যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ভুল এবং অশুদ্ধ হয় তাহলে যে কেবলমাত্র সময়ের অপচয় হবে তা নয় বরং শক্তি ও অর্থের অপচয় হবে এবং তখনই সংগঠনের অসামঞ্জস্য ও অপ্রয়োজনীয় সমস্যার উদ্ভব হবে। সুতরাং একজন প্রশাসক বা ব্যবস্থাপকের প্রধান কাজ হচ্ছে কোন বিষয় বা সমস্যার যথাযথ নির্ণয় এবং আগাগোড়া ও ক্রমবর্ধমান অনুসন্ধান। 


(খ) সমস্যার বিশ্লেষণ (Analysis of the Problem): কোন বিষয়ে সমস্যার সুষ্ঠু এবং সঠিক বিশ্লেষণ ব্যবস্থাপককে সমস্যার গঠনাবলি ও সমস্যার অন্তর্দৃষ্টি সরবরাহ করবে। পর্যাপ্ত পটভূমি, তথ্য এবং সমস্যাটির সাথে জড়িত উপায় বের করার উদ্দেশ্যে আগাগোড়া সমস্যা বিশ্লেষণ  করতে হবে। 


(গ) বিকল্প পন্থার উদ্ভাবন (Developing Alternatives): একটি সমস্যার বিশ্লেষণ কখনও সম্পূর্ণভাবে সন্তোষজনক হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত কতকগুলো বিকল্প উদ্ভাবন এবং তা অনুসন্ধানের জন্য পদক্ষেপ না নেয়া হবে। বিকল্পের অনুপস্থিতিতে কখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর হবে না। বিকল্পের কোন অনুসন্ধান ব্যবস্থাপককে সমস্যাটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে এবং পরিশেষে সমস্যাটির গোলযোগপূর্ণ স্থানগুলোকে নির্দেশ করতে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করে। বিকল্প উদ্ভাবন প্রায় ক্ষেত্রেই বহু পছন্দের অবকাশ ঘটায় যার ফলে ব্যবস্থাপক স্বভাবতই এগুলোকে কম বিবেচনা করে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপকের পক্ষে অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা খুব একটি কঠিন ব্যাপার নয়। বিকল্পসমূহের মধ্য হতে পছন্দ করতে গিয়ে যে সকল উপাদানের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে সেগুলো সমস্যা সমাধানের কৌশল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সাধারণত কৌশলগত উপাদানসমূহকে এড়িয়ে যাওয়া হতে কম ঝুঁকিপূর্ণ। চেস্টার আই. বার্নার্ড (Chester I. Barnard) এ নীতির গুরুত্বের কথা স্বীকার করে বলেছেন, “সিদ্ধান্তের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ প্রকৃতপক্ষে কৌশলগত উপাদানের জন্য অনুসন্ধান প্রচেষ্টা। কৌশলগত উপাদানের সূত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সংগঠনের সামঞ্জস্যতা এবং প্রশাসনিক কার্যাবলি সম্ভবত ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যমূলক আচরণের প্রতি একটি স্বীকারোক্তি।”


(ঘ) বিকল্প পন্থার মধ্য হতে বাছাইকরণ (Selection Among Alternatives): কতকগুলো বিকল্পের মধ্য হতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিকল্প বাছাই করতে হলে বিকল্পসমূহ হতে উদ্ভূত নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট ফলাফলের সমর্থন বুঝতে হবে। এ উপলক্ষে কতকগুলো বিকল্পের মধ্য হতে বাছাই করতে হলে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ ব্যবস্থাপকের জন্য উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা, পরীক্ষা, বিশ্লেষণ এবং প্রস্তাবগুলোর গঠন এবং পরিশেষে ব্যবস্থাপকের সুষ্ঠু জ্ঞান থাকা দরকার। রবার্ট হিলব্যুর্নার নির্দেশ করেছেন যে, বিকল্পগুরোর মধ্য হতে বাছাই করতে হলে কর্তাকে প্রত্যেক বিকল্পের নাড়ি-নক্ষত্র এবং ঘটনার কাল পছন্দ করতে হবে যা উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক বলে প্রতীয়মান হবে। পিটার ড্রাকার (Peter Drucker)-এর মতে, প্রত্যেক ব্যবস্থাপককে কোন কার্য যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য সাধারণত চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত; যথাঃ 


১। কোন কাজ হতে যে পরিমাণ লাভ হবে তা বিবেচনা করে সে কাজের প্রতি ঝুঁকি গ্রহণ;

২। কোন কাজের মিতব্যয়িতা এবং এর আশু ফলাফলের মধ্যে সমন্বয় সাধন; 

৩। অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে কোন কাজের জন্য সময় নির্ধারণ; 

৪। সসীম সম্পদের মাধ্যমে কিরূপে অধিক ফল লাভ করা যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখা। 


(ঙ) বিকল্প ব্যবস্থাসমূহের মূল্যায়ন (Evaluating the Alternatives): প্রত্যেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ে বিকল্প ব্যবস্থাসমূহের মূল্যায়ন করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। কারণ এ পর্যায়ে এমন একটি বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভান করতে হয় যার মাধ্যমে সর্বাধিক সুফল লাভ (Gain) করা যায়। 


(চ) সিদ্ধান্তসমূহকে কার্যে রূপায়ণ (Putting the Decision into Effect): যে কোন সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হোক না কেন, তাকে অবশ্যই বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় যে, সর্বাপেক্ষা সঠিক সিদ্ধান্ত কর্মচারীদের অসহযোগিতা অথবা বোধগম্যতার অভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে পড়ে। এ সমস্ত অসুবিধা কাটিয়ে উঠার জন্য ব্যবস্থাপককে এমন কতকগুলো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যার ফলে সিদ্ধান্তসমূহকে সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়; এ জন্য ব্যবস্থাপককে সাধারণত তিনটি বিষয়ের উপর সর্বদা দৃষ্টি রাখতে হয়; যথাঃ

(১) সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা;

(২) কর্মচারীদের সিদ্ধান্ত কার্যকরকরণের নিশ্চয়তা প্রদান করা;

(৩) সময়মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। 


(ছ) সিদ্ধান্তসমূহের পুনর্বিবেচনা (Following up the Decision): সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদিও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয় তথাপি স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় অনেক সময় ব্যবস্থাপক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মারাত্মক ভুল করে বসেন। এরূপ কতকগুলো ভুল-ভ্রান্তি সমস্ত সিদ্ধান্তকে বানচাল করে দেয়। তাই এ সমস্ত অসুবিধা দূর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে এমন একটি ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক যার ফলে অতি সহজেই সিদ্ধান্তকে রদবদল করে যথাযথভাবে কার্যের উপযোগী করে তোলা যায়৷ 


(জ) উপাত্তসমুহের শ্রেণীবদ্ধকরণ (Marshalling the Facts): কোন সিদ্ধান্তই শূন্যের উপর গৃহীত হয় না। তাই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই কতকগুলো ঘটনা এবং উপাত্ত সন্নিবেশিত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র কতকগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনা বা উপাত্ত সংগ্রহ করলেই চলবে না বরং এগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। 


(ঝ) সময়ের গুরুত্ব (The Factor of Time) : সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সময়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কখন এটি গ্রহণ করা উচিত অথবা অনুচিত সে সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । চেস্টার আই. বার্নার্ড (C. I. Barnard) বলেছেন যে, গ্রহণের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। অনেক সময় অপরিপূর্ণ অথবা অসময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে গুরুতর বিপর্যয় দেখা দেয় । তাই প্রত্যেক ব্যবস্থাপকের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। 


সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ল্যাসওয়েল (Lasswell) সাতটি ‘কার্যভিত্তিক' পদক্ষেপের (Functional Stages) কথা বলেছেন। এ সাতটি পদক্ষেপ হলোঃ

(১) তথ্য সংগ্রহ বা সমস্যা চিহ্নিতকরণ (Information),

(২) অনুমোদন বা বিকল্প নির্ধারণ (Recommendation),

(৩) ব্যবস্থা গ্রহণ বা বিকল্পের নির্বাচন (Prescription),

(৪) সাময়িকভাবে গ্রহণ (Invocation),

(৫) প্রয়োগ বা কার্যকরকরণ (Application),

(৬) মূল্যায়ন (Appraisal) ও

(৭) বাতিলকরণ বা নবায়ন (Termination or Renewal)। 


সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সর্ব অবস্থায় গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের উপর ইদানীং তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয় না, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সাইমন ও মার্চ (Simon and March) সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কে চারটি প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। এগুলো হলোঃ (১) সমস্যা সমান ( Problem Solving), (২) প্রবর্তনা (Persuasion), (৩) দরকষাকষি (Bargaining) ও (৪) রাজনৈতিক (Politics)। 


কেউ কেউ আবার বলেছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত (Intellectual), সামাজিক (Social) ও সাধারণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব (Quasi- mechanical)। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত দিকটি জড়িত রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর অন্তর্দৃষ্টি, সৃজনশীলতা, অনুভূতি, জ্ঞান ও অন্যান্য গুণের সাথে। সমস্যা সমাধানের জন্য তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ, বিকল্প নির্বাচন ও বাছাই প্রধানত এ পর্যায়ের। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামাজিক দিকের অন্তর্ভুক্ত হলো বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, যোগাযোগ ও যোগাযোগের মাধ্যমে সমর্থন সৃষ্টি ইত্যাদি।


ডল ও লিন্ডরুম (Dahl and Lindblom) সামাজিক প্রক্রিয়ার চারটি উপাদানের কথা বলেছেনঃ (ক) পদসোপান (Hierarchy), (খ) দরকষাকষি (Bargaining), (গ) গণতান্ত্রিক পরিবেশ (Polyarchy) ও (ঘ) মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া (Price-mechanism)। পারস্পরিক সম্পর্ক সমঝোতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতিই এগুলোর অভিব্যক্তি, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় অত্যন্ত স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রায় সামগ্রিক উপায়ে (Mechanical)। 


কোন সংগঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে হিকস্ ও গুলেট (Herbert G. Hicks and C. Ray Gullett) যে মডেল দান করেছেন তাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের মতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে কোন পর্যায়ে সংগঠনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সমাধান, সমাধানের বাস্তবায়ন, কর্ম ও নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। এ মডেল অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।


প্রথমত, সংগঠনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্থির করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

দ্বিতীয়ত, সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর পন্থা সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

তৃতীয়ত, সমস্যা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

চতুর্থত, বিকল্প নির্ধারণ ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।

পঞ্চমত, একবার গৃহীত হয়ে গেলেও তার মূল্যায়ন ও নিরীক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। 


হিকস্ ও গুলেট (Hicks and Gullett) মডেলের ভিত্তি হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে যুদ্ধ সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানকল্পে ব্রিটেনে পরিচালিত পরিচালনা গবেষণার (Operations Research) ফলাফল। এ মডেল অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে সাতটি পর্যায় বা পদক্ষেপ। নিচে এগুলো পর্যায়ক্রমে দেয়া হলোঃ


প্রথমত, যে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হোক না কেন তা গৃহীত হয় সংগঠনের কাঠামোয় আর যে কোন সিদ্ধান্ত সংগঠনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সাথে সংগতি রেখেই গৃহীত হয়। ফলে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্দিষ্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের ব্যাখ্যা বা পুনর্ব্যাখা (Definition of organization goal)। 


দ্বিতীয়ত, কিন্তু কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করাই যথেষ্ট নয়, সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পাদন মান বা অর্জন মানদণ্ডও ( Performance criteria) নির্ধারণ করতে হবে। এমনি সম্পাদন মানের সাথে সংগতি রেখেই কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 


তৃতীয়ত, যে সমস্যা সমাধানকল্পে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তৃতীয় পর্যায় হলো সে সমস্যার সঠিক চিহ্নিতকরণ (Problem identification)। সমস্যাটি কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে বা করবে, সে প্রতিক্রিয়া কোন পর্যায়ের, সমস্যাটি দূরীভূত হলে কোন্ কোন্ সুফল লাভ করা যাবে, কত সহজে বা কত মূল্যে, সমস্যা দূর করার জন্য যে ব্যয় হবে তা সে সুফল থেকে বেশি না কম এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব ও তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে সমস্যার সঠিক চিহ্নিতকরণ সম্ভব। 


এ পর্যায়ে সমস্যা নিরসনের জন্য সম্ভাব্য সকল সমাধানের বিকল্প (Alternatives) বিষয়ের সন্ধান করতে হবে। এ পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয় লক্ষ্য করতে হবেঃ (এক) সকল সম্ভাব্য সমাধান বা বিকল্পের সন্ধান; (দুই) বিকল্প পন্থার মধ্য থেকে যুক্তিভিত্তিক বাছাইকরণ; (তিন) বাছাই করা সমাধান থেকে যে সুফল হবে তা বিবেচনাপূর্বক ঝুঁকিগ্রহণ, (চার) বাছাইকৃত সমাধান থেকে যে মিতব্যয়িতা অর্জন করা যাবে তার মোটামুটি হিসাব; (পাঁচ) তা সময়োপযোগী কি না তার মূল্যায়ন ও (ছয়) সীমিত সুযোগ থেকে বাঞ্ছিত ফল পাওয়া যাবে কিনা তারও বিবেচনা। 


চতুর্থত, সব দিক বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এ পর্যায়ে যত বেশি উপাত্ত সংগৃহীত হবে তাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। 


পঞ্চমত, একবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তার মূল্যায়ন করা হয়। 


ষষ্ঠত, মূল্যায়নের পর বাস্তবায়ন, আর বাস্তবায়ন পর্যায়ে সীমিত অবস্থার প্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রণই হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷ 


সপ্তমত, বাস্তবায়ন পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত কেমন কাজ করছে অর্থাৎ তা সম্পাদনের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ লো কি না তা সিদ্ধান্তকারীর নিকট ফিডব্যাকের মাধ্যমে পৌছিয়ে দিয়ে, আদর্শ পন্থার সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা ও প্রয়োজনবোধে সিদ্ধান্তে আংশিক সংশোধন আনয়নই হলো সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়৷ 


যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অবশ্য সংগঠনের লক্ষ্য, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ (Values), সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর আবেগ ও অনুভূতি (Emotionalism), সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত ও নৈতিক যোগ্যতা আর সংগঠনকে দিয়ে যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বিদ্যমান থাকে, তার প্রভাবও গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়। মূল্যবোধ, আবেগ, কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি প্রভৃতি হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ইনপুট (Input)। অন্যদিকে, যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাও ফিডব্যাক ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংগঠনের কর্মকর্তাদের নিকট পৌছে। এভাবে আউটপুট-গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয়।


কোন সংগঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরীণ উপাদান নিম্নরূপঃ



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক