মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর


প্রশ্নঃ মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিমূর্ত কিছু মৌল বিষয় বা ধারণা (concept) বা প্রত্যয় নিয়ে আলোচনা করে। এ বিমূর্ত বিষয় বা প্রত্যয় বা ধারণা হলো মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য। এগুলো একটির সাথে অন্যটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। সমাজজীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড যে সকল নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে। 

মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Values): যে চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি। মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এগুলো নিম্নরূপঃ

১. সামাজিক মূল্যবোধ (Social values): যে চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামাজিক আচার- ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তার সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে। স্টুয়ার্ট সি. ডড.-এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হলো সে সব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে।' ক্লাইড ক্লখোন-এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব প্রকাশ্য ও অনুমেয় আচার-আচরণের ধারা যা ব্যক্তি ও সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত।' নিকোলাস রেসার-এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব গুণাবলি যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে মূল্যবান মনে করে খুশি হয়।' সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা গুণাবলির সমষ্টি।

২. রাজনৈতিক মূল্যবোধ (Political Values): যে চিন্তাভাবনা লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের রাজনৈতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে রাজনৈতিক মূল্যবোধ বলে। রাজনৈতিক সততা, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ, রাজনৈতিক সহনশীলতা, রাজনৈতিক জবাবদিহিতার মানসিকতা, দায়িত্বশীলতার নীতি কার্যকর করা, পরমতসহিষ্ণুতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রতি সংখ্যালঘিষ্ঠের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান, সংখ্যালঘিষ্ঠের মতের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সহিষ্ণু আচরণ, বিরোধী মতকে প্রচার ও প্রসারের সুযোগ প্রদান, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান না করা, নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে মেনে নেয়া, আইনসভাকে কার্যকর হতে সাহায্য করা ইত্যাদি হলো রাজনৈতিক মূল্যবোধ। 

৩. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (Democratic Values): একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেসব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে অন্যের মতামত ও মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। কেননা সহনশীলতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের অন্যতম গুণ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। গঠনমূলক সমালোচনা করার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা ও সংযম গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানুষকে পারস্পরিক সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবসময় ভাবতে হবে 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' শৃঙ্খলাবোধে বিশ্বাসী হতে হবে। অধিকার ও কর্তব্য সচেতন হতে হবে। সরকারকে তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ বা মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচনে জয়- পরাজয়কে মেনে নিতে হবে। আইনসভাকে কার্যকর করতে হবে। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও নয়, বরং আইনসভায় বসে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

৪. ধর্মীয় মূল্যবোধ (Religious Values): যে সব ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-আচরণ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, অপরের ধর্মমতকে সহ্য করা, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মকর্ম ও ধর্ম প্রচারে বাধা না দেয়া, রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ কোনো ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভাবা এবং সেভাবে বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা প্ৰদান না করাই হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ।

৫. সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ (Cultural Values): যে সব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বলে। সমাজে বসবাসকারী মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার, কর্মকাণ্ড ও সংগঠন থাকতে পারে। সেগুলোর প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। সব ধরনের সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহ প্রদান করতে হবে। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কৃতি চর্চায়, বাধানিষেধ আরোপ করা উচিত নয়। তবে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি চর্চা, পশ্চিমা সংস্কৃতির রুচিহীন চর্চা, আকাশ-সংস্কৃতির মন্দ দিকগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে।

৬. নৈতিক মূল্যবোধ (Moral Values): নীতি ও উচিত-অনুচিত বোধ হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস। নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব মনোভাব এবং আচরণ যা মানুষ সবসময় ভালো, কল্যাণকর ও অপরিহার্য বিবেচনা করে মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করে। সত্যকে সত্য বলা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা, অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং অন্যকে বিরত রাখতে পরামর্শ প্রদান করা, দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও বিপদ থেকে উদ্ধারে তাকে সাহায্য করা, অসহায় ও ঋণগ্রস্ত মানুষকে ঋণমুক্ত হতে সাহায্য করাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলা যেতে পারে। শিশু তার পরিবারেই সর্বপ্রথম নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা পায়।

৭. অর্থনৈতিক মূল্যবোধ (Economic Values): মানুষের যেমন সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন রয়েছে তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক জীবন। অর্থনৈতিক জীবনে তাকে কিছু কাজ-কর্ম করতে হয়, বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হয়। এগুলোর সমষ্টিকেই বলা হয় অর্থনৈতিক মূল্যবোধ। আর্থিক লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন ও বিপণনের সাথে এসব মূল্যবোধ জড়িত৷

৮. আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ (Spiritual Values): মানুষের কিছু আধ্যাত্মিক বা আত্মিক মূল্যবোধ রয়েছে। এজন্যই মানুষ ভালোভাবে, সৎভাবে বাঁচতে চায়, সৎ থাকতে চায় এবং সৎ মানুষকে পছন্দ করে, মিথ্যেবাদীকে ও অসৎ মানুষকে ঘৃণা করে, ভালো কাজ করতে পারলে মনে মনে স্বস্তি ও তৃপ্তিবোধ করে। অন্তর্নিহিত আত্মিক শক্তিই (Spiritual Power) মানুষকে এসবে উদ্বুদ্ধ করে। আত্মিক মূল্যবোধ সহজাত।

৯. আধুনিক মূল্যবোধ (Modern Values): সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। এজন্যই অতীতের অনেক মূল্যবোধই এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। অতীতে বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল, এখন মানুষ বাল্যবিবাহকে অপছন্দ করে। রাষ্ট্র আইন করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। অতীতে হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা, সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। এগুলো আজ আর নেই। মূল্যবোধ এজন্যই নৈর্ব্যক্তিক বর্তমানের অনেক মূল্যবোধ একদিন ভবিষ্যতে হয়তো থাকবে না। গড়ে ওঠবে নতুন মূল্যবোধ।

পরিশেষঃ যে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারণা যত বেশি উন্নত, সে সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি উন্নত ও প্রগতিশীল। সুশাসনের সাথে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পর্ক খুবই নিবিড়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক