গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে কি বুঝ?


প্রশ্নঃ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে কি বুঝ?
অথবাঃ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাকে বলে? 

ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিমূর্ত কিছু মৌল বিষয় বা ধারণা (concept) বা প্রত্যয় নিয়ে আলোচনা করে। এ বিমূর্ত বিষয় বা প্রত্যয় বা ধারণা হলো মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য।  সমাজজীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড যে সকল নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারণা যত বেশি উন্নত, সে সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি উন্নত ও প্রগতিশীল। সুশাসনের সাথে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পর্ক খুবই নিবিড়।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয়ঃ যে চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি। মূল্যবোধের বিভিন্ন দিক রয়েছে, যথা- সামাজিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রভৃতি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেসব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব মূল্যবোধ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড। এসব মূল্যবোধের আদর্শে মানুষের আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। শুধু তাই নয়, এ মানদণ্ডে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাজের ভালোমন্দ বিচার করা হয়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে এসব মূল্যবোধকে সংরক্ষণ করাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষের এসব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই তারা এগুলোকে মেনে চলে। নিচে কয়েকটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

ক. সহনশীলতাঃ সহনশীলতা গণতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সফল করার জন্য সহনশীলতা একান্ত অপরিহার্য। গণতন্ত্রে অন্যের মতামত ও মনোভাবকে শ্রদ্ধা করার মতো সহিষ্ণুতা থাকতে হবে। সহনশীলতা, সুনাগরিকের অন্যতম গুণ। উত্তেজনা প্রশমন ও সুখী সুন্দর সমাজ গঠনে সহনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

খ. আত্মসংযমঃ আত্মসংযম সুনাগরিকের একটি বড় গুণ। এই মহৎ গুণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। তা গ্রহণ ও শ্রদ্ধার শিক্ষাই আত্মসংযম। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অন্য দলের মতামত শোনা, তা প্রকাশ করতে দেওয়ার গঠনমূলক সমালোচনা করতে দেওয়ার, গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা বা সংযম থাকতে হবে। সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

গ. সহমর্মিতাঃ সহমর্মিতা একটি মানবীয় গুণ। সহমর্মিতার অনুভূতি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষকে পারস্পরিক সুখে-দুঃখে আপন করে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' সহমর্মিতার এই অনুভূতিই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।

ঘ. শৃঙ্খলাবোধঃ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অগ্রগতির প্রধান ধাপ বা সোপান হলো শৃঙ্খলাবোধ। যে জাতি যত বেশি সুশৃঙ্খল সে জাতি তত বেশি উন্নত। সমাজ বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে ব্যক্তির নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। এর ফলে রাষ্ট্রের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

ও. আইনের শাসনঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্যক্তির স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার রক্ষার জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য। আইনের শাসন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যক্তি তার সামাজিক মর্যাদা খুঁজে পাবে এবং অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হবে।

চ. নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধঃ অধিকার ও কর্তব্য সচেতন নাগরিককে সুনাগরিক বলা হয়। সচেতন নাগরিক বুঝতে পারেন কোন্ দল তাদের জন্য ভালো এবং কোন প্রার্থী ভালো। দেশের জন্য কেমন শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি, শ্রমনীতি, বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করা উচিত এবং তা কোন্ দলের মাধ্যমে তারা যেতে পারেন তা একজন সচেতন নাগরিক বুঝতে পারেন। এজন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হয়।

ছ. রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। অপরের মতামত প্রকাশের অধিকারকে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। নিজ দলের নেতা-কর্মীকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

জ. জনগণের রায় বা নির্বাচনি ফলাফলকে মেনে নেওয়াঃ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচনে জনগণের দেওয়া রায়কে মেনে নিতে হবে। জয়-পরাজয়কে মেনে নিতে হবে। পরাজিত হলে নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিয়ে খুঁজে দেখতে হবে– কেন জনগণ তাদের দলকে বর্জন করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামতকে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে।

ঝ. দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাঃ সরকারকে তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ বা মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তাদের কর্মকাণ্ড হতে হবে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত।

পরিশেষঃ মূল্যবোধ থেকে আসে আইন। আইন হচ্ছে নাগরিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু বিধানের সমষ্টি যা রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক গৃহীত ও সমর্থিত এবং জনকল্যাণের জন্য অপরিহার্য। আইন স্বাধীনতার শর্ত ও প্রধান রক্ষাকবচ। আইন স্বাধীনতার রক্ষক। আর গণতন্ত্র স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক