আইনবিজ্ঞানের মতবাদ দ্বারা কি বুঝায়? বিভিন্ন মতবাদের বর্ণনা দাও


প্রশ্নঃ আইনবিজ্ঞানের মতবাদ দ্বারা কি বুঝায়? বিভিন্ন মতবাদের মূল ধারণা বর্ণনা কর।

উত্তরঃ সাধারণ অর্থে আইনের উৎস, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে মৌল তত্ত্বের ধারাবাহিক আলোচনা ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা হচ্ছে আইনবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু এ কার্যে আইনবিশারদগণ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন নাই। তারা নিজ নিজ ধারণা ও মতাদর্শের দৃষ্টিতে এগুলি ব্যক্ত করেছেন। তাই সকলের গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কের ঊর্ধে কোন সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভবপর হয় নাই৷ আইনবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত মতামতগুলি শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে এবং এগুলিকেই আইনবিজ্ঞানের মতবাদ বলে। এই মতবাদগুলি প্রধানতঃ নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্তঃ 

(১) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ (Analytical School) 
(২) ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School) 
(৩) নৈতিক মতবাদ (Ethical School) 

এগুলি ছাড়াও নিম্নোক্ত তিনটি মতবাদ পরিলক্ষিত হয়ঃ 

(১) সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (Sociological School) 
(২) দার্শনিক মতবাদ (Philosophical School) 
(৩) তুলনামূলক মতবাদ (Comparative School)

১। বিশেষণমূলক মতবাদ (Analytical School): এ মতবাদ প্রচলিত আইনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই মতবাদ আইনের আদর্শসমূহ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না বরং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত আইনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে আইনের কার্যকারিতা যথার্থভাবে এবং নিশ্চিতভাবে বলবৎ করাই হলো এর মূখ্য উদ্দেশ্য।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনবিজ্ঞানী স্যার জন অস্টিন (Austin) এই মতবাদের প্রধান উদ্দ্যোক্তা। এ ছাড়া বেনথাম, স্যামণ্ড এবং এ্যালেনও এই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা। অস্টিনের মতে, ইহা বিশ্লেষণমূলক; স্যামণ্ডের মতে, ইহা সুনিশ্চিত আইনের মতবাদ; এ্যালেনের মতে, ইহা অবশ্য পালনীয় মতবাদ এবং বেনথাম ও হার্ট এই মতবাদকে পজিটিভিজম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পজিটিভিজমের অর্থ এইভাবে বর্ণনা করা হয়ঃ (১) আইন আদেশ বিশেষ, (২) আইনগত ধারণাসমূহ সমাজতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন উপায়ে বিশ্লেষণ করা উচিত, (৩) সামাজিক উদ্দেশ্য, নীতি বা নৈতিকতার প্রসঙ্গে না গিয়েও পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম কানুন থেকে সিদ্ধান্তগুলি অনুমান করে নেয়া যায়। (৪) যুক্তি বা প্রমাণের সাহায্যে নৈতিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা যা সমর্থন করা যায় না। (৫) যা আইন হওয়া উচিত তা হতে বাস্তবে নির্দেশিত আইনকে পৃথক রাখতে হবে।

ধীরে আইনের গবেষণামূলক ব্যাখ্যার জন্য বিশ্লেষণমূলক মতবাদের অস্তিত্ব অপরিহার্য। বিশেষভাবে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে এই মতবাদের প্রয়োজন অত্যাধিক বলে প্রমাণিত হয়েছেঃ 

(ক) রাষ্ট্রীয় আইনের (Civil law) সুস্পষ্ট ধারণা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা।

(খ) সিভিল ল' বা রাষ্ট্রীয় আইন ও অন্যান্য আইনের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণের ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা।

(গ) প্রশাসনিক বিচার ব্যবস্থা, সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় ধারণার উপর বিশ্লেষণ করা। 

(ঘ) সিভিল ল' এর উৎসগুলি সম্পর্কে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা।

(ঙ) দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের সূত্রগুলি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা।

(চ) আইনের ব্যবস্থাপনাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তদন্ত করা। 

২। ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School): স্বাা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে জার্মানীতে সর্ব প্রথম আইন-বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক মতবাদের উদ্ভব ঘটে। জার্মান আইন-বিজ্ঞানী স্যাভাইনি এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। হেনরী মেইন (Henry Main-এর মতে মন্টেস্কু (Montes Quien) এই মতবাদের প্রথম প্রবক্তা। এই মতবাদ অনুসারে একটি জাতির অতীত ইতিহাস হতে তার আইনের মূল বিষয়বস্তু গৃহীত হয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মধারার সাথে আইন অলংঘনীয় নিয়মে গ্রথিত। কিরূপে সামাজিক আচরণের নিয়ন্ত্রণবিধি ক্রম-বিবর্তনের ধারায় আইনের অনুশাসন দ্বারা আদিকাল হতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে এবং কিরূপে বিভিন্ন অবস্থায় তা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপে বিকাশ লাভ করেছে, সেগুলি অনুসন্ধান করাই ঐতিহাসিক মতবাদের লক্ষ্য। 

ঐতিহাসিক মতবাদের মাধ্যমে আইনের বর্তমান ধ্যান- ধারাণার সহিত অতীতের ধ্যান-ধারণার তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভব। এইভাবে আইনের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা যায়। সেভাইনি আইনবিজ্ঞানকে ডারউইনের জীবনতত্ত্বের সহিত তুলনা করেন। এই কারণে তাকে ‘আইনবিজ্ঞানের ডারউইন' বলা হয়।

৩। নৈতিক মতবাদ ( Ethical School): নৈতিক মতবাদ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন বিশেষ আইন কি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রণীত হয়েছে তা অনুসন্ধান করে এই মতবাদ। সামাজিক মঙ্গলই হচ্ছে আইনের লক্ষ্য। তাই রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে আইন প্রয়োগ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই হচ্ছে আইনের উদ্দেশ্য এই মতবাদে বিশ্বাসী আইনবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, নীতিগতভাবে আইনের যে সকল ত্রুটি রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতঃ এর অসম্পূর্ণতা দূর করা হচ্ছে এর উদ্দেশ্য । মোটের উপর আইনের নীতিগত আদর্শ কিরূপ হওয়া উচিত, নির্ধারণ করাই এই মতবাদের উদ্দেশ্য। মানুষ স্বভাবসুন্দর সামাজিক জীব। তাই যা সুন্দর ও মঙ্গলজনক তাই সে গ্রহণ করে এবং অসুন্দর ও অমঙ্গলজনক বস্তুকে সে পরিহার করে। এরিস্টেটলের মতে, মানুষ যে সকল অলিখিত রীতিনীতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে অনুসরণ করে তা হচ্ছে নৈতিকতাসম্পন্ন সার্বজনীন আইন। কেউ কেউ একে . দার্শনিক মতবাদ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন।

(৪) সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (Sociological School): আইনের প্রকৃত সার্থকতা সামাজিক শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সাধন। সামাজিক এ স্বার্থ সংরক্ষণে সুচিন্তিত বিধি বিধান সৃষ্টি এই মতবাদের লক্ষ্য ব্যক্তিস্বার্থের সহিত সমষ্টিগত স্বার্থের সমন্বয় সাধন করার আইনগত কৌশল উদ্ভাবনের পর্যালোচনা করা আইনবিজ্ঞানের কাজ। কোন্ সমাজে কোন্ আইন কিভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে, আইনবিজ্ঞান তা পর্যালোচনা করতঃ সঠিক ও সুষ্ঠু কৌশল প্রদান করে থাকে, যে সকল আইনবিজ্ঞানী সমাজতান্ত্রিক মতবাদে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তন্মধ্যে জার্মান আইনবিজ্ঞানী রুডলক ভন আইহেরিং, ডওইট, এরলিচ এবং মার্কিন আইনবিজ্ঞানী ডীন রস্কো পাউণ্ডের নাম উল্লেখযোগ্য।

আইহেরিং এর মতে, সমাজের প্রয়োজনে আইন হলো একটি হাতিয়ার স্বরূপ। তার মতে আইন হলো সমাজ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার এবং উদ্দেশ্য সাধনের উপায়। ব্যক্তিস্বার্থের সহিত গণস্বার্থের সমন্বয় সাধন করতঃ সামাজিক ভারসাম্য বিধান করাও আইনের কাজ।

ডওইট বলেন যে, সামাজিক তথ্য ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মতে, আইন মানুষকে সাধারণ প্রয়োজন পূরণের জন্য সহায়তা করে । তার মতে ব্যক্তিস্বার্থের সাথে গণস্বার্থের কোন বিরোধ নেই, একে অন্যের সম্পূরক মাত্র ৷

এরলিচ বলেন যে, আইন প্রণয়ন পদ্ধতি অথবা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত আইন উন্নয়নের পন্থা নয়। আইনের সঠিক ভিত্তি নির্ণয় করতে হলে সামাজিক তথ্যগুলি পর্যালোচনা করা অপরিহার্য। তার মতে, বিধিবদ্ধ আইন এবং বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত সমাজের প্রচলিত আইনের প্রামাণ্য দলিল।

ডীন রস্কো পাউণ্ডের মতে, আইন কোন পূর্ব নির্ধারিত আদর্শমূলক বিধির সংকলন নয়। ইহা একটি বস্তুনিষ্ঠ সমাজভিত্তিক উদ্দেশ্যমূলক তথ্য। সামাজিক সমস্যার অন্বেষণ ও সমাধানের মধ্যেই আইনের সার্থকতা নিহিত।

ও পাউণ্ডের মতে, সামাজিক সুবিচার ব্যতীত আইনের অন্য গুণগত আদর্শ নাই। সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করাই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে আইন প্রণয়নের নীতি গ্রহণ করাই সমাজতান্ত্রিক মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। 

(৫) দার্শনিক মতবাদ (Philosophical School): দার্শনিক মতবাদের ভিত্তি হলো প্রকৃতি, ধর্ম এবং বিবেক। প্রাকৃতিক, নৈতিক বা অধিবিদ্যা— এই তিন ধ্রুনের অনুশাসন দ্বারা মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রাকৃতিক জগতের কোন অনিয়মের কারণে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, তেমনি মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম বা বিবেক বিরুদ্ধ আচরণের ফলে সামাজিক অনাচার ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। গ্রীক দার্শনিকগণ তাই প্রকৃতিকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। 

গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টোটল আইনকে দুইভাগে ভাগ করেছেন— সার্বজননীয় ও সুনির্দিষ্ট। তার মতে, মানুষ যে সকল অলিখিতি নিয়মকানুন বা রীতিনীতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে অনুসরণ করে তা হচ্ছে সার্বজনীন আইন। ইহা স্বয়ংক্রিয় প্রাকৃতিক বিধিসম্মত। অপরপক্ষে, সমাজ বা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আচরণ বিধিকে সুনির্দিষ্ট আইন বলা হয়। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং আইন সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়—এই অনুশাসন প্রাকৃতিক আইন হতে উদ্ভূত। 

(৬) তুলনামূলক মতবাদ (Comparative School): আইনবিজ্ঞানের তুলনামূলক মতবাদটি সাম্প্রতিক কালের চিন্তাধারার একটি প্রতিচ্ছবি। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয় এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ দ্বারা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি চিহ্নিত করা হয়। এ্যালেন, জেরেমি বেনথাম, হল, প্যাটারিজ ও শোলিঞ্জার এই মতবাদের সমর্থক।

জাবাসী অস্টিন তার মতবাদ বর্ণনায় রোমান, জার্মান ও ইংরেজ আইন পদ্ধতির আলোচনা করেন। সাভাইনি ঐতিহাসিক মতবাদকে সমর্থন করতে গিয়ে ফরাসী, রোমান ও জার্মান আইন পদ্ধতির উল্লেখ করেন। হল্যাণ্ডের মতে, তুলনামূলক আইনের পরিসীমা বর্ণনামূলক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।

বিভিন্ন দেশের আইন পদ্ধতির তুলনামুলক বিশ্লেষণ দ্বারা রাষ্ট্রীয় আইন পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন করা সম্ভবপর হয়। তাই বিভিন্ন আইন পদ্ধতি সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করার গুরুত্ব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কমন ল' সিভিল ল', মুসলিম ল' ও হিন্দু ল' এর মধ্যে তুলনামূলক ল’ও অধ্যয়ন করার আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা যায়৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক