আইনগত অনুমান ও আইনগত কল্পনার মধ্যে পার্থক্য কর


প্রশ্নঃ উদাহরণসহ আইনগত অনুমান ও আইনগত কল্পনার মধ্যে পার্থক্য কর। ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করে আইন ও ন্যায়পরতার একটি তুলনামূলক আলোচনা কর। 

উত্তরঃ আইনগত অনুমানঃ বিপরীত মর্মে কোন সাক্ষ্য না থাকলে কতিপয় ক্ষেত্রে আইন সেটা সত্য বলে ধরে নেয়, তাকে Legal presumption বা আইনগত অনুমান বলে। যেমন৷ কোন ব্যক্তিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করলে তাকে দোষী বলা যায়। দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলে ধরে নেয়া হয়। কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ক্রমাগত ৭ বছর খোঁজ-খবর না পাওয়া গেলে সে ব্যক্তি জীবিত নেই বলে ধরে নেয়া হয়। সরকারি গেজেটে কোন নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে তা উপযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা হয়ে থাকে কিংবা না-ও হয়ে থাকে, এগুলো হচ্ছে আইনগত অনুমান।

আইনগত অনুমান দু'ধরনের হতে পারেঃ আইন সম্পর্কে অনুমান ও ঘটনা বা তথ্য সম্পর্কে অনুমান৷ আইন সম্পর্কে অনুমান আবার দু'ধরনের হতে পারে; যথা৷ চূড়ান্ত এবং খন্ডনযোগ্য। বিবাহ বলবৎ থাকা অবস্থায় কোন শিশুর জন্ম হলে সে উক্ত দম্পত্তির বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা চূড়ান্ত এবং এটাকে খন্ডন করার জন্য কোন সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। ৯ বছরের কম কোন বালক বা বালিকা কোন ফৌজদারী অপরাধ করতে পারে না বলে আইনের অনুমান এবং সেটাই চূড়ান্ত। কোম্পানীর রেজিস্ট্রার যদি কোন কোম্পানী সম্পর্কে সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকে তাহলে চূড়ান্তভাবে ধরে নেয়া হবে যে কোম্পানী আইন অনুযায়ী নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় শর্তাদি পূরণ করা হয়েছে।

খন্ডনযোগ্য অনুমান হচ্ছে,যে কোন একটি বিষয় আদালত সত্য বলে ধরে নিবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে খন্ডন করা না হয়। যেমন৷ কোন ব্যক্তি আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও তাকে নিরপরাধ বলে ধরে নেয়া হয়। এমতাবস্থায় অভিযোগকারী যদি তার দোষ প্রমাণ করতে পারে, তাহলে নিরপরাধ বলে ধরে নেয়ার অনুমানটি আর টিকবে না। সাক্ষ্য আইনের ৭৯ হতে ৮৯, ১০৫, ১০৭ হতে ১২১ ধারাসমূহে খন্ডনযোগ্য আইনগত অনুমান এবং ৪১ ও ১১২ ধারায় চূড়ান্ত আইনগত অনুমানের বিধান রয়েছে।

আইনগত কল্পনা (Legal Fiction): স্যার হেনরী মেইন-এর মতে, আইনের শাসন পরিবর্তিত হয়েছে যদিও আক্ষরিক অর্থে তা অপরিবর্তিত রয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োগ পরিবর্তিত হয়েছে এরূপ কোন ঘটনা গোপন করা বা গোপনের প্রবণতা সম্পর্কিত ধারণা হচ্ছে ‘কল্পনা’। (Any assumption which conceals or tends to conceal the fact that the rule of law had undergone any alteration, it letter remaining unchanged but its operation being modified). স্যামন্ডের মতে, এটা হচ্ছে একটা উদ্ভাবন যদ্বারা আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করা হয়, এর জন্য যথার্থ কারণ থাকুক বা না-ই থাকুক। দত্তকের মাধ্যমে এক পরিবারে কোন শিশুকে অন্য পরিবারে গ্রহণ করা হয়। আইনগত কল্পনার মাধ্যমেই এটা করা হয়। একটি নিবন্ধিত কোম্পানী আইনের দৃষ্টি একটা আইনগত ব্যক্তি যা ঐ কোম্পানীর সদস্য হতে স্বতন্ত্র। আইনগত কল্পনার মাধ্যমেই এটা করা হয়েছে। গঠনমূলক ট্রাস্ট, গঠনমূলক দখল সবই আইনগত কল্পনার ফলস্বরূপ।

আইনগত অনুমান ও আইনগত কল্পনার মধ্যে পার্থক্যঃ

প্রথমতঃ আইনগত অনুমান সাক্ষ্য আইনের বিষয়, কিন্তু আইনগত কল্পনা আইনের একটা বিশেষ দিক যা আইনের উৎস বা আইন সম্প্রসারণের সাথে যুক্ত।

দ্বিতীয়তঃ প্রাচীনকালে বিশেষ করে রোমান আইনে আইনগত কল্পনার খুব প্রচলন ছিল। বর্তমানে এর প্রয়োজন এতো না হলেও আইন জগত হতে এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়নি। আইন প্রণয়ন দ্বারা আইনগত কল্পনার প্রয়োজন মেটানো যায় ৷

আইনগত অনুমানের প্রথা প্রয়োগ সর্বকালেই ছিল এবং এখনো আছে। বিধিবদ্ধ আইনেও এটা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আইনগত অনুমান থাকলে সাক্ষ্যের অভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা দূরূহ হতো।

ইকুইটি কিঃ ইকুইটি শব্দের অর্থ হচ্ছে ন্যায়পরতা বা পক্ষপাতহীনতা (Fairness)। কিন্তু আইনের ক্ষেত্রে এর অর্থের চেয়ে উৎস হিসেবে ঐতিহাসিক দিকের প্রতি প্রাধ্যান্য বেশী দেয়া হয়। ইংল্যান্ডের আদি আইন ছিল কমন ল' যা সাধারণ প্রথা ও রীতি-নীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এবং কমন ল' কোর্ট দ্বারা এগুলি বিকাশ লাভ করেছিল। কিন্তু প্রকৃত বিচার এবং আইন অনুযায়ী বিচার এক নয়৷ কমন ল' বিচারকগণ আইন অনুযায়ী বিচার করতেন বিধায় এটা আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ ছিল। সুস্পষ্ট আইনের বিধান না থাকলে তাঁরা কোনরূপ প্রতিকার দিতেন না। প্রতিকার না পেয়ে জনগণ রাজার কাছে আবেদন করতেন এবং ‘রাজার বিবেকরক্ষক' হিসেবে চ্যান্সরী বিভাগ এগুলির বিচার করতেন। তারা আইন অনুযায়ী বিচার করতেন না বরং বিবেক ও নীতিবোধের দৃষ্টিতে এগুলির মূল্যায়ন করা হতো। এভাবে কমন ল' এর পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে ন্যায়বিচার ও সুবিবেচনার নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে যা ১৮৭৩ সালে জুডিকেচার এ্যাক্ট পাশ হবার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ নীতিগুলিই হচ্ছে ইকুইটির নীতি এবং এগুলির উপর ভিত্তি করে চ্যান্সেলরগণ বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন।

তিনটি ধারণার উপর ইকুইটি ভিত্তিশীল। প্রথমত, নৈতিকতা ও ন্যায়পরতা, দ্বিতীয়ত, সাধারণ আইনে নাই এরূপ নীতির প্রয়োগ এবং তৃতীয়তঃ এ সকল নীতির উপর ভিত্তি করে প্রয়োগযোগ্য কতিপয় বিধিমালার প্রবর্তন।

বিশিষ্ট আইন শাস্ত্র বিশারদ স্নেল (Snell) বলেন যে, স্বাভাবিক ন্যায় বিচারের যে অংশ ইংল্যাণ্ডের কমন ল' কোর্ট প্রয়োগ করে না বিধায় ইকুইটি কোর্টকে প্রতিকারার্থে এগিয়ে আসতে হয়েছিল তাই হলো ইকুইটি।

মেটল্যাণ্ডের (Maitland) মতে, ইকুইটি বলতে ইংল্যাণ্ডের বিচার বিভাগীয় আইনের সেই সকল বিধানকে বুঝায় যা ইংল্যাণ্ডের কমন ল' কোর্টে প্রয়োগযোগ্য নয়, বিধায় ইকুইটি কোর্ট প্রয়োগ করে থাকে। (Equity now is that body of rules administered by the English courts of justice which were it not for the operation of the Judicature Acts, would be administered only by those courts which would be knows as courts of Equity.)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক