ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক মতবাদগুলো আলোচনা কর


প্রশ্নঃ ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক মতবাদগুলো আলোচনা কর। 

অথবা, ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক কেমন? এই সম্পর্ক বিষয়ক মতবাদ হিসাবে ঈশ্বরবাদ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক জীব। ফলে সমাজের অনেক জানা-অজানা বিষয় তাকে অবলোকন করতে হয়, তারই ফলশ্রুতিতে সে হয়ে ওঠে চিন্তাশীল। মানুষ জন্মগতভাবেই অপরিপূর্ণ, তাই সে মনেপ্রাণে খুঁজে ফেরে পরিপূর্ণতাকে। সে জানতে চায় এই বিশাল পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব। মানুষের এই অপূর্ণতা থেকেই সে এক অতিপ্রাকৃত শক্তির অভাব অনুভব করে। এই অতিপ্রাকৃত শক্তিই হলো ঈশ্বর। “ঈশ্বর ঠিক কোথায় অবস্থান করেন”- এ বিষয়ে যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মতভেদ রয়েছে। তাদের আলোচ্য বিষয় হলো, ঈশ্বর কি জগতের ভেতরে অবস্থান করেন, নাকি বাইরে ঈশ্বরের অবস্থান-সম্পর্কিত মতবাদগুলোর অন্যতম হলো অতিবর্তি ঈশ্বরবাদ”।

ঈশ্বরের সাথে জীবাত্মার সম্পর্কঃ ঈশ্বরের সাথে জগতের সম্পর্ক যেমন নিবিড়, ঠিক একইভাবে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কটাও যেমন নিবিড় ও নৈকট্যময়। ঈশ্বরের সাথে মানুষের বা জীবাত্মার সম্পর্কের তিনটি প্রধান দিক দেখা যায় যথাঃ (১) দৈহিক (২) বুদ্ধিসম্মত দিক (৩) এবং নীতিসম্মত দিক। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

(১) দৈহিক বা শারীরিকঃ শারীরিক দিক দিয়ে মানুষ বা জীবাত্মা হলো নিষ্ক্রিয় উপাদান বা পন্থা এবং এটি লক্ষ্য নয়। কিন্তু দেখা যায়, মন কিছু অংশে স্বয়ং লক্ষ্য। কেননা তার স্বনির্ভর অস্তিত্ব ও লক্ষ্য বিদ্যমান। মানুষের চেতনা দেহের দিক থেকে উন্নত, ঈশ্বরের দৈহিক রূপ নিষ্ক্রিয় উপাদানের মধ্য দিয়ে নিজেকে এক আত্মচেতন জীবরূপে প্রকাশ করে। এই নিষ্ক্রিয় উপাদান ও মানুষের চেতনা বা মন উভয়ই ঈশ্বর থেকে উদ্ভূত। এ কারণে দৈহিক বা শারীরিক দিক দিয়ে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।

(২) বুদ্ধিসম্মতঃ মানুষ বা জীবের বুদ্ধিসম্মত দিক থেকে জীবদেহ যেমন পন্থা বা উপায়, তেমনি মন বা আত্মা হলো কতক অংশে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। জীবদেহ একট জড়বস্তু। এটা এক যন্ত্রের ন্যায়, এর আত্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু মন বা জীবন হলো আত্মসচেতন এবং এর আত্মনিয়ন্ত্রণের যথেষ্ঠ ক্ষমতা আছে। এই জীবাত্মা, পরমাত্মা বা ঈশ্বরের একটি সীমিত প্রকাশ। যার ফলে জীবাত্মার একটা সীমিত গণ্ডির মধ্যেই আত্মনিয়ন্ত্রন বা স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে। জীবাত্মার ধারণা কেবল ঈশ্বরের ধারণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

(৩) নীতিসম্মত বা আইনগত দিকঃ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীন ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তা খুবই অল্প। মানুষ ইচ্ছা করতে পারলেও তা বাস্তাবায়নের ক্ষমতা তার সীমিত এ দৃষ্টিকোণ থেকে এক বাক্যে বলা যায় যে, “ঈশ্বরের ইচ্ছার বা পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই"।

অতিবর্তী ঈশ্বরবাদঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ মতানুসারে, অনাদিকাল থেকে ঈশ্বর এক এবং একাকী বিরাজ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি একটি জগত সৃষ্টির কল্পনা করলেন। তার পরিকল্পনা অনুসারে তিনি শূন্য থেকে জগত সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি জগত পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় কতিপয় শক্তি সৃষ্টি করেন এবং ঐ শক্তির ওপর জগতকে ছেড়ে দেন। ঐ শক্তিগুলো এ জগতকে নিয়ন্ত্রণ ও চালনা করতে থাকে। এই শক্তিগুলো গৌণ কারণ এর পেছনে রয়েছে ঈশ্বর, তিনি মুখ্য কারণ। অতঃপর ঈশ্বর জগত থেকে দূরে থাকে এবং জগত স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করে। তারপর থেকে জগত এক বিরাট বিস্ময়কররূপে কাজ করে যেতে থাকে। এই যন্ত্র যখন যাত্রাপথে বিকল হয়ে যায়, ঈশ্বর এতে হস্তক্ষেপ করে পূর্বাবস্থায় নিয়ে যায়। তাছাড়া, যন্ত্র আপন শক্তিতেই চলতে থাকে। এবং ঈশ্বর এই জগতের বাইরে অবস্থান করে। সুতরাং ঈশ্বর ও জগত দুই-ই স্বতন্ত্র সত্তার উভয়ের মধ্যে কোনো আন্তর সম্পর্ক নেই৷ উভয়ের সম্পর্ক হলো বাহ্য সম্পর্ক।

অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ কতিপয় বিষয় দার্শনিকগণ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত বা পূর্বস্বীকৃত। বিষয়গুলো নিম্নরূপঃ

(১) বিশেষকালে জগতের সৃষ্টিঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ পূর্ব থেকেই স্বীকার করে যে কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। এবং এটা একসময় চিহ্নিত ছিল। আবার কালের পরিক্রমায় একসময় থাকবে না।

(২) ঈশ্বরের দ্বিরূপঃ এমত অনুসারে ঈশ্বর দুটি রূপে দৃশ্যমান হয়। তাদের মতে, পৃথিবী সৃষ্টির আগে ঈশ্বর এক ধরনের রূপে পরিলক্ষিত হতো এবং জগত সৃষ্টির পর তা এক ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে।

(৩) জগতসৃষ্টিঃ এ মতানুসারে ঈশ্বর একটি নির্দিষ্ট সময়ে শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তাই ঈশ্বর জগত সৃষ্টির আগে ও পরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিরাজ করে।

(৪) মুখ্য কারণ ও গৌণ কারণের তারতম্যঃ জগতের স্রষ্ট্রা হিসাবে ঈশ্বর হলেন প্রথম / আদি বা মুখ্য কারণ। জগত সৃষ্টিতে একমাত্র ঈশ্বরই ভূমিকাশীল ও একচ্ছত্র অধিকারী। তিনি জগতকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার জন্য কতিপয় শক্তি সৃষ্টি করেছেন, তা হলো গৌণ কারণ।

(৫) ঈশ্বরের হস্তক্ষেপঃ ঐ মতবাদ অনুসারে, ঈশ্বর যদিও জগত সৃষ্টির পর জগতের বাইরে অবস্থান করে, তথাপি তিনি প্রয়োজনবোধে হস্তক্ষেপ করে স্বাভাবিক পর্যায় বা আস্থা আনয়ন করে থাকেন।

(৬) ঈশ্বর জগতবহির্ভূতঃ এ মতবাদ অনুযায়ী, জগত সৃষ্টির পর ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে জগতবহির্ভূত অবস্থানে থাকে। তাই ঈশ্বরের জগত সম্পূর্ণরূপে সৃষ্ট জগতের বাইরে অবস্থান করে।

সমালোচনাঃ সবকিছুই সমালোচনার আওতাধীন। তাই অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের কতিপয় যুক্তি আছে, যা সমালোচিত ও গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন-

(১) ঈশ্বরের অবস্থান অভাবে ঊর্ধ্বেঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ অনুসারে, ঈশ্বর কোনো এক বিশেষ সময়ে তার প্রয়োজন অনুসারে জগত সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর হলো পূর্ব সত্তা, তার কোনো শরিক বা অভাব থাকতে পারে না, সুতরাং এ মত গ্রহণযোগ্য নয়।

(২) শূন্যে থেকে কিছু সৃষ্টিঃ শূন্যে থেকে কিছু সৃষ্টি হয় না। এ মতানুসারে, ঈশ্বর শূন্য থেকে এ জগতকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু শূন্য থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি বিজ্ঞানসম্মত নয়। অর্থাৎ Nothing comes broms nothing থেকে শূন্য আছে)। তাই এ মতের যে ধারণা তা ভিত্তিহীন।

(৩) গৌণ কারণ জগত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ অনুসারে, জগত সৃষ্টির পর গৌণ কারণ জগত নিয়ন্ত্রণ করে। গৌণ কারণ চেতনাই। তাছাড়া মুখ্য কারণ থাকা সত্ত্বেও গৌণ কারণ নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না। কাজেই চেতনাহীন গৌণ কারণ জগত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে ঈশ্বরের অস্বিত্ব প্রমাণে যেসব যুক্তিসমূহ উপস্থাপিত হয়েছে, তন্মধ্যে ঈশ্বরবাদ অন্যতম। এ মত সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এর সাথে সর্বেশ্বরবাদের উদ্ভব হয়েছে। তবে ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষ আগে জানত না। ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানার্জন ও চিন্তন প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নিতে এ মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক