বাংলা দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশের ধারা সম্পর্কে আলোচনা কর


প্রশ্নঃ দোভাষী পুঁথির উদ্ভব ও বিকাশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি আলোচনাপূর্বক এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, দোভাষী পুঁথি সাহিত্য রচিত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যাপূর্বক দুজন প্রধান কবি সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, কোন বিশেষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে মধ্যযুগের শেষের দিকে পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল, তা সবিস্তারে আলোচনা কর। 

অথবা, বাংলা দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ধারা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ১৭৬০ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বাংলা, হিন্দি, তুর্কি, আরবি-ফারসি শব্দমিশ্রিত এক ধরনের বিশেষ কাব্য রচিত হয়েছে, এ কাব্যগুলো পুঁথি সাহিত্য নামে চিহ্নিত। এ সকল কাব্য অলৌকিকতাপূর্ণ বীরত্ব বা প্রেমকাহিনী নিয়ে রচিত। যারা এ ধরনের কাব্য রচনা করেন তাদেরকে বলা হয় শায়ের। মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে এ ধারার সূত্রপাত হলেও আধুনিক যুগের অনেকটা সময় ধরে এ পুঁথি সাহিত্যের অস্তিত্ব ও প্রভাব ছিল।

পুঁথি সাহিত্য নাম নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে রেভারেন্ড জে. লং. এর পুস্তক তালিকায় এ শ্রেণীর কাব্যকে মুসলমান বাংলা সাহিত্য এবং এর ভাষাকে মুসলমানী বাংলা বলা হয়েছে। কিন্তু কলকাতার সস্তা ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে এ ধারার কাব্য দেশময় প্রচারিত হয়েছিল বলে একে বটতলার পুঁথি বলা হত। কিন্তু সুনীতিবাবু, সুকুমার সেন ও দীনেশচন্দ্র সেন এ ধারার কাব্যকে দোভাষী পুঁথি সাহিত্য বলেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, এ কাব্যগুলোতে আরবি-ফারসি শব্দের সংমিশ্রণের জন্য দোভাষী পুঁথি সাহিত্য নাম হয়েছে। কিন্তু বস্তুত এসব কাব্যে বাংলা, হিন্দি, তুর্কি, আরবি-ফারসি ভাষার শব্দের মিশ্রণ দেখা যায়।

মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের রচিত কাব্যের স্থুল কলেবর, পরিশ্রুত ও সংস্কৃতঘেষা ভাষা ইত্যাদির জন্য জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেললে দোভাষী পুঁথি তার স্বচ্ছন্দতা, সংক্ষিপ্ত আকার, সহজ ভাষা ও সাবলীল গল্পের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ছাপাখানার বদৌলতে এবং প্রকাশকদের আনুকূল্যে সহজলভ্য হয়ে ওঠে।

পুঁথি সাহিত্যের ভাষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দের বাহুল্যপূর্ণ ব্যবহার, আরবি-ফারসি শব্দের নাম ধাতুর ব্যবহার এবং হিন্দি ধাতুর প্রয়োগ, অনুসর্গ ও উপসর্গরূপে বাংলা ও আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দের প্রয়োগ, ফারসি বহুবচনের ব্যবহার, পুংলিঙ্গে বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দের প্রয়োগ ইত্যাদি।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভবেও যুগ-প্রভাব কাজ করেছে। সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পূর্বে অর্থাৎ মোগল শাসনের শেষদিকে ইরান থেকে এদেশে ধর্মনেতা ও পীর-ফকিরদের মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্নের চেষ্টা চলে, সে সময় এদেশে বসবাসরত ইরানী শিয়াদের মাধ্যমে ফারসি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। পীরের কাছে দেব-দেবীর পরাজয়ের ও পীর প্রতিষ্ঠালাভের উপাখ্যান রচনা, ধর্মশাস্ত্রের অনুবাদ অনুকরণ ইত্যাদি শুরু হয়।

তাছাড়া সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর বাংলাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সংস্কৃতির বিকাশ হয় বাধাপ্রাপ্ত। ১৭৬০–১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ ক্রান্তিকাল বলে পরিচিত। এ সময় কোন শক্তিমান সৃজনশীল কবির আবির্ভাব ঘটে নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব শাসনব্যবস্থার সাথে সমাজের উপরও পড়েছে। ইংরেজ শাসন শুরু হয়। ফলে উচ্চবিত্ত মুসলমান ক্ষমতা হারিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও নাজুক হয়ে ওঠে। ইংরেজের অত্যাচারে সুস্থ মানসিকতা সমাজজীবন থেকে বিদায় নেয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সাধারণ কৃষক দরিদ্র ও ভূমিহীন হয়ে পড়ে। মুসলমানেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি— শাসন ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়। আর্থ-সামাজিক এহেন পরিস্থিতিতে ভাল সাহিত্য নির্মিত হয় না, ফলে অশিক্ষিত জনগণকে আনন্দ দিতে পুঁথি সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর, তার অঞ্চলে (ভুরসুট পরগনার বসন্তপুর) ইসমাইল গাজীকে উপলক্ষ করে একটি পীরের আস্তানা গড়ে ওঠে। সাধারণের কাছে তিনি বড়খাঁ গাজী নামে পরিচিত। এই বড়খাঁ গাজীকে কেন্দ্র করে ভুরসুট মান্দারণে পুঁথি সাহিত্যের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। শতবছরে পুঁথি সাহিত্য নানা বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে। ফলে এ সাহিত্য নানা মাত্রা পেয়েছে। সেদিক বিবেচনায় বিষয়ানুসারে পুঁথি সাহিত্যকে আমরা চার ভাগে ভাগ করেছি— 

১। প্রণয়োপাখ্যান – ইউসুফ-জোলেখা, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, লাইলী মজনু, গুলে-বকাওলী ইত্যাদি। 

২। যুদ্ধ সম্পর্কিত— জঙ্গনামা, আমীর হামজা, সোনাভান, কারবালা যুদ্ধ ইত্যাদি। 

৩। পীর পাঁচালি— গাজী কালু চম্পাবতী, সত্যপীরের পুঁথি ইত্যাদি। 

৪। ইসলাম ধর্ম, ইতিহাস, নবী-আউলিয়ার জীবনী ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কিত— কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, হাজার মাসলা ইত্যাদি।

পুঁথি সাহিত্যের দুজন বিশিষ্ট কবিই ভুরসুট মান্দারণ এলাকার, যার একজন ফকির গরীবুল্লাহ, অন্যজন সৈয়দ হামজা। গরীবুল্লাহর পুঁথির নাম ‘আমীর হামজা'। কাব্যটি তিনি শেষ করতে পারেন নি, সৈয়দ হামজাকে শেষ করতে হয়েছে। কাব্যের বিষয় ইরানের শাহ নওশের ওয়ানের সাথে রসুল (স) এর চাচা আমীর হামজার যুদ্ধের বর্ণনা।

গরীবুল্লাহর দ্বিতীয় কাব্য 'ইউসুফ-জোলেখা' একটি প্রেমকাহিনী। তার অন্যান্য পুঁথি- জঙ্গনামা, সোনাভানের পুঁথি, সত্যপীরের পুঁথি।

গরীবুল্লাহ দোভাষী পুঁথির প্রথম কবি হলেও এ শাখার সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি সৈয়দ হামজা। তার ভাষা আবেগময়। শব্দ ব্যবহার, উপমা ও রূপক প্রয়োগে তিনি বেশ নতুনত্ব দেখিয়েছেন। তার ‘মধুমালতী'তে দোভাষী রীতি অনুসরণ করেন নি। তবে কাহিনী ও প্রকৃতিতে দোভাষী পুঁথির প্রভাব আছে। এটি রোমান্টিক রসাশ্রিত সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী । সৈয়দ হামজার দ্বিতীয় পুঁথির নাম জৈগুনের পুঁথি। এতে হযরত আলীর পুত্র হানিফার সাথে বিবি জৈগুনের যুদ্ধ কাহিনী বর্ণিত। বিবি জৈগুন হিন্দু এবং হানিফা মুসলমান। জৈগুন পরাজিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। কাহিনী অবাস্তব ও হাস্যকর।

পুঁথির কাহিনী কোন যুদ্ধ বা ঐতিহাসিক ঘটনা কেন্দ্র করে রচিত। এতে শায়েরগণ আরবি- ফারসি-হিন্দুি ও উর্দু শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। তারা বিভিন্ন নবী, চার খলিফা এবং ইমামদের নিয়ে কাব্য লিখেছেন। এ ধরনের পুঁথির নাম ‘কাসাসুল আম্বিয়া'। এ পুঁথির তিনজন রচয়িতা যথাক্রমে রেজাউল্লাহ, আমির উদ্দিন ও আশরাফ আলী। হযরত রসুলে করিম (স) এর জীবনী নিয়ে যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে সৈয়দ সুলতান, জৈনুদ্দিন, শেখ চাঁন ও হায়াত মাহমুদের নাম উল্লেখযোগ্য। কারবালার বিষাদাত্মক কাহিনী নিয়েও পুঁথি সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ ধরনের কাব্যের নাম ‘জঙ্গনামা'। কবি মোহাম্মদ খানের ‘মক্তুল হোসেন' এ ধারার প্রাচীন কাব্য। জঙ্গনামার শেষ কাব্য ‘শহীদে কারবালা'।

রোমান্টিক কাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাইলী-মজনু, গুলে বকাওলী, চাহার দরবেশ, হাতেম তাঈ এর কাহিনী। মোহাম্মদ খাতের ফেরদৌসীর শাহনামা তরজমা করেন দোভাষী রীতিতে। কবি আব্দুল হাকিম পীর ফকিরদের কাহিনী নিয়ে রচনা করেন ‘গাজী কালু ও চম্পাবতী'।

দোভাষী পুঁথির লেখকদের মধ্যে আরও অনেকেই ছিলেন, যেমন- মালে মাহমুদ, জনাব আলী, আব্দুর রহিম, মনিরুদ্দিন, আয়েজুদ্দিন, মুহম্মদ মুনশী, তাজউদ্দিন, দানেশ, আরিফ, রেজাউল্লাহ, সাদ আলী, আব্দুল ওহাব প্রমুখসহ দু'শতাধিক কবি কয়েকশ কাব্য রচনা করেন। দোভাষী পুঁথির ধারা এখন অবলুপ্তির পথে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক