কর্ম বিভাগ এবং সমন্বয় সাধন কি? এর উপায় ও সমস্যাসমূহ আলোচনা কর


প্রশ্নঃ কর্ম বিভাগ এবং সমন্বয় সাধন কি? এর 
উপায় ও সমস্যাসমূহ আলোচনা কর। 

কর্ম বিভাগ এবং সমন্বয় সাধন (Division of Work and Co-ordination): একটি বৃহদায়তন এবং জটিল প্রশাসনিক সংগঠনের যাবতীয় সকল কাজ সম্পন্ন করবার নিমিত্ত বহু ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্তভাবে কাম্য। আর যখন বহু ব্যক্তি একত্রে কর্মে নিয়োজিত হয় তখন তারা যদি কর্ম বিভাগের নীতি (Principle of Division of Work) অনুসরণ করে তাহলে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উক্ত কর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। বস্তুত কর্ম বিভাগ হচ্ছে সংগঠনের ভিত্তি।

কর্ম বিভাগের সপক্ষে কয়েকটি বাস্তব যুক্তি রয়েছে। এগুলো নিম্নরূপঃ

১। মানুষের প্রকৃতি, কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতার দিক হতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এবং তারা কর্ম-বিশেষীকরণের মাধ্যমে অধিকতর দক্ষতা অর্জন করে;

২। একই ব্যক্তি একই সময়ে দু'টি ভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে পারে না, এবং

৩। জ্ঞানের ও দক্ষতার পরিধি এতই ব্যাপক যে, কোন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সে জ্ঞান ও দক্ষতার অতি ক্ষুদ্র অংশের বেশি জানতে পারে না।

উদাহরণঃ একটি উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যাবে। একটি সাইকেল কারখানার কথা ধরা যাক। যেখানে সর্বমোট পাঁচশত কর্মচারী এবং তারা প্রত্যেকে একটি সাইকেল তৈরি করার কাজে নিয়োজিত। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মচারী প্রথমত তার মেটাল কাটবে, ফ্রেম তৈরি করবে, চাকা লাগাবে, টায়ার এবং টিউব লাগাবে, সাইকেলে সিট, ব্রেক লাগাবে এবং পরিশেষে তাকে একটি কাঠের বাক্সে প্যাক করবে। এ কাজ সম্পন্ন করতে প্রত্যেকের পক্ষে হয়ত কয়েকদিন সময় লেগে যাবে। কিন্তু এ কাজটিই আবার অন্যভাবে অধিকতর সহজে এবং অল্প সময়ে করা যেতে পারে। আর তা হচ্ছে উক্ত পাঁচশত কর্মচারীর মধ্যে কাজটিকে এমনভাবে ভাগ করে দেয়া যাতে একদল মেটাল কাটবে, অন্য দল কেবল ফ্রেম তৈরি করবে, অন্য একটি দল ঢাকা এবং টায়ার-টিউব লাগাবে, অপর একটি দল ব্রেক, সিট প্রভৃতির ব্যবস্থা করবে এবং অপর একটি দল কেবল তাদের বাক্সবন্দি করবে । এ শেষোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করলে দু'টি প্রধান সুফল লাভ করা যায় । প্রথমত, এ কর্মচারীদের দক্ষতা এবং স্বাভাবিক ঝোঁক বা প্রবণতার (Aptitude) অধিকতর সদ্ব্যবহার এবং কর্ম বিশেষীকরণ নিশ্চিত করে। দ্বিতীয়ত, এ সময় এবং অর্থের অপচয় রোধ করে।

এভাবেই যে কোন বৃহদায়তন সংগঠন কর্ম বিভাগ এবং কর্ম বিশেষীকরণ নীতি দ্বারা পরিচালিত। তবে শুধু কর্মই বিভাগ হলেই চলবে না। বিভক্ত কর্মসমূহের যথাযথ সমন্বয় সাধন করাও একান্ত প্রয়োজন। সংগঠনের জন্য কর্ম বিভাগ যেমন প্রয়োজনীয় দিক তেমনি এর জন্য সমন্বয়ও একান্ত অপরিহার্য। কেননা সমন্বয় ছাড়া সংগঠনের বিভিন্ন বিভাগ এবং স্তরের বিভিন্ন প্রকার কাজের মধ্যে ঐক্য আনয়ন করা অসম্ভব। আর যে কোন সুষ্ঠু প্রশাসনিক সংগঠনের জন্য ঐক্য একান্তভাবে প্রয়োজন। লুথার গুলিক (Luther Gulick) তাই যথার্থই বলেছেন যে, “কর্ম বিভাগ যদি অপরিহার্য হয় তাহলে সমন্বয় আজ্ঞাধীন হয়ে পড়ে।” (If division of work is inescapable, co-ordination becomes mandatory.) সুষ্ঠু সমন্বয় নীতির অভাবে সময়ের অপচয় হবে। তাছাড়া কর্মচারীরা একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করবে, পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে মেতে উঠবে এবং প্রয়োজনীয় কার্য যথাসময়ে সম্পন্ন হবে না। তাই কর্মের পৃথকীকরণ যতই অধিক হবে ততই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে এবং সমন্বয়ের গুরুত্ব সে পরিমাণে বেড়ে যাবে।

সমন্বয় সাধনের উপায়সমূহঃ প্রশাসনিক সংগঠনে সমন্বয় সাধন করা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু সমন্বয় অর্জন করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। সাধারণভাবে সমন্বয় সাধন দু'টি ভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে, যেমনঃ 
(ক) আনুষ্ঠানিক উপায় বা পদ্ধতি (Formal Method) এবং 
(খ) অনানুষ্ঠানিক উপায় বা পদ্ধতি (Informal Method)

আনুষ্ঠানিক উপায়সমূহ (Formal Means): সংগঠনের সমন্বয় সাধনের আনুষ্ঠানিক উপায় বা পদ্ধতিসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

১। পরিকল্পনা (Planning): প্রশাসনিক সংগঠনে পরিকল্পনা সমন্বয় সাধনের একটি প্রকৃষ্ট উপায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সংগঠনের কর্মসূচি, কর্মচারী নিয়োগ ও পরিচালনা গৃহীত হলে প্রশাসন ব্যবস্থা উন্নত হয়ে থাকে। পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়-সীমার মধ্যে সংগঠনের পূর্ব- নির্ধারিত উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।

২। শক্তিশালী এবং সুদৃঢ় সংগঠন (Sound Organization): শক্তিশালী সংগঠন প্রশাসনিক সংগঠনে সমন্বয় অর্জনের প্রকৃষ্ট মাধ্যম। সুদৃঢ় প্রশাসনিক সংগঠনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট হতে অধস্তন কর্মকর্তাদের উপর কর্তৃত্ব এবং আদেশ প্রদানের মাধমে সমন্বয় অর্জন করা যায়৷ অধস্তন কর্মচারীগণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। অধ্যাপক এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White) বলেছেন যে, “যে সংগঠনের কর্তৃত্ব সুষ্পষ্টভাবে চিহ্নিত থাকে, যা যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী, যাতে কার্যাদি সুবোধ্য উপায়ে বণ্টিত থাকে, যাতে কর্মের দ্বিত্ব বা অধিক্রমণ না ঘটে এবং যেখানে সঠিক কর্তৃত্ব অর্পণ ঘটে, সেখানে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়।” 

উল্লেখ্য যে, সংগঠনে কর্মের সমন্বয় এবং ব্যক্তিবর্গের সমন্বয় দুই-ই ঘটে থাকে। কিন্তু ব্যক্তি সমন্বয় সর্বদাই কর্মের সমন্বয়ের পূর্বে সাধিত হয়ে থাকে। অধ্যাপক হোয়াইট (White) বলেছেন, "Sound organization itself is conductive to easy co- ordination; there is a co-ordination of jobs which precedes the co- ordination of men.

৩। সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কলাকৌশল (Organizational or Institutional Devices): সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কলাকৌশল সমন্বয় সাধনে বিশেষভাবে সহায়তা করে। এ সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কলাকৌশলসমূহের মধ্যে সম্মেলন (Convention), প্যানেল (Panel), কমিটি (Committee), সিম্পোজিয়াম, আন্তঃবিভাগীয় অধিবেশন (Inter- departmental Conference), স্টাফ ইউনিট (Staff Unit), সমন্বয় অফিসার (Co- ordination Office:) সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। প্রশাসনিক কার্যাদি আগে ছিল নিতান্ত সহজ প্রকৃতির এবং সংখ্যার দিক হতেও তারা ছিল অনেক কম। 

ফলে অধিকাংশ কার্যই প্রধান নির্বাহী কর্তা সম্পাদন করতেন। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ কাজ সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানগণ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিদের নিকট প্রেরিত হয়ে থাকে। প্রথমে মন্ত্রিগণ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করে কাজটি তাদের সচিবদের নিকট প্রেরণ করে এবং পরিশেষে মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করেন। এভাবে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী, কেবিনেট, কেবিনেট সচিবালয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকেন। 

৪। আঞ্চলিক পরিষদ ( Regional Councils): দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক এলাকাসমূহে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করার মাধ্যমে সমন্বয় অর্জন করা যেতে পারে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

৫। গৃহ-রক্ষণাবেক্ষণ কার্যাবলির কেন্দ্রীভূতকরণ (Centralization of House Keeping Srvices): প্রশাসনিক কার্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধনের অন্যতম উপায় হচ্ছে গৃহ- রক্ষণাবেক্ষণ কার্যাবলিকে কোন বিশেষ সংস্থার হাতে কেন্দ্রীভূতকরণ। ফিফনার ও প্রেসথাস (Pfiffner and Presthus) এ সম্পর্কে বলেছেন, "In administration housekeeping problems usually include supply, warehousing, the cleaning and maintenance of buildings, printing and duplicating, equipment control, central mailing, transportation, and food and telephone service." অর্থাৎ প্রশাসনের ক্ষেত্রে সাধারণত দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ, গুদাম নির্মাণ, দালানকোঠা পরিষ্কারকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মুদ্রণ ও প্রতিলিপিকরণ, সাসরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীয় ডাক সার্ভিস, পরিবহন এবং খাদ্য ও টেলিফোন সার্ভিস হাউস-কিপিং সমস্যাদির অন্তর্ভুক্ত।

 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম হুভার কমিশনের (Hoover Commission) সুপারিশ অনুযায়ী সেখানে ১৯৪৯ সালে এরূপ হাউস-কিপিং কার্যাবলি নির্বাহের জন্য জেনারেল সার্ভিসেস এডমিনিস্ট্রেশন (General Services Administration) নামক একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৮ (১) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি হিসাব এবং সকল আদালত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি হিসাব নিরীক্ষা করার দায়িত্ব মহাহিসাব-নিরীক্ষকের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

৬। পরামর্শদানকারী এজেন্সি (Advisory Agency): পরামর্শদানকারী এজেন্সির মাধ্যমেও অতি সহজেই সমন্বয় সাধন করা সম্ভব। স্টাফ এজেন্সি সর্বদাই প্রধান নির্বাহীকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সংগঠনের কর্মচারীবৃন্দের কার্যাবলির মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে থাকে।

৭। মূল উদ্দেশ্যের উপর প্রভাব বিস্তার (The Influence of Central Purpose): সংগঠনের অভ্যন্তরে এর মূল উদ্দেশ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে। এ মূল উদ্দেশ্যটি তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন সংগঠনের কর্মচারীবৃন্দ স্বেচ্ছায় পরস্পর সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। কর্মচারীগণ যদি কেবল তাদের স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হন তাহলে সেখানে সমন্বয় সাধন সম্ভব নয়। কাজেই প্রশাসকদের কর্মচারীদের এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে তারা সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যকে কিছুতেই বিসর্জন না দেন এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করেন।

৮। বিভিন্ন কমিটি (Various Committee): প্রশাসনিক সংগঠনের কার্যাবলি সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কমিটি এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রধান নির্বাহীর সভাপতিত্বে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সভা, অধস্তন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সভা এবং বিভিন্ন আন্তঃবিভাগীয় কমিটি সমন্বয় সাধনের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। উপরন্তু কিছু সংখ্যক বিশেষ সমন্বয়কারী সংস্থাকেও এ কর্মে নিয়োজিত রাখা যেতে পারে।

৯। সহজ সরল আইনের প্রবর্তন (Introduction of Simple Rules): সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য সহজ-সরল আইনের প্রবর্তন অত্যাবশ্যক। কর্মচারীদের নিকট আইন ও নিয়মকানুন সহজেই বোধগম্য হওয়া উচিত। কর্মচারীগণ যদি সংগঠনের আইন ও নিয়মাবলি সহজে বুঝতে না পারেন তাহলে সমন্বয় সাধন করা কঠিন সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

(খ) অনানুষ্ঠানিক উপায়সমূহ (Informal Means): প্রশাসন ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের আনুষ্ঠানিক উপায় বা পদ্ধতিগুলো ছাড়াও সমন্বয় সাধনের কতকগুলো অনানুষ্ঠানিক উপায় রয়েছে। প্রশাসনিক সংগঠনে সমন্বয় অর্জনের ক্ষেত্রে এ অনানুষ্ঠানিক উপায় বা পদ্ধতিগুলোও সমভাবে কার্যকর হয়ে থাকে। কর্মচারীদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদান, পারিবারিক ও প্রতিবেশীগত সম্পর্ক প্রভৃতিও সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া খেলার মাঠ, ক্লাব, রেস্তোরাঁ, ভোজ-সভা, লাইব্রেরি বা পাঠাগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক দেখাশুনা এবং আলাপ-আলোচনা ঘটিয়ে থাকে। এ পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা সমন্বয় সাধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

সমন্বয় সাধনের সমস্যাসমূহ (Problems of Co-ordination): সাম্প্রতিককালে প্রশাসনের কর্মপরিধি অতি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন প্রশাসনিক সংস্থা গঠিত হচ্ছে। একজন প্রশাসকের অধীনে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বাইরেও বহু সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ করতে হচ্ছে। এতে তার পক্ষে যথাযথ ও সুষ্ঠুভাবে সকল কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন কার্যও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয় না। অধস্তনদের নিকট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের অনীহা প্রকাশ পেলে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কতগুলো বাধা বা সমস্যার সৃষ্টি হয়।

লুথার গুলিক (Luther Gulick) সমন্বয় কার্যে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এরূপ কতকগুলো বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। বিষয়গুলো নিম্নরূপঃ

১। জনগণ ও ব্যক্তি বিশেষের ভবিষ্যৎ আচরণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা।

২। নেতার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব এবং তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংঘাতপূর্ণ ও বিভ্রান্তিমূলক ধারণা।

৩। মানুষ ও জীবন সম্পর্কে মানব জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা এবং

৪ । নতুন মতবাদ ও কর্মসূচি প্রণয়ন, গ্রহণ ও তার উন্নততর বিকাশের জন্য সুশৃঙ্খল পদ্ধতির অভাব।

সেকলার হাডসন (Seckler Hudson) লুথার গুলিক প্রদত্ত সমন্বয়ের সমস্যাবলির সাথে আরও চারটি সমস্যার সংযোজন করেছেন। এগুলো নিম্নরূপঃ

১। প্রশাসন ও সংগঠনের আয়তন ও জটিলতা;

২। ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক উপাদান;

৩। লোক প্রশাসন সম্পর্কে নেতার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাব এবং

৪। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লোক প্রশাসনের ব্যাপক বিস্তৃতি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে সমন্বয় ক্ষেত্রে কতকগুলো সমস্যা সৃষ্টি হয় যেগুলো সমন্বয়ের কাজকে বহুলাংশে সীমিত করে দেয়। নিচে সে সকল সমস্যা উল্লেখ করা হলোঃ

১। সংগঠনের আয়তন (Size of the Organization): সংগঠনের আয়তন বা আকার সমন্বয় সাধনের কাজকে সীমিত করে। ক্ষুদ্র সংগঠনের সমস্যা তেমন জটিল নয়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভিত্তি অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য প্রতিটি কর্মচারীর নিকট প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু সংগঠন যদি বৃহৎ হয় তখন এর সমস্যাদি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে। এতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভিত্তি অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠে।

২। সময় এবং অভ্যাস (Time and Habit): সংগঠনের সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে সময় ও অভ্যাস বিরাট বাধার সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে, মানুষ তার অভ্যাস দ্বারা পরিচালিত। যদি একটি সংগঠনকে ক্রমশ ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়, তাহলে এর কর্মচারীদের ধাপে ধাপে নিয়োগ করা যায় এবং সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানও করা যায়৷

৩। নিয়ন্ত্রণ পরিধি ( Span of Control): নিয়ন্ত্রণ পরিধির মাধ্যমেও সমন্বয় সাধনের কাজ সীমিত হয়ে পড়ে। সংক্ষেপে বলতে গেলে নিয়ন্ত্রণ পরিধির অর্থ এ দাঁড়ায় যে, মানুষের কর্মক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একজন তত্ত্বাবধায়ক কর্মচারী অগণিত ব্যক্তিবর্গকে তত্ত্বাবধান করতে পারে না। তার পক্ষে দক্ষতার সাথে কেবল গোটা সংখ্যক ব্যক্তিবর্গকে তদারক করা সম্ভবপর হয়। আবার নিয়ন্ত্রণ-পরিধি কর্মের প্রকৃতি এবং সংগঠনের আয়তন ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। যেখানে সংগঠনের কাজ প্রায় একই ধরনের এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, সেখানে একজন তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে অধিক সংখ্যক ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধান বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব; কিন্তু যেখানে সংগঠনের কাজগুলো ভিন্ন প্রকৃতির এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত নয় সেখানে একজন তত্ত্বাবধায়ক কেবল কয়েকজন কর্মচারীর কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন এর বেশি সম্ভব নয়।

৪। অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের প্রকৃতি (Nature of Informal Organization): সমন্বয় সাধন আবার অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের প্রকৃতি ও স্বরূপ দ্বারা সীমিত হয়ে থাকে। যে সংগঠনে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন সাধারণত আনুষ্ঠানিক সংগঠনের সাথে মিলে কার্য পরিচালনা করে। সেখানে সমন্বয় সাধনের কাজ দ্রুত ত্বরান্বিত হয়। পক্ষান্তরে, যেখানে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন আনুষ্ঠানিক সংগঠনকে অতিক্রম করে সেখানে সমন্বয় বাধাপ্রাপ্ত হয়। এভাবে সমন্বয় সাধনের সমস্যা এবং অকৃতকার্যতা অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের প্রকৃতি এবং স্বরূপের উপর বহুলাংশে নির্ভর করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক