বাংলা বানান রীতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর


প্রশ্নঃ বাংলা বানান রীতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর। 
অথবা, বাংলা বানানের নিয়মের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর। 

বাংলা বানানের নিয়মের প্রয়োজনীয়তাঃ ভাষার পরিশুদ্ধতার জন্য প্রতিটি ভাষায় সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল বানান রীতি বা পদ্ধতি রয়েছে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর অন্যতম একটি ভাষা অথচ বাংলা ভাষার কতকগুলো শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নানা জনে নানা রকম বানান লিখছেন। বাংলার মতো উন্নত ভাষার ক্ষেত্রে এটা মোটেই গৌরবের কথা নয়। তাছাড়া এখনো বাংলা বানানের সম্পূর্ণ সমতা যে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়; বরং কালে কালে বানানের বিশৃঙ্খলা যেন বেড়েই চলছে। তাই বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে উচ্চারণ ও লেখার জন্য বাংলা বানানের নিয়ম জানা আবশ্যক।

বাংলা ভাষা তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃত বানানগুলো নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন। বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রেও বানানের নানারূপ পরিবর্তন দেখা যায়। ভাষায় কোনো মতেই একটি শব্দের একাধিক বানান সমীচীন নয়। কেননা বানান এক রকম না হলে ভাষার সৌন্দর্য যেমন বিনষ্ট হয়, তেমনি ভাব ও অর্থ গ্রহণেও জটিলতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে আধুনিক বাংলা বানান পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যে কোনো ভাষার ব্যাকরণে কতিপয় সুনির্দিষ্ট বানানের নিয়ম সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। তা না হলে স্বরবর্ণে ই, ঈ, উ, ঊ এবং ব্যঞ্জনবর্ণে ণ, ন, জ, য, শ, ষ, স, র, ড়-এর সঠিক ব্যবহার নিয়ে ভিন্নমত দেখা দিবে। কারণ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই এ বর্ণগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে। তাছাড়া সকল ক্ষেত্রে দেশের আপামর জনসাধারণ যাতে একই বানানের নিয়মের মধ্যে তাদের পঠন পাঠন ইত্যাদি চালাতে পারে সেজন্য অবশ্যই একটি সবজনস্বীকৃত বানানের নিয়ম থাকা চাই। এক্ষেত্রে বাংলা বানানের নিয়মের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

সুতরাং বলা যায়, বাংলা ভাষার বানান পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। বইয়ের ভাষা আর মুখের ভাষা এক নয়। মুখে যা উচ্চারণ করা হয় তা ভুল হলে তেমন ক্ষতি হয় না; কিন্তু লেখার ভাষার ভুল হলে তার কুফল বড় মারাত্মক হয়। এতে ভাষা বিকৃত হয় এবং অনেক সময় অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে যায়।

বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম

ভাষা নদীর স্রোতের মতো সতত বহমান। যুগ যুগ ধরে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে অগ্রসরমান এ ভাষা। তন্মধ্যে বাংলা একটি জীবন্ত ও গতিশীল ভাষা। তাই বিভিন্ন সময়ে শব্দ ও ব্যাকরণের পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। হাজার বছর আগে বাংলা ভাষার যে রূপ ছিল এখন আর তা নেই। এ পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলা বানানের সংস্কার সাধন করা হচ্ছে। উনিশ শতকের আগে বাংলা বানানের ধরাবাধা কোনো নিয়ম ছিল না৷ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের শুরুতেই বাংলা সাহিত্যে গদ্যের উন্মেষ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসনে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নির্ধারণ করা হয়। ১৯৩৬ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বাংলা বানানের ক্ষেত্রে কিছুটা সরলীকরণ করে ‘বাংলা বানানের নিয়ম' নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করে। এ যাবৎ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশিত নিয়মই অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি ও ব্যবহার অনুযায়ী বাংলা বানানের নিয়মগুলোকে আর একবার সূত্রাবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কর্মশালা করে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেন; কিন্তু তাতেও বানানগত জটিলতার অবসান হয়নি। এরপর ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম। এটি বর্তমানে বাংলা বানানের সর্বজনগ্রাহ্য ও আধুনিক নিয়ম।

তৎসম শব্দ

১. তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও অবিকৃত থাকবে। কারণ এসব শব্দের বানান এবং ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে।

২. যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ উ উভয় যুদ্ধ বিদ্যমান সেসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তার কারচিহ্ন ( ি,   ) ব্যবহার হবে। যেমন- কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, ধমনি, ধূলি, পঞ্জি, পদবি, ভঙ্গি, মঞ্জুরি, মসি, লহরি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা ইত্যাদি।

৩. রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন- অৰ্চনা, অর্জন, অর্থ, অৰ্ধ, কদম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য ইত্যাদি।

৪. সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে। যেমন- অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। বিকল্পে ঙ লেখা যাবে । ক্ষ-এর পূর্বে সর্বত্র ঙ হবে। যেমন— আকাঙ্ক্ষা।

অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দ

১. ই ঈ উ ঊঃ সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং এদের কার চিহ্ন ( ি,   )  ব্যবহার হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেমন- গাড়ি, চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি, শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, সরকারি, মালি, পাগলামি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মামি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচে, উঁচু, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুখা, মুলা, পুজো, উনিশ ইত্যাদি।

২. ক্ষঃ ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত শব্দে খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেতই লেখা হবে। তবে অ-তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিদে ইত্যাদি লিখতে হবে।

৩. মূর্ধন্য-ণ, দন্ত্য-নঃ তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-এর নির্দিষ্ট নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। এছাড়া তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণ-ত্ব বিধি মানা হবে না, অর্থাৎ ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন- অঘ্রান, ইরান, কুরআন, শুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, সোনা, হর্ন ইত্যাদি।

তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-এর পূর্বে ণ হয়। যেমন- কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচণ্ড৷ কিন্তু তৎসম ছাড়া অন্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ--এর পূর্বে কেবল ন হবে।

৪. শ ষ সঃ তৎসম শব্দের বানানে শ ষ স-এর নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষ-ত্ব বিধি প্রযোজ্য হবে না। বিদেশি মূল শব্দে শ স- এর যে প্রতিসঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যবহার করতে হবে। যেমন- সাল (বৎসর), সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিম, মসলা, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক, বেহেশত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট। তবে পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূপে শ দিয়ে লেখা হবে।

তৎসম শব্দে ট ঠ বর্ণের পূর্বে ষ হয়। যেমন- বৃষ্টি, দুষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশি শব্দে এক্ষেত্রে স লিখতে হবে। যেমন- স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিও, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট। কিন্তু খ্রিস্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিস্ট শব্দটি লেখা হবে।

৫. স শ ছঃ আরবি ফার্সি শব্দে 'সা' (ث) ‘সিন' (س) ‘সোয়াদ' (ص) বর্ণগুলোর প্রতিবর্ণরূপে ‘স' এবং 'শিন' (ش)-এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যবহার হবে। যেমন- সালাম, তসলিম, ইসলাম, মুসলিম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরী মাস), শাওয়াল (হিজরী মাস), বেহেশত ইত্যাদি। তবে এক্ষেত্রে স-এর পরিবর্তে ছ লেখার কিছু কিছু প্রবণতা দেখা যায়, তা ঠিক নয়। কিন্তু যেখানে বাংলায় বিদেশি শব্দের বানান সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে স ছ-য়ের রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ-য়ের ব্যবহার করতে হবে। যেমন- পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ ইত্যাদি।

৬. শ এবং এর ব্যতিক্রমঃ ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি S বর্ণ বা ধ্বনির জন্য ‘স’ এবং sh, sion, ssion, tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শি’ ব্যবহার হবে। তবে question ইত্যাদি শব্দের বানান অন্যরূপ। যেমন- কোএসচন  হতে পারে।

৭. জ যঃ বাংলায় প্রচলিত বিদেশি শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন- কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি, হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা ইত্যাদি।

কিন্তু আরবি কয়েকটি বিশেষ শব্দে ‘যা' (ز), ‘যোয়াদ' (ص) 'যাল' ( ذ ), ‘যোয়া’ (ض) রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি Z-এর মতো, সে ক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলোর জন্য য ব্যবহার হওয়া সঙ্গত। যেমন- আযান, এযিন, অযু, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান ইত্যাদি। তবে কেউ ইচ্ছা করলে এ ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন। তবে জাদু, জোয়াল, জো ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লিখতে হবে। 

৮. এ অ্যাঃ বাংলায় এ বা -েকার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা বাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাণ্ড জ্যামিতি ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম রয়েছে। অনুরূপ তৎসম বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা কোর হবে। যেমন— দেখে, দেখি, যেন, জেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো) গেল, গেলে, গেছে। বিদেশি অবিকৃত উচ্চারণ এর ক্ষেত্রে এ বা -েকার ব্যবহার হবে। যেমন- এন্ড, নেট, বেড, শেড ইত্যাদি।

বিদেশি শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা ্যা ব্যবহার হবে। যেমন- অ্যান্ড, অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট ইত্যাদি। তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশি শব্দ রয়েছে যার ্যা-কার যুক্তরূপ বহুল পরিচিত। যেমন- ব্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা, এসব শব্দে ্যা অপরিবর্তিত থাকবে।

৯. ওঃ বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহু ক্ষেত্রে ও-কার হয়। এ উচ্চারণকে লিখিতরূপ দেয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে। ো-কার ব্যবহার করছেন। যেমন- ছিলো, করলো, বলতো, কোরছে, হোলে, যেনো, কোনো (কী জন্য), ইত্যাদি ও- কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ণে-কার ব্যবহার করা হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে াে-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে। যেমন- ধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো, (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, ভালো, আলো, কালো, হলো ইত্যাদি। 

১০. ং ঙঃ তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেমন ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেভাবে ব্যবহার করতে হবে। তদ্ভব, দেশি বিদেশি, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ঐ . নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বর (ং) লিখতে হবে। যেমন- রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং ইত্যাদি। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তিযুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে। যেমন- বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের । বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি ং দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে। 

১১. রেফ (৴) ও দ্বিত্বঃ তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না, তেমনি অ-তৎসম সকল শব্দের ক্ষেত্রেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন- কর্জ, কোর্তা, মর্দ, সর্দার ইত্যাদি।

১২. বিসর্গঃ শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না। যেমন- কার্যত, প্রধানত, প্রয়াত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ ইত্যাদি। তবে যেসব শব্দের শেষে বিসর্গ না থাকলে অর্থের বিভ্রান্তি ঘটার আশঙ্কা থাকে, সেখানে শব্দের শেষে বিসর্গ থাকবে। যেমন- করতঃ পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে। কিন্তু অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জন করতে হবে। যেমন— দুস্থ, নিস্পৃহ।

১৩. আনো প্রত্যয়াত্ত শব্দঃ আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে CT-কার যুক্ত করা হবে। যেমন— করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো ইত্যাদি। 

১৪. বিদেশি শব্দ ও যুক্তবর্ণঃ বাংলায় বিদেশি শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে, তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে। তাই ব্যাপকভাবে বিদেশি শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাৎ ভেঙে দেওয়া উচিত নয়। শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষণ সম্ভবই নয়। যেমন- স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং। তবে কিছু কিছু বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন- সেপটেম্বর, অকটোবর, মার্কস, শেকসপিয়ার, ইসরাফিল ইত্যাদি।

১৫. হস-চিহ্ন (্): হস চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন- কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, শখ, টাক, টক, করলেন, বললেন ইত্যাদি। তবে যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তা হলে হস্ চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- উহ্, যাহ্ ইত্যাদি।

যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলে তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হচিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- কর্, ধর্, বল্ ইত্যাদি।

১৬. ঊর্ধ্ব কমাঃ ঊর্ধ্ব কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন- করল (করিল), ধরত (ধরিত), বলে (বলিয়া), হয়ে (হইয়া), দুজন, চারশ, চাল (চাউল), আল (আইল) ইত্যাদি।

বিবিধ

১. যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণগুলো যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে। অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলোর স্পষ্ট রূপ দিতে হবে। তার জন্য কিছু স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে। যেমন- গু, রু, শূ, দ্রু, শূ, র্, হ্, ত্র, ভ্র। তবে ক্ষ, জ্ঞ, হ্ম-এর পরিচিত যুক্তরূপ অপরিবর্তিত এবং অবিকৃত থাকবে। কারণ এগুলো বিশ্লিষ্ট করলে উচ্চারণ বিকৃতির আশঙ্কা থাকে।

২. সমাসবদ্ধ পদগুলো একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা চলবে না। যেমন- সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার, মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদমণ্ডিত, সমস্যাপূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ণ, দৃঢ়সংকল্প, সংযতবাক নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র ইত্যাদি । কারণ এগুলো বিশ্লিষ্ট করলে উচ্চারণ বিকৃতির সম্ভাবনা থাকে।

বিশেষ প্রয়োজনে সমাবসদ্ধ পদটিকে কখনো হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন- মা-মেয়ে, মা-ছেলে, বেটা বেটি, বাপ-বেটা, ভবিষ্যৎ-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, কিছু-না-কিছু ইত্যাদি।

৩.. বিশেষণ পদ সাধারণত পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। যেমন- সুনীল আকাশ, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন, সুগন্ধ ফুল, লাল গোলাপ, ভালো দিন, সুন্দরী মেয়ে। তবে যদি সমাসবদ্ধ পদ অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের গুণ বর্ণনা করে তাহলে স্বভাবতই সেই যুক্তপদ একসঙ্গে লিখতে হবে। যেমন- কতদূর যাবে, একজন অতিথি, একদিন এসো, বেশিরভাগ ছেলে, শ্যামলাবরণ মেয়ে। কিন্তু কোথাও কোথাও সংখ্যাবাচক শব্দ একসঙ্গে লেখা যাবে। যেমন- দু'জনা৷

৪. নাই নেই না- এই নঞর্থক অব্যয় পদগুলো শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন- বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই ইত্যাদি।

তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে না উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন— নারাজ, নাবালক, নাহক ইত্যাদি।

কিন্তু শব্দের অর্থকে স্পষ্ট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে না-এর পর হাইফেন ব্যবহার করা যাবে। যেমন- না-বলা বাণী, না-শোনা কথা, না- গোনা পাখি ইত্যাদি।

৫. উদ্ধৃতি মূলে যেমন আছে ঠিক তেমনি লিখতে হবে। কোনো পুরাতন রচনায় যদি বানান বর্তমান নিয়মের অনুরূপ না হয়, তবুও উক্ত রচনার বানানই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে হবে। যদি উদ্ধৃত রচনায় বানানের ভুল বা মুদ্রণের ত্রুটি থাকে, ভুলই উদ্ধৃত করে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে শুদ্ধ বানানটির উল্লেখ করতে হবে। এক বা দুই ঊর্ধ্ব-কমার দ্বারা উদ্ধৃত অংশকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে উদ্ধৃত অংশকে যদি ইনসেট করা হয় তাহলে ঊর্ধ্ব-কমার চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে না। তাছাড়া কবিতা যদি মূল চরণ-বিন্যাস অনুযায়ী উদ্ধৃত হয় এবং কবির নামের উল্লেখ থাকে সেক্ষেত্রেও উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়ার দরকার নেই। ইনসেট না হলে গদ্যের উদ্ধৃতিতে প্রথমে ও শেষে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়া ছাড়াও প্রত্যেক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দিতে হবে। প্রথমে, মধ্যে বা শেষে উদ্ধৃত রচনার কোনো অংশ যদি বাদ দেয়া হয় অর্থাৎ উদ্ধৃত করা না হয়, বাদ দেওয়ার স্থানগুলোকে তিনটি বিন্দু বা ডট (অবলোপ- চিহ্ন) দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। গোটা অনুচ্ছেদ, স্তবক বা একাধিক ছত্রের কোনো বৃহৎ অংশ বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনটি তারকার দ্বারা একটি ছত্র রচনা করে ফাঁকগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। কোনো পুরাতন রচনার অভিযোজিত বা সংক্ষেপিত পাঠে অবশ্য পুরাতন বানানকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তন করে লিখা যেতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক