কাদারিয়া কারা? তাদের মতবাদসমূহ আলোচনা কর


প্রশ্নঃ কাদারিয়া কারা? তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতবাদগুলো বিশ্লেষণ কর।
অথবা, কাদেরিয়া সম্প্রদায় কারা? তাদের মূলনীতিসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, কাদারিয়া সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও। তাদের মতবাদসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ ইসলাম একটি সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। সাম্য, ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইসলামের মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মানবতার প্রতিষ্ঠাই ইসলামের পরম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে ইসলাম যতদূর সাফল্য লাভ করেছে, জগতের অন্য কোনো ধর্ম ততদূর সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু কালের বিবর্তনে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে কাদারিয়া সম্প্রদায় অন্যতম।

কাদারিয়া সম্প্রদায়ঃ কাদারিয়া শব্দটির উৎপত্তি 'কদর' শব্দ থেকে। 'কদর' শব্দের অর্থ হলো ক্ষমতা, শক্তি বা মর্যাদা। এটি আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা এবং জগতের সব কিছুরই পূর্ব-নির্ধারণ বুঝায়। আবার এটি বলতে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাও বুঝায়। ইসলামি চিন্তাজগতে যারা বিশেষভাবে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাদেরকে কাদারিয়া বলা হয়। জাবারিয়া সম্প্রদায়ের মতামতের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কাদারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। 

উমাইয়া শাসনের শেষ প্রান্তে এ মতবাদের সূত্রপাত। বিশিষ্ট মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ ইমাম হাসান আল বসরী মানুষের ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনিই কাদারিয়া চিন্তার বীজ বপন করেছিলেন। তার শিষ্য মাবাদ আল জুহানি (মৃত্যু ৬৯৯ খ্রি.) এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। মাবাদ আল-জুহানি উমাইয়া শাসকদেরকে দুর্বৃত্ত ও পাপাচারী বলে অভিহিত করেন, ফলে খলিফা আব্দুল মালিকের নির্দেশে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। 

তার মৃত্যুর পর ইউনুস আলী আসওয়ারি ও খিলান দামেস্কি কাদারিয়া সম্প্রদায়ের বিকাশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য মাবাদ আল জুহানির মতো খিলান দামেস্কিকেও (মৃত্যু ৭২৯ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করতে হয়। কিন্তু মানুষের চিন্তার বিপ্লবী পরিবর্তন কোনোকালেই অস্ত্রবলে দমিত হয়নি। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

কাদারিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদ বা মূলনীতিসমূহঃ কাদারিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদ বা মূলনীতিসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

১. মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসীঃ কাদারিয়াগণ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা মনে করেন, মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। মানুষ নিজেই তার কর্মের নিয়ন্তা এবং তার কর্মের জন্য সে নিজেই দায়ী। আল্লাহ তায়ালা সরাসরি কোনো মানুষের কর্ম তৈরি করে দেন না, তবে তিনি মানুষকে কর্মক্ষমতা দান করেন। মানুষ তার অশুভ কার্যের জন্য দায়ী। এগুলোর দায়িত্ব আল্লাহর উপর আরোপ করা ঠিক নয়। মানুষ অদৃষ্টের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়, মানুষকে তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

২. আল্লাহর পবিত্রতায় বিশ্বাসীঃ কাদারিয়াগণ মনে করেন, মানুষের সমুদয় কাজ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাদারিয়াগণ মানুষের নৈতিক দায়িত্বের উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং আল্লাহকে অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করেন। তাদের মতে, আল্লাহ মানুষকে ভালো কাজ করলে পুরস্কার দিবেন এবং মন্দ কাজ করলে শাস্তি দিবেন। তাদের মত হলো, মন্দ ইচ্ছা ও কর্মের সম্পর্ক আল্লাহর প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে না। এর সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে।

৩. কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসীঃ কাদারিয়া সম্প্রদায় মানুষের কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা বলেন, মানুষের কর্মের উপর মানুষের ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ নিজেই তার কর্মের নিয়ন্তা।

৪. কবিরা গুনাহঃ কাদারিয়া সম্প্রদায়ের মতে, কবিরা গুনাহকারী হলো ফাসেক। অর্থাৎ সে মুমিনও নয় আবার কাফেরও নয়।

৫. আল্লাহর দর্শনঃ কাদারিয়া সম্প্রদায়ের মতে, মানুষের চোখে আল্লাহর দর্শন সম্ভব নয়। তাদের ধারণা হলো আল্লাহ তায়ালা নিজেও মানুষকে দেখেন না, পাশাপাশি মানুষও আল্লাহকে দেখে না। তবে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেখেন কিনা, এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একদল মনে করেন যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেখেন এবং আরেক দল মনে করেন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেখেন না। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো আল্লাহ তায়ালা সর্বদ্রষ্টা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা গোপনে বা প্রকাশ্যে সব কিছু দেখেন।

৬. আল্লাহর কালাম সৃষ্টঃ কাদারিয়া সম্প্রদায়ে মতে, আল্লাহর তায়ালার কালাম সৃষ্ট। তার বিধিনিষেধ সমস্ত কিছুই হলো সৃষ্ট। তাদের সকলেই এরূপ ধারণা পোষণ করেন যে, আল্লাহর কালাম অনিত্ব এবং সৃষ্ট। এ বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো আল্লাহর কালাম সৃষ্ট নয়।

৭. আল্লাহর অনাদি গুণাবলি অস্বীকারঃ কাদারিয়া সম্প্রদায় আল্লাহর অনাদি গুণাবলিসমূহ যথাঃ ইলম, কুদরত, হায়াত, দর্শন প্রভৃতি অস্বীকার করে। তাদের মতে, আল্লাহর অনাদি গুণাবলি বলে কিছুই নেই। এছাড়া তারা বলেন, অনাদিকালে আল্লাহর কোনো গুণাবলিই ছিল না। কিন্তু আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মতে, আল্লাহর গুণাবলি অনাদি কাল থেকেই বিদ্যমান এবং অনন্ত কাল পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।

৮. মিরাজঃ কাদারিয়া সম্প্রদায় মিরাজ অস্বীকার করেন। কাদারিয়াদের মতে, মিরাজ সত্য নয়। কারণ মানুষের পক্ষে মহাশূন্য, সাত আসমান, জান্নাত, জাহান্নাম প্রভৃতি ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদায় মিরাজ সত্য।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কাদারিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদ অনেকটা চরমপন্থি। কাদারিয়াগণ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও কর্মশক্তিকে শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর শক্তিকে অবহেলা করেছেন। কিন্তু এ সম্প্রদায় কুরআনের আয়াতসমূহকে নিজ নিজ মতবাদের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছেন। এ কারণে মুসলিম দর্শন শাস্ত্র অনুসারে কাদারিয়া মতবাদকে একবাক্যে অস্বীকারও করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক