প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উপাদানসমূহ বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উপাদানসমূহ বর্ণনা কর। 

ভূমিকাঃ সুষ্ঠু প্রশাসনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষমতার অবস্থান এবং হস্তান্তর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতা এককেন্দ্রিক বা বিকেন্দ্রিক উভয়ই হতে পারে। এ উভয়কেন্দ্রিক ক্ষমতা দ্বারা প্রশাসন দক্ষভাবে পরিচালিত হয়। তাই বলা যায়, প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এতদুভয়ই বহু প্রচলিত কথা। প্রশাসনের ইতিহাসের সূচনালগ্নে শুধু কেন্দ্রীয় শাসনই প্রচলিত ছিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে বৃহৎ রাষ্ট্রের ধারণার পাশাপাশি এর প্রশাসন যন্ত্রও ব্যাপকতা লাভ করে আর তখনই দেখা দেয় বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া সুষ্ঠু ও মজবুত শাসনের স্বার্থে তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। এমনকি শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেই নয় পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও বৃহৎ যৌথ কারবারসমূহে প্রশাসন ও তার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে প্রশাসন ও তার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ লোক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্যতম।

বিকেন্দ্রীকরণের উপাদানসমূহ (Factors of Decentralization): বিকেন্দ্রীকরণের যে সকল উপাদান রয়েছে সেগুলো প্রশাসনিক সংস্থার কর্তৃত্বকে কেন্দ্রীকরণ অথবা বিকেন্দ্রীকরণের দিকে ধাবিত করে। নিচে এ সকল উপাদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

(ক) দায়িত্বশীলতার উপাদান (Factors of Responsibility): এ উপাদানটি প্রশাসনিক সংস্থার কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণের প্রতি প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ হিসেবে কাজ করে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতি, আইনসভা এবং জনগণের নিকট দায়ী থাকেন। পাশাপাশি তাকে আবার কেন্দ্রীয় বাজেট, হিসাবরক্ষণকারী, নিরীক্ষণকারী সংস্থাসমূহকে এবং আদালতের নিকট তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। এমনকি তাকে আবার সংবাদপত্র, আইনসভার বিভিন্ন কমিটি এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিকট নাজেহাল হতে হয়। এ সকল কারণে প্রশাসনিক সংস্থাসমূহ আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের নিকট ব্যাপক স্বাধীন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে। কারণ আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হয় না, যতটা সম্ভবপর হয় কেন্দ্রে অবস্থিত কর্মকর্তাদের বেলায়।

(খ) প্রশাসনিক উপাদান (Administrative Factors): যে সব প্রশাসনিক উপাদান বিকেন্দ্রীকরণকে প্রভাবিত করে সেগুলোর মধ্যে সংস্থার বয়স (Age of the agency), সংস্থার নীতি ও পদ্ধতিসমূহের স্থায়িত্ব (Stability of the policies and methods of the agency), সংস্থার আঞ্চলিক কর্মচারীদের দক্ষতা (Competence of the agency's field personal), সংস্থার কর্মসম্পাদনে গতি ও মিতব্যয়িতা (Speed and economy in the operation of the agency) এবং প্রশাসনিক দৃঢ়তা (Administrative sophistication) সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। নিচে এগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

প্রথমত, বিকেন্দ্রীকরণের প্রশাসনিক উপাদানসমূহের অন্যতম হলো সংস্থার বয়স। একটি নতুন সংস্থাকে সুসংগঠিত হতে হলে, সুদক্ষ কর্মচারী নিয়োগ করতে হলে, কর্মচারীদের একত্রিত হয়ে কার্য সম্পাদন এবং নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে পর্যাপ্ত সময়ের দরকার।

দ্বিতীয়ত, বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি প্রশাসনিক উপাদান হলো সংস্থার নীতি ও পদ্ধতিসমূহের স্থায়িত্ব। সংস্থার নীতিমালা ও পদ্ধতিসমূহ যখন স্থায়ী হলে এর পক্ষে বিকেন্দ্রীকরণ করা সহজতর হয়। এর ফলে উক্ত সংস্থা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত যোগ্য ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করতে পারে।

তৃতীয়ত, বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো আঞ্চলিক ক্ষেত্রে কর্মচারীদের দক্ষতা সংস্থার কার্যাবলি। সংস্থার কেন্দ্রীয় দপ্তরের কর্মচারিগণ মনে করেন যে, তারাই কেবলমাত্র দক্ষতার সাথে কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম; আর সংস্থার আঞ্চলিক কর্মচারিগণ সংস্থার কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। সংস্থার কেন্দ্রীয় দপ্তরের কর্মচারীদের এ ধারণা বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে এক বিরাট বাধাস্বরূপ।

চতুর্থত, প্রশাসনিক দৃঢ়তা বিশেষ করে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং এর সাথে অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক বিকেন্দ্রীকরণের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী চূড়ান্ত উপাদান।

(গ) কার্য সম্বন্ধীয় উপাদান (Functional Factors): সংস্থার কার্য সম্পর্কিত উপাদানের ক্ষেত্রে যে সকল প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে একটি সংস্থার কি কি কার্য রয়েছে, সংস্থার কার্য পরিচালনার জন্য বিশেষ দক্ষতার কতটুকু প্রয়োজন এবং সংস্থার কার্য কি বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চলে জাতীয় ঐক্য বা অনৈক্য আনয়ন করবে এ সকল প্রশ্ন বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে এসে জমা হয়। নিচে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

প্রথমত, বিকেন্দ্রীকরণের পদ্ধতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে সংস্থার বিভিন্ন প্রকার কার্য সম্পাদনকে। সংস্থার কাজ একটি হলো বা এক প্রকার হয় তা হলো অতি সহজেই বিকেন্দ্রীকরণ করা চলে। কিন্তু যদি প্রশাসনিক সংস্থাকে বহুবিধ কার্য সম্পাদন করতে হয় তাহলে বিকেন্দ্রীকরণের কাজও অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় অধিক সংখ্যক অধিক কর্মচারী নিয়োগ করতে হয়।

দ্বিতীয়ত, কিছু সংস্থায় বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মচারী নিয়োগ করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে ফলশ্রুতিতে বিশেষ করে ক্ষুদ্র সংস্থায় বিকেন্দ্রীকরণের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অধিকন্তু অনেক সংস্থার টেকনিক্যাল জ্ঞানের অধিকারী সুদক্ষ কর্মচারীর অভাবে বিকেন্দ্রীকরণের কাজ এগুতে পারে না।

তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক উভয় দপ্তরেই সংস্থার কার্য সম্পন্ন হতে পারে। কোন কার্য কেন্দ্রীয় দপ্তরের অধীনস্থ থাকলে এর অর্থ এই নয় যে, এর বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। অনেক সময় সংস্থার কার্য আঞ্চলিক দপ্তর হতে কেন্দ্রীয় দপ্তরে স্থানান্তরিত করা হয় যেহেতু সেখানে অর্থ সম্পদ ও জনসম্পদ অধিক।

(ঘ) বাহ্যিক উপাদানসমূহ (External Factors): বাহ্যিক উপাদানসমূহ প্রশাসনিক সংস্থার অভ্যন্তরীণ কার্যাবলি ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে তার বাহ্যিক কার্যাবলি ও সমস্যার দিকে দৃকপাত করে। এ উপাদানসমূহের মধ্যে নাগরিকদের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অধীনস্থ করা, অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহের সাথে যোগসমূহের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা এবং আঞ্চলিক কার্যাবলিকে রাজনৈতিক চাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। উপাদানগুলো নিম্নরূপঃ

১। উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির ব্যাপক সমর্থন আবশ্যক সেখানে বিকেন্দ্রীকরণের নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

২। বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক উপাদান হলো প্রশাসন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় অঙ্গরাজ্য এবং স্থানীয় সংস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পরিমাণগত দিক। কোন সংস্থার সিদ্ধান্তসমূহ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে গ্রহণ করা উচিত যেখানে অন্যান্য সংস্থা তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক উপাদানটি উপেক্ষা করা যায় না। কাজেই আঞ্চলিক প্রশাসন রাজনীতি বিবর্জিত হতে পারে না। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, কোন ব্যক্তিবিশেষ বা সংস্থাকে আর্থিক ঋণ প্রদান এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক