প্রশ্নঃ প্রতিদানের সংজ্ঞা দাও। প্রতিদানের বিভিন্ন ধরন কি কি? এই প্রেক্ষিতে আমাদের আইন ও বৃটিশ আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?
প্রতিদানের সংজ্ঞাঃ বাংলাদেশ চুক্তি আইনের ২ (ঘ) ধারায় প্রতিদানের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে নিম্নোক্তভাবে-
প্রতিশ্রুতিদাতার ইচ্ছানুযায়ী যখন প্রতিশ্রুতিগ্রহীতা বা অন্য কেউ কোন কাজ করে থাকে কিংবা কাজ করা থেকে বিরত থেকে থাকে, অথবা কোন কাজ করে কিংবা কাজ করা হতে বিরত থেকে থাকে, অথবা কোন কাজ করার জন্য কিংবা কাজ করা হতে বিরত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন সে কাজ বা নিবৃত্তি অথবা প্রতিশ্রুতিকে প্রতিদান বলা হয়। অতএব কোন কাজ করা বা করা হতে বিরত থাকা কিংবা কাজ করার বা বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি হচ্ছে প্রতিদান।
যেমন, ‘খ' যদি 'ক' এর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা যায় তবে ‘ক’ ‘খ’ কে ৫০০.০০ টাকা প্রদানের অঙ্গীকার করে। এক্ষেত্রে 'খ' এর ঢাকা গমন ‘ক' এর অর্থ প্রদানের অঙ্গীকারের প্রতিদান। 'ক' এর অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ‘খ’ যদি ঢাকা যাওয়া হতে বিরত থাকে, তবে এই নিবৃত্তি ‘ক’ এর অঙ্গীকারের প্রতিদান। ‘ক’‘খ’কে ২০০.০০ টাকা প্রদানের অঙ্গীকার করে এই শর্তে যে, ‘খ’ যদি পরবর্তী মাসে তার ছেলেকে মোটর সাইকেল চালনা শেখানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। ‘খ’ এর প্রতিশ্রুতি 'ক' এর’ অঙ্গীকারের প্রতিদান । 'ক' ‘খ' কে ৫০০.০০ টাকা প্রদানের অঙ্গীকার করে এই শর্তে যে, আগামী নির্বাচনে ‘গ’ এর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা না চালানোর সে প্রতিশ্রুতি দেয়। ‘খ’ এরূপ নিবৃত্তি থাকার প্রতিশ্রুতি 'ক' এর অর্থ প্রদানের অঙ্গীকারের প্রতিদান।
বৃটিশ আইনে মিসা বনাম কারি মামলায় নিম্নোক্তভাবে প্রতিদানের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছেঃ এক পক্ষের কিছু অধিকার, স্বার্থ, লাভ বা মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে অথবা অপর পক্ষ কর্তৃক কিছু সংযম, ক্ষতি, ত্যাগ, দায়িত্ব গ্রহণ, স্বীকার বা ভোগ করার মাধ্যমে একটি মূল্যবান প্রতিদান গঠিত হতে পারে। অতএব কাজ, নিবৃত্তি, কাজের প্রতিশ্রুতি কিংবা নিবৃত্তির প্রতিশ্রুতি বৃটিশ আইন অনুযায়ী চুক্তির প্রতিদান হতে পারে।
চুক্তির প্রকারভেদঃ বাংলাদেশের চুক্তি আইন অনুসারে প্রতিদান তিন প্রকারের হতে পারে। যথা-
(১) অতীত প্রতিদান (Past consideration): কোন প্রতিশ্রুতি প্রদত্ত হবার পূর্বেই যদি এক পক্ষের প্রতিদান দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিশ্রুতির ঐরূপ প্রতিদানকে ‘অতীত প্রতিদান' বলা হয়। যেমন ‘ক’, ‘খ’ কে সেবা শুশ্রুষা করে তাকে রোগ মুক্ত করলো। পরে ‘খ’ ‘ক’ কে তার এরূপ সেবার জন্য ৫০০.০০ টাকা পারিশ্রমিক দানের প্রতিশ্রুতি দিল। এক্ষেত্রে 'ক' এর প্রতিদান অতীত হলেও তা বলবৎযোগ্য। বৃটিশ আইনে সাধারণত অতীত প্রতিদান গ্রাহ্য করা হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনের সাথে বৃটিশ আইনের পার্থক্য বিদ্যমান।
(২) বর্তমান বা সম্পাদিত প্রতিদান (Present or excuted consideration): যখন প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে কোন প্রতিদান সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদিত হয়, তখন তাকে সম্পাদিত বা বর্তমান প্রতিদান বলে। যেমন, ‘ক’ ‘খ' এর গাড়ীটি কেনার জন্য ১ লক্ষ টাকা প্রদান করলো। এক্ষেত্রে ‘ক' তার কার্যটি সম্পাদন করলো শুধু ‘খ’ এর কার্যটি সম্পাদিতব্য রইলো। 'ক' এর কার্যটি সম্পদিত বা বর্তমান প্রতিদান।
(৩) ভবিষ্যত বা সম্পাদিতব্য প্রতিদান (Future or executory consideration): যখন উভয় পক্ষের প্রতিদান ভবিষ্যতে দিবার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তখন তাকে ‘ভবিষ্যৎ’ বা সম্পাদিতব্য প্রতিদান বলে। যেমন, ‘ক’ খ-এর গাড়ীটি ১ মাস পরে কেনার প্রতিশ্রুতি দিল। এক্ষেত্রে 'ক' ও ‘খ’ উভয়ের প্রতিদানই আগামীতে সম্পাদিতব্য। তাই এ ধরনের প্রতিদানকে সম্পাদিতব্য বা ভবিষ্যৎ প্রতিদান বলে।
চুক্তির বিভিন্ন পদ্ধতিঃ একটি চুক্তিতে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে প্রতিদান প্রদত্ত হতে পারে-
(১) কার্য দ্বারাঃ ক যদি খ-এর ইচ্ছানুযায়ী একটা গৃহ নির্মাণ করে, তবে এই গৃহ নির্মাণ প্রতিদান হিসেবে গণ্য হবে।
(২) নিবৃত্তি দ্বারাঃ প্রতিদানের ভিত্তিতে এক পক্ষ অপর পক্ষের সহিত এই মর্মে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারেন যে, তিনি যেনো তার কাজটি করা হতে বিরত থাকেন। ক এর ৫০০.০০ টাকা প্রদানের অঙ্গীকার অনুযায়ী খ যদি ঢাকা গমন না করেন তবে তার এ ঢাকা যাওয়া হতে বিরত থাকা একটা প্রতিদান হিসেবে গণ্য হবে।
(৩) কার্যের প্রতিশ্রুতিঃ অঙ্গীকারকারী অঙ্গীকারগ্রহীতাকে কোন প্রতিদানের বিনিময়ে ভবিষ্যতে কোন কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন এবং এভাবে একটা বৈধ চুক্তি হতে পারে।
উদাহরণঃ ক, খ কে ৫০০.০০ টাকা প্রদানের অঙ্গীকার করে এ শর্তে যে, পরবর্তী মাসে খ, ক এর ছেলেকে গান শেখাবে। গান শেখানোর প্রতিশ্রুতি ক এর প্রতিশ্রুতি ক এর জন্য চুক্তির প্রতিদান হতে পারে।
(৪) নিবৃত্তির প্রতিশ্রুতিঃ কোন একটি বিশেষ কার্য করা হতে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও চুক্তির প্রতিদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।
উদাহরণঃ ক, খ কে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যদি ক তার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি না করে, তবে তাকে ১০ হাজার টাকা দিবে। সম্পত্তি বিক্রয় করা হতে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও একটা বৈধ প্রতিদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বৃটিশ আইনের সাথে বাংলাদেশ আইনের পার্থক্য (Distinction between English law and Bangladesh law): প্রতিদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনের সাথে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলি বিদ্যমান-
(১) বাংলাদেশের আইনে অতীত প্রতিদানও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বৃটিশ আইনে তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া অতীত প্রতিদান সাধারণতঃ গ্রহণযোগ্য নয়৷ ব্যতিক্রমগুলি নিম্নরূপ-
(ক) প্রতিশ্রুতিদাতার ইচ্ছানুযায়ী যদি অতীত প্রতিদান কার্যকর করা হয়ে থাকে তবে তা পরবর্তী প্রতিশ্রুতির সৃষ্টি করবে।
(খ) যখন এক ব্যক্তির বৈধ কর্তব্য অপর ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে করে থাকে এবং প্রথমোক্ত ব্যক্তি সেজন্য অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার করে থাকে, তবে সে অঙ্গীকার অবশ্য পালনীয়।
(গ) সময় দ্বারা তামাদি ঋণ যদি কোন ঋণগ্রহীতা পরবর্তী অঙ্গীকার দ্বারা পুররুজ্জীবিত করে তবে তা বলবৎযোগ্য ।
(২) বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি গ্রহীতা ছাড়াও অপর যে কোন ব্যক্তির নিকট হতে প্রতিদান প্রদত্ত হতে পারে।
কিন্তু বৃটিশ আইন অনুসারে প্রতিশ্রুতিগ্রহীতা ছাড়া অপর কোন ব্যক্তির নিকট হতে প্রতিদান প্রদত্ত হলে তা অবাস্তব হয় এবং গ্রহণযোগ্য হয় না।
(৩) বাংলাদেশের চুক্তি আইনের ২৫ ধারা মতে নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে প্রতিদান ছাড়াও চুক্তি হতে পারে-
(ক) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিগণ স্বাভাবিক স্নেহ প্রীতির কারণে প্রতিদান ব্যতিরেকেই চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে। তবে চুক্তি পত্রটি লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে।
(খ) কোন ব্যক্তির আইনগত কর্তব্য তার অক্ষমতার কারণে যদি অপর কেহ স্বেচ্ছায় সম্পাদন করে থাকে, তবে উক্ত কার্যের স্বীকৃতি বা মূল্য প্রদানের উদ্দেশ্যে গৃহীত চুক্তি প্রতিদান ছাড়াই বৈধ হবে।
(গ) সময় দ্বারা বাতিল কোন তামাদি ঋণ আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণরূপে পাওনাদারকে পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে ঋণগ্রহীতা বা তার প্রতিনিধি দ্বারা লিখিতভাবে ও যথাবিহীত স্বাক্ষরযুক্ত চুক্তি প্রতিদান ছাড়াই গ্রহণযোগ্য হবে।
(৪) বাংলাদেশ চুক্তি আইনের ২৩ ধারায় নিম্নবর্ণিত প্রতিদানগুলি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে-
(ক) প্রচলিত কোন আইনে নিষিদ্ধ ঘোষিত;
(খ) প্রচলিত আইনের কোন বিধানের পরিপন্থী;
(গ) প্রতারণামূলক;
(ঘ) অন্যের শরীরে বা সম্পত্তির ক্ষতিকারক;
(ঙ) নৈতিকতা বা জনস্বার্থ বিরোধী কাজ।
বৃটিশ আইনে এরূপ কোন তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। তবে বিধিবদ্ধ কোন আইন কর্তৃক বাতিল ঘোষিত ও বৃটিশ কমন ল'য়ে গণস্বার্থ বিরোধী কার্যাবলী বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি।
(৫) বাংলাদেশের আইনে অঙ্গীকারের তুলনায় প্রতিদান পর্যাপ্ত কিনা তা আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। বৃটিশ কমন ল'য়ে প্রতিদান যথেষ্ট কিনা তা বিচার্য বিষয় নয়। তবে ইকুইটি আইনে প্রতিদানের অপর্যাপ্ত প্রতারণা অনুমিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বিবাদীর ওপর প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায় যে, সে প্রতারণার আশ্রয় নেয় নাই।
(৬) বাংলাদেশের চুক্তি আইনের ৬৩ ধারা মোতাবেক পাওনাদারের সম্মতি সাপেক্ষে দেনার আংশিক দেনাদার পরিশোধ করে সমগ্র দেনার দাবী হতে অব্যাহতি পেতে পারে।
বৃটিশ আইনে আংশিক পরিশোধ সমগ্র ঋণ হতে অব্যাহতি পাওয়ার কোন বিধান লক্ষ্য করা যায় না।
0 মন্তব্যসমূহ