“আইন বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হল কোন বিষয়ের মানবিক ও ঐশ্বরিক জ্ঞান এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিজ্ঞান।”— অভিমতটি ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ “আইন বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হল কোন বিষয়ের মানবিক ও ঐশ্বরিক জ্ঞান এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিজ্ঞান।”— অভিমতটি ব্যাখ্যা কর। ইহা পাঠ করা কি একজন পেশাদার আইনজীবীর জন্য অপরিহার্য? 

উত্তরঃ “আইনবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো কোন বিষয়ের মানবিক ও ঐশ্বরিক জ্ঞান ও ন্যায়-অন্যায়ের বিজ্ঞান”— আইনবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিখ্যাত রোমান আইনশাস্ত্রবিদ আলপিয়ান এই উক্তিটি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, "Jurisprudentia est divinarum atque humanarum rerum notitia, just atque injusti scientia" যার ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে, Jurisprudence is the knowledge of things divine and human, the science Of what is right and what is wrong. আলপিয়ানের এই উক্তির মধ্যে আইনবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। বিভিন্ন আইনবিজ্ঞানীগণ তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আইনবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধের উপর নির্ভরশীল আইনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে আইনবিজ্ঞানকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আইনবিজ্ঞান শুধু আইন জানতে সাহায্য করে না; আইন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার, গবেষণা করার এবং প্রয়োগ সম্পর্কে শিখতে সাহায্য করে। ক্রমবর্ধমান আইনবিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে মূলতঃ নিম্নোক্ত বিষয়গুলি অন্তর্ভূক্তঃ

প্রথমতঃ প্রখ্যাত আইনবিজ্ঞানী প্যাটনের মতানুসারে আইনবিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে আইনের প্রকৃতি, আইনগত প্রতিষ্ঠানগুলির প্রকৃতি, এগুলির বিকাশ এবং সমাজের সাথে এগুলির সম্পর্ক অধ্যয়ন করা। সামাজিক প্রয়োজনেই আইনের উদ্ভব এবং সামাজিক মূল্যবোধের উপরই এই আইনের ভিত্তি। কাজেই আইন যে সকল সামাজিক প্রয়োজন মেটায় তা সকল সমাজে এক নয়। কাজেই এ সকল প্রয়োজনের কোন সমাধান আইনবিজ্ঞান দেয় না বটে, তবে এ সম্পর্কে আইনের তত্ত্ব বা নীতি সম্পর্কে আইনবিজ্ঞান নির্দেশ দেয়। আইন আইনগত ধারণাসমূহ এবং সমাজ জীবনের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে আইনবিজ্ঞান।

দ্বিতীয়তঃ আইনবিজ্ঞান আইনগত ধারণাসমূহ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। অন্যায় বা অবৈধ কার্য, আইনগত ক্ষতি, অভিপ্রায়, মোটিভ, অবহেলা, মালিকানা, দখল ইত্যাদি আইনগত ধারণা বিভিন্ন আইন গ্রন্থে আলোচিত হয়। কিন্তু এগুলির উৎপত্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয় আইনবিজ্ঞানে। ব্যাকরণ যেমন ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে, আইনবিজ্ঞান আইনের মৌলিক ধারণাসমূহ বিশ্লেষণ করে আইনকে সহজতর করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘অধিকার ও কর্তব্য' সম্পর্কে যে তত্ত্বগত বিশ্লেষণ আইনবিজ্ঞান করে থাকে তার ওপর ভিত্তি করে সমাজের আইনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এ সকল আইনগত ধারণাসমুহও পরিবর্তিত হয় এবং এর উপর প্রভাব বিস্তারকারী সামাজিক উপাদানগুলি আইনবিজ্ঞানে আলোচিত হয়।

তৃতীয়তঃ আইনগত কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও কার্যকারিতা সম্পর্কেও আইনবিজ্ঞান অনুসন্ধান করে আইন প্রণয়ন, বিধিবদ্ধকরণ, বিচারের পূর্ব দৃষ্টান্ত অনুসরণ, বিচার কার্যে বস্তুনিষ্ঠ নীতি অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়ও আইন বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত।

চতুর্থতঃ ন্যায় বিচার পরিচালনার জন্য এর মূল নীতিগুলিও আইনবিজ্ঞানে আলোচিত হয়। এছাড়া আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা করা এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করে আইন বিজ্ঞান৷ 

পঞ্চমতঃ আইনের উৎস ও বিবর্তন ছাড়াও এর গবেষণামূলক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং নৈতিক বা দার্শনিক বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে আইনবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ।

আইনবিজ্ঞানের এরূপ ব্যাপক বিস্তৃত পরিধির কারণে একে সমাজ পরিচালনার প্রকৌশলগত দিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রকৌশলী যেমন তার জ্ঞানকে প্রকৌশল শাস্ত্র বিভাগে ব্যবহার করে, তেমনি আইনবিজ্ঞান একটি নিয়মতান্ত্রিক বিজ্ঞান হিসেবে আইনের বিভিন্ন দিককে বিকশিত হতে সাহায্য করে।

পেশাদার আইনজীবিদের জন্য আইনবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাঃ আইনবিজ্ঞানের কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যায় না কিন্তু আইন প্রয়োগকালে এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আইনবিজ্ঞানের প্রয়োজন হয়। তাই আইনবিজ্ঞান পাঠের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ না হলেও এর বাস্তব মূল্য অপরিসীম । এগুলি মূলতঃ নিম্নরূপঃ

প্রথমতঃ আইনের মৌলিক ধারণাসমূহ বিশ্লেষণ করে আইনবিজ্ঞান। তাই অধ্যাপক হল্যান্ড আইনবিজ্ঞানকে 'আইন শিক্ষার ব্যাকরণ' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আইনবিজ্ঞান পাঠ করলে আইনের মূল নীতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়। তাই অবৈধ কাৰ্য, আইনগত ক্ষতি, অভিপ্রায়, শাস্তি ইত্যাদি সম্পর্কে আইনবিজ্ঞান যেরূপ বিশ্লেষণ করে সেগুলি আয়ত্ব করলে একজন আইনের ছাত্র কোন আইনগত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চিত্তাকর্ষক যুক্তি প্রদর্শনের কলা কৌশল আয়ত্ব করতে পারে। কাজেই একজন সুদক্ষ আইনজীবি বা আইনবিদ হতে হলে আইনবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজন।

দ্বিতীয়তঃ সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য আইন গৃহীত হয় বা প্রণীত হয়। স্যামন্ড বলেন, “দেশের আইন কাঠোমোর উপর প্রয়োজনীয় আলোকপাত করাই হলো আইনবিজ্ঞান পাঠের মূখ্য উদ্দেশ্য।” একটি দেশের আইন সভা বা আইন প্রণেতাগণ আইনবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলির উপর ভিত্তি করে দেশের জন্য বিজ্ঞান সম্মত আইন প্রণয়নে সচেষ্ট হন। কাজেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনবিজ্ঞানের ভূমিকাই যথেষ্ট। নতুন কোন আইন প্রণীত হলে এর কার্যকারিতা কিরূপ হবে এবং ইহা কিভাবে ব্যাবত হতে পারে সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে হলে আইনবিজ্ঞান যথার্থভাবে পাঠ করতে হবে।

তৃতীয়তঃ আইনবিজ্ঞান পাঠ করে এক ব্যক্তি সচেতন নাগরিক হতে পারে। প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু সামাজিক দায়িত্ব ও অধিকার আছে। একজনের অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্যের অধিকার যেনো লংঘিত না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা দরকার। আইন বিজ্ঞান এরূপ প্রয়োজনীয় জ্ঞান দেয়। 

চতুর্থতঃ বিচার প্রশাসন আইনবিজ্ঞানের এক অন্যতম বিষয় বিধায় বিচার কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আইনবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রয়োজন। শাস্তির উদ্দেশ কি এবং বিভিন্ন প্রকার শাস্তির প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আইনবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন । একজন ভাল বিচারক হতে হলে তাকে অবশ্যই একজন ভাল আইন বিজ্ঞানী হতে হবে।

পঞ্চমতঃ এই শাস্ত্র অধ্যয়নের দ্বারা মানুষের মন আইনগত চিন্তাধারার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়। তাই আইনে গবেষণার ক্ষেত্রে আইনবিজ্ঞান যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এজন্য আইনশাস্ত্র গবেষকদের জন্য আইন বিজ্ঞান পাঠ করা অত্যাবশ্যকীয়।

ষষ্ঠতঃ আইনবিজ্ঞান যেহেতু আইনের ব্যাকরণ, চক্ষু ও অভিধান স্বরূপ। আইনে যথার্থ জ্ঞানলাভ করতে হলে প্রথমে আইনবিজ্ঞানে জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।

পরিশেষে, ইহা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আইনবিজ্ঞান শুধু যথার্থ আইনবিদ, বিচারক, আইন গবেষক এবং সচেতন নাগরিক হতে সাহায্য করে তাই নয় এই শাস্ত্র পাঠে লব্ধ জ্ঞান সমগ্র আইনগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক