ঈশ্বর সম্পর্কে নাস্তিকদের ধারণা আলোচনা কর


প্রশ্নঃ ঈশ্বর সম্পর্কে নাস্তিকদের ধারণা আলোচনা কর।
অথবা, সমালোচনাসহ ঈশ্বর সম্পর্কে নাস্তিকদের ধারণা বর্ণনা কর।
অথবা, আল্লাহ সম্পর্কে নাস্তিকদের ধারণা আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ ঈশ্বর সম্পর্কে জগতের সৃষ্টিলগ্ন থেকে বিভিন্ন ধারণা বা মতবাদ বা প্রথা প্রচলিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে ধর্মীয় ধারণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ধর্মের দিক থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে ব্যাপক অর্থে দু'টি দিক রয়েছে। যথাঃ ১) আস্তিকতাবাদ ও ২) নাস্তিকতাবাদ। এ দু'টি মতবাদ ছাড়াও অজ্ঞেয়তাবাদ নামে আরেকটি মতবাদ রয়েছে। এ মতবাদের অনুসারীরা মনে করে যে, ঈশ্বর সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের কাছে সীমিত বা এটা অর্জন করা অসম্ভব। এ কারণে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তারা স্বীকার করে না, আবার অস্বীকারও করে না।

ঈশ্বর সম্পর্কে ধর্মীয় ধারণাঃ বিশ্বজগতের প্রত্যেকটি ধর্মই ঈশ্বরকেন্দ্রিক। তাই ঈশ্বর-সম্পর্কিত ধারণা প্রতিটি ধর্মের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম ও ঈশ্বরের সম্পর্ক পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এদের যেকোনো একটি বাদ দিলে অপরটি অর্থশূন্য হয়ে যায়। এদের একটির অস্তিত্ব অন্যটির ওপর নির্ভর করে। ধর্মের দিক থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যেসব মতবাদ রয়েছে তন্মধ্যে আস্তিকবাদ ও নাস্তিকবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে এ মতবাদদ্বয়ের পরিচয় তুলে ধরা হলোঃ 

(ক) আস্তিকবাদঃ
ধর্মের দিক থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হচ্ছে আস্তিকবাদ। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আস্তিকবাদের অনুসারী। আস্তিকবাদের অনুসারীদের আবার তিনটি ভাগ রয়েছে। যথাঃ বহু-ঈশ্বরবাদ, দ্বি-ঈশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদ। নিম্নে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ 

(১) বহু ঈশ্বরবাদঃ প্রাগৈতিহাসিক যুগ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আদি মানুষ বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির পেছনে বহু অতীন্দ্রিয় দেবতা আছে বলে বিশ্বাস করত। প্রাচীন গ্রিস, মিসর ও ভারতবর্ষে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। প্রকৃতিতে যখনই কোনো বিপর্যয় দেখা দিতো তখনই তারা এসব অতীন্দ্রিয় শক্তিকে দেবতা ভেবে  পূজা করত। তখন প্রকৃতির বিভিন্ন কার্যক্রম দেবতাগণ ভাগ করে পরিচালনা করে বলে মনে করা হতো। অর্থাৎ এরা শুধুমাত্র নিজ নিজ বিভাগের সকল কিছু করে থাকে বলে মনে করা হত। এসব দেবতার মধ্যে রয়েছে- সূর্য দেবতা, সমুদ্র দেবতা প্রভৃতি।

(২) দ্বি-ঈশ্বরবাদঃ ইতিহাসের ক্রমধারায় বহু ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ বহু ঈশ্বরবাদের ওপর দ্বি-ঈশ্বরবাদকে প্রাধান্য দিতে থাকে। এ মতবাদ অনুসারে একই ঈশ্বর একই সাথে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, কল্যাণ-অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারেন না। আর তাই শুভ, কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য একজন ঈশ্বর এবং অকল্যাণ, অশুভ ও অমঙ্গলের জন্য আরেকজন ঈশ্বররের অস্তিত্ব রয়েছে। এই দ্বি-ঈশ্বরবাদীরা দু'টি সত্তা অর্থাৎ শিব ও অশিববাদেবিশ্বাসী।

(৩) একেশ্বরবাদঃ ধর্মীয় ইতিহাস বিকাশের সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে একেশ্বরবাদ। একেশ্বরবাদ বহুদেবতা ও দ্বি-ঈশ্বরবাদের ভুল ধারণা ভাঙিয়ে মানুষকে এক ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করতে সফল হয়েছে। এ মতবাদ অনুসারে ঈশ্বরই সর্বশক্তিমান এবং তিনিই জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। তিনি অসৃষ্ট, অনন্ত ও শাশ্বত। এ মতই বিধৃত হয়েছে কুরআনে। সুরা ইখলাসে বলা হয়েছে, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। সবকিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক তিনি। তিনি বিশ্বের সবকিছু প্রতিপালন, পরিপোষণ ও পরিচালনা করেন এবং আল্লাহর কোনো সমকক্ষ ও শরিক নেই।

(খ) নাস্তিকতাবাদঃ
নাস্তিকবাদ অনুযায়ী এ জগৎ সৃষ্টির পেছনে বহু, দুই কিংবা এক- কোনো স্রষ্টারই হাত নেই।  এই জগত জাতি ও জড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং কালের পরিক্রমায় বিবর্তনের ধারায় এটি বর্তমান রূপ লাভ করেছে। নাস্তিক্যবাদীরা জড়বাদের সমর্থক। তাই এ মতবাদ অনুযায়ী, প্রত্যক্ষণই ভাব লাভের একমাত্র উৎস। যা প্রত্যয়নযোগ্য নয়, তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। এই নাস্তিকবাদের আবার নানান রূপ রয়েছে।

যেমন, নির্বিকার বা গোড়া নাস্তিকবাদ, সংশয়মূলক নাস্তিকবাদ, বিচারমূলক নাস্তিকবাদ, ব্যবহারিক নাস্তিকবাদ ইত্যাদি। এরা প্রত্যেকেই ঈশ্বরকে অস্বীকার করে। তাদের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে যেহেতু প্রত্যয়নযোগ্য কোনো যুক্তি নেই, তাই ঈশ্বর বলতে কিছু নেই।

সমালোচনাঃ
নাস্তিকবাদ ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না ঠিকই, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব যে নেই, তারা তার কোনো প্রমাণ দিতে পারে না। তা ছাড়া নাস্তিকবাদ জড়বাদের একটি রূপমাত্র। তাই জড়বাদের ন্যায় এ মতবাদও বিভিন্ন দোষে দুষ্ট। জড়বাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রত্যক্ষণ প্রমাণ। কেননা তারা জ্ঞানলাভের প্রমাণ হিসাবে প্রত্যক্ষকে স্বীকার করে। এই বৈশিষ্ট্যর কারণে নাস্তিকবাদও এই বিশ্বজগতের ঐক্য, শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্য, নৈতিক ও ধর্মীয় অনুভূতি ইত্যাদির কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আর তাই নাস্তিক মতবাদ কোন সন্তোষজনক মতবাদ নয়। এ মত পোষণের ফলে মানুষের মনের মধ্যে সংশয়, দ্বিধা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মীয় দিক থেকে মানুষের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে যে ধারণাগুলো উপস্থিত রয়েছে, সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং অনেক ভ্রান্ত ধারণা ঈশ্বরের ওপর আরোপ করা হয়। তবে ধর্মীয়ভাবে একেশ্বরবাদ মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত। কেননা প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরিক নেই। এই বিশ্বজগত প্রতিনিয়ত তার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রকৃতিতে যে অঘোষিত নির্দেশ ও নিয়ন্ত্ৰণ দেখাতে পাই, তা ঈশ্বরের একক স্বত্বার বহিঃপ্রকাশ। যদি ঈশ্বর একের অধিক থাকত, তাহলে এই নিয়মশৃঙ্খলার অস্তিত্ব টিকে থাকত না৷ প্রকৃতির অনিয়ম ও সংঘর্ষ লেগে থাকত। আর তাই সাধারণ মানুষ ও ধর্ম বিশ্বাবাসীরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এবং তারই আরাধনা করে। সুতরাং মানব জীবনে ঈশ্বরের ধারণার গুরুত্ব অপরিসীম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক