বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘আঁধার যুগ বা তামস যুগ' তুমি স্বীকার কর কি? |
অথবা, বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের ধারণা উদ্দেশ্যমূলক। এই মতের পক্ষে ও বিপক্ষে তথ্য ও যুক্তি দাও।
অথবা, বাংলা সাহিত্যের আঁধার যুগ বলতে কী বুঝ? আঁধার যুগতত্ত্বের উদ্ভবের কারণ কী? এ বিষয়ে তোমার মত যুক্তিযোগে প্রতিষ্ঠা কর।
অথবা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘আঁধার যুগ বা তামস যুগ' তুমি স্বীকার কর কি? যুক্তি প্রমাণযোগে তোমার স্বমত প্রতিষ্ঠিত কর।
অথবা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আঁধার যুগ-এর উদ্ভবের কারণ কী? এ রকম কোন যুগ আদৌ ছিল বলে তুমি মনে কর কি?
অথবা, বাংলা সাহিত্যে ‘অন্ধকার যুগ' বলতে কী বুঝায়? এ বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতের পরিচয় দাও।
অথবা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব কতটুকু? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব মেনে নেয়া যায় কি? আলোচনা কর।
উত্তরঃ রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ভূমি হস্তান্তরিত হয়। মুছে যায় দেশের সীমাচিহ্ন, বিলুপ্ত হয় বহু সাধনায় গড়ে ওঠা সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং পতিত হয় মহাকালের গর্ভে। তথাপি অনুসন্ধিৎসু গবেষক এবং ঐতিহাসিকগণ এই ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে লুপ্ত ইতিহাস তথা সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতির সূত্র অনুসন্ধান করে ফেরেন এবং সঠিক ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ সমগ্র সময়কে প্রাচীনযুগ (৬৫০ খ্রিঃ-১২০০ খ্রিঃ), মধ্যযুগ (১২০১ খ্রিঃ– ১৮০০ খ্রিঃ) ও আধুনিক যুগ (১৮০১ খ্রিঃ–বর্তমান যুগ) —এ তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের এই উদ্ভব, বিকাশ ও স্রোতধারা সমান্তরাল নয়। মধ্যযুগের প্রারম্ভেই প্রায় দেড়শ বছর নব প্রসূত সাহিত্যের ধারা তার গতিপথ হারিয়ে অনুৎকর্ষ মরূদ্যানে পরিণত হয়েছে। মধ্যযুগের ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দী এই সুদীর্ঘ অধ্যায়টিকে ঐতিহাসিকেরা অন্ধকার যুগ, নিষ্ফলী, প্রস্তুতি পর্ব ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য অনেক বিষয়বস্তুর সন, তারিখ বা চরিত্র বৈশিষ্ট্য বিবিধ বিষয় নিয়ে যেমন বিতর্কের অবকাশ রয়ে যায়, তেমনি ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা নিয়েও বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজী লক্ষ্মণ সেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাঙালি তুর্কি বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমান শাসন আমলের সূত্রপাত করেন (১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের দিল্লির শাসনযুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত)। এই দেড়শ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয় নি অনুমান করে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে সাময়িকভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ায় সাহিত্য চর্চা বিঘ্নিত হয়েছিল— এ সিদ্ধান্ত কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং ‘অন্ধকার যুগ' বলে স্বতন্ত্র কোন যুগের অস্তিত্ব আছে কিনা তা আলোচনার দাবি রাখে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যারা রচনা করেছেন তাদের অনেকেই তুর্কিদের আগমনকে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনের বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ক'জন বিশিষ্ট পণ্ডিতের বক্তব্য আমরা স্মরণ করতে পারি।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “১২০১ খ্রিস্টাব্দ হতে প্রায় দেড়শত বছর ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য বা জ্ঞান চর্চায় বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। এটি একটি যুগান্তরের কাল। দেশময় মারামারি, কাটাকাটি, নগর ও মন্দির ধ্বংস, অভিজাত বংশীয় পণ্ডিতদের উচ্ছেদ প্রভৃতি অরাজকতা চলছিল। এরূপ সময়ে বড়দরের সাহিত্য হওয়া সম্ভব নিয়।"
সুকুমার সেনের মতে, “তুর্কি আগমনের কালে বাঙালির বিদ্যা ও সাহিত্য চর্চার মূলে কুঠারাঘাত পড়িল।”
ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “শারীরিক বল, সমর কুশলতা ও বীভৎস হিংস্রতার দ্বারা মুসলমানেরা অমানুষিক বর্বরতার মাধ্যমে বঙ্গ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অসম যুগের সৃষ্টি করে।
শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “তুর্কিরা শুধু দেশ জয় করিয়াই সন্তুষ্ট হয় নাই, তারা বাংলার ধর্ম ও সমাজজীবনে গুরুতর আঘাত হানিয়াছিল। হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মঠ বিহারের মধ্যে একটা ব্যাপক ধ্বংস অভিযান চলিয়াছিল এবং অনেকটা এই কারণেই বোধ হয় তুর্কি বিজয়ের পর প্রায় দুই শতাব্দী ধরিয়া বাংলা সাহিত্য রচনায় আর কোন নিদর্শন মেলে না।”
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “বস্তুত মুসলমান অধিকার কাল হইতে এই সময় পর্যন্ত কোনও বাংলা সাহিত্য আমাদের হস্তগত হয় নাই। আমরা এই ১২০১ হইতে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার যুগ বলিতে পারি।”
তুর্কি আক্রমণ এবং বাংলা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সেই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে কনক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার একই মত পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য পণ্ডিতবর্গের বক্তব্যকে এক সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি তুর্কি আক্রমণ এবং এদের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা যে ধারণা করতে পারি তা হল—
১। ভুর্কিদের বাংলাদেশে আক্রমণ এবং তাদের দু'শ বছর শাসনের ইতিহাস বিপ্লব আর বিদ্রোহের ইতিহাস, দেশময় মারামারি, কাটাকাটি, নগর মন্দির ধ্বংস, অভিজাত বংশীয় পণ্ডিতদের উচ্ছেদের ইতিহাস।
২। তুর্কিদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ জুড়ে প্রতিরোধ আন্দোলন, সর্বাত্মক সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষের ফলশ্রুতিই বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ।
যদিও বক্তব্যগুলো বাংলা সাহিত্যের ক'জন পণ্ডিতের তবুও ইতিহাস আলোচনায় তাদের অভিমতগুলো কতখানি ইতিহাস নির্ভর তা বিচার করে দেখা যেতে পারে।
ক. প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব : তুর্কিদের আগমনকালে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বড় রকমের বিপ্লব বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেছিল একথা যারা বলতে চান ইতিহাসের একটি ঘটনার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তুর্কিরা যখন বাংলাদেশ আক্রমণ করেন তখন বাংলার শাসন ক্ষমতা ছিল রাজা লক্ষ্মণ সেনের হাতে। তুর্কিদের আক্রমণের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বাংলার তৎকালীন রাজা লক্ষ্মণ সেন আত্মরক্ষার্থে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে নদীয়া বিজয় সম্পন্ন করেন। এটি ঐতিহাসিক সত্যতার প্রমাণ রাখে। দেশের রাজা যখন আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে গেছেন, সেক্ষেত্রে বিদ্রোহ বিপ্লবের ধারণা একান্ত কাল্পনিক। এছাড়া লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালে রাজপরিবারের সদস্যরা কী রকম অনাচার ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলেন, তাদের কী রকম চারিত্রিক অধঃপতন ঘটেছিল সে সবের প্রমাণ মেলে তৎকালীন 'সেক শুভোদয়া' গ্রন্থের বর্ণনায়। লক্ষ্মণ সেনের সময় একদিকে যেমন সর্বশ্রেণীর মানুষের চারিত্রিক নিদর্শন পাওয়া যায়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এই হল সেন রাজাদের দ্বারা শাসিত বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক জীবন চিত্র।
খ. জাতীয় চেতনার অভাব : এরপর আসে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের কথা। সেনরা ছিলেন কর্ণাট দেশীয় ব্রাহ্মণ এবং তাদের মাতৃভাষা সংস্কৃত। বাংলাদেশ সেনদের দখলে আসার সাথে সাথে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেয়া হয় সংস্কৃত ভাষার বোঝা। নির্দেশ দেয়া হয় কেউ যদি অষ্টাদশ পুরাণ শ্রবণ করে, তাহলে সে কৈরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে। প্রত্যেক দেশে যুগে যুগে মাতৃভাষাই জাতীয় চেতনার মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু সেই উৎসে যখন সেনেরা আঘাত হেনেছে, তখন বাঙালির জাতীয় চেতনায় কোন প্রতিক্রিয়াই ঘটে নি। সুতরাং দেশের মানুষ এই শাসক শ্রেণীর নেতৃত্বে তুর্কি আক্রমণের বিরুদ্ধে বড় রকমের প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, এমনটি আশা করা যায় না। বরং সেনদের শোষণ নির্যাতন থেকে অব্যাহতি পাবার আকাঙ্ক্ষায় তৎকালীন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ তুর্কিদের আগমনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কাজেই তুর্কিদের আগমনে বাংলাদেশে বিপ্লব বিদ্রোহের কথা বলে যারা ত্রয়োদশ, চতুর্দশ শতককে বাংলা সাহিত্যের 'অন্ধকার যুগ' বলে চিহ্নিত করতে চান যুক্তির দিক থেকে তাদের সে অভিযোগ আদৌ ঠিক কিনা তা আজ নতুন করে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
গ. স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ : তুর্কিরা ছিলেন ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সেনদের শাসনকালে সাধারণ মানুষ যখন নিজেদের মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে অত্যন্ত অসহায়ভাবে দিনযাপন করছিল, তখন অনেকেই নবাগত ইসলামের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। শুধুমাত্র জোর করে তরবারির সাহায্যে তুর্কিরা এদেশে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এর কোন বাস্তব প্রমাণ নেই। সামাজিক অসাম্য, অনাদর্শ এবং শ্রেণীগত বিভেদই বর্ণ সংস্কারে জর্জরিত বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় অভিযানের অন্যতম কারণ। তুর্কিদের আগমনকে প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা না করে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজা লক্ষ্মণ সেন সদলবলে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। কাজেই তুর্কিদের আগমনকে কেন্দ্ৰ করে অত্যাচার, নির্যাতন, সংঘর্ষ, বিপ্লব, যুদ্ধ-বিগ্রহ রণক্ষেত্রের কল্পনা করে এ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে আখ্যায়িত করার পেছনে তেমন কোন ঐতিহাসিক কারণ আছে বলে আমরা মনে করতে পারি না।
বাঙালি জাতির ইতিহাস : তুর্কিদের আগমনের ফলাফল এদেশের জন্য শুভ কি অশুভ হয়েছে তা সত্যিকারভাবে বুঝতে হলে আমাদের বিচরণ করতে হবে বাঙালি জাতির ইতিহাসে। পালদের পূর্বে গুপ্ত সম্রাটদের শাসনকালে দেশে সাহিত্য চর্চা চলে মূলত সংস্কৃত ভাষায়। পাল রাজাগণ যখন বাংলাদেশে শাসন ক্ষমতা লাভ করেন, তখন থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার কিছু কিছু নিদর্শন মেলে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার যেসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সাধারণভাবে সেগুলো চর্যাপদ বলে পরিচিত।
পাল শাসকদের শেষভাগে দেশে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আত্মকলহ এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে পালবংশ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, সেই দুর্বলতার সুযোগে সেনরা এদেশের শাসন ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সেন রাজাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রচার ও প্রসার সাধন। সেনদের সময়ে সংস্কৃত ভাষা যে শুধু রাজসভার মর্যাদা লাভ করেছিল তা নয়, সংস্কৃত ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা চর্চার উপর নানা বাধা নিষেধ আরোপিত হয়েছিল। কাজেই সেনদের সময়ে আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা দেখি না। ফলে পালদের শাসনকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার যে ধারাটি অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল বহিরাগত সেনদের আমলে উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে অঙ্কুরেই তার বিলুপ্তি ঘটে। সেনরা এদেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেন পাল রাজাদের কাছ থেকে। পাল রাজারা সেনদের কাছে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিল।
লোমা তারকনাথের মতে—এ সময় বৌদ্ধগণ নাকি ইখতিয়ারের গুপ্তচরের কাজ করছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ আন্দোলনে পালরা হেরে যাওয়ায় তাদের উপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। সেনদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে পালরা প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে নেপাল তিব্বত প্রভৃতি প্রদেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে তাদের সাথে বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলোও বাংলার বাইরে চলে যায়। অধ্যাপক দেবেন্দ্রকুমার ঘোষের অভিমত যে ঐতিহাসিক তথ্যের উপর নির্ভরশীল, চর্যাপদের আবিষ্কারের ঘটনাই তার বড় প্রাণ। কাজেই তুর্কি আক্রমণের ফলে বাঙালির বিদ্যা ও সাহিত্য চর্চার মূলে কুঠারাঘাত পড়ল, সুকুমার সেনের এ মত তুর্কিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করে সেনদের প্রতি প্রয়োগ করাই যুক্তিসংগত ছিল। পালদের কঠোর সাধনায় গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যের উর্বর ভূমি সেনদের আমলে পরিচর্যার অভাবে সৃজনী শক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলে। তুর্কিরা এসে গভীর সহানুভূতির সাথে বাংলার মানুষের মৃতপ্রায় সাহিত্যকে আবার জীবন্ত করে তোলে । কাজেই ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীকে বাংলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ' না বলে তাকে ‘নবচেতনার উন্মেষকাল' বলে চিহ্নিত করাই যুক্তিসংগত হবে।
আধুনিককালের গবেষকগণ তুর্কি শাসন আমলে সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য চর্চার কিছু উদাহরণ তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে কোন উল্লেখযোগ্য বাংলা রচনা না পেয়ে তাকে ‘অন্ধকার যুগ' বলে আমরা চিহ্নিত করছি কিন্তু বসন্তরঞ্জন রায় কর্তৃক 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক চর্যাপদাবলি পুঁথিখানি পাওয়া না গেলে বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগ’ আরও কতকাল যে দীর্ঘ হত তা বলা কঠিন। ড. এনামুল হক মন্তব্য করেছেন, চর্যাপদ, ডাক, খনার বচন ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন এবং রচনাকাল তুর্কি আমলের একেবারে গোড়ার দিকে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে আরও উল্লেখযোগ্য বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টির নমুনা ‘সেক শুভোদয়ার' অন্তর্গত পীর মহাজ্ঞাপক বাংলা ‘আর্যা' অথবা 'ভাটিয়ালি রাগেন গীয়তে' নির্দেশক বাংলা গান, রামাই পণ্ডিত রচিত শূন্যপুরাণের অন্তর্গত নিরঞ্জনের রুষ্মা শীর্ষক কবিতা, এছাড়া মঙ্গলকাব্যও রয়েছে। ড. শশীভূষণ দাসগুপ্ত চা-চা গীতির বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্ধকার যুগের উপর কিছু আলোকপাত করতে পারে। এরপর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিপিকাল এবং ভাষা বিচার প্রসঙ্গে রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুনীতিবাবু একে ১৩৫০–১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত গ্রন্থ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আমরা চর্যাপদের ভাষার যে বিবর্তিত রূপ পেয়েছি, ভাষা চর্চা ছাড়া এই বিবর্তন কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একটি মূল্যবান কথা বলেছেন, “চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা দেখিয়া মনে হয়, এই দুই স্তরের মধ্যবর্তী আরও একটি ভাষা স্তর ছিল, যাহার কোন সাহিত্যিক বা ভাষাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় নাই ৷”
অন্ধকার যুগে কিছু কিছু সাহিত্য সৃষ্টির নমুনা পাওয়া গেলেও তা যথেষ্ট নয়, অন্তত এ সময়কে বঙ্গাব্দের অপবাদ থেকেই রেহাই দেয়া চলে। প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদের পরে ভাষার নতুন মডেলের জন্য অনুশীলন চলছিল এবং তখনও বাংলা ভাষা লেখ্য ভাষার স্তরে উন্নীত হয় নি। অতএব তুর্কি আমলের দেড়শ বছরের মধ্যবর্তী কালকে আমরা গবেষকদের ন্যায় ‘অন্ধকার যুগ' বলে অভিহিত করতে পারি না। তবে স্বল্প প্রাপ্যতার প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে এদেশের মানুষের চিরন্তন জীবন যাপন ব্যবস্থা, এখানকার আবহাওয়া, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা। এ প্রসঙ্গে আমরা ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মন্তব্য স্মরণ করতে পারি, “এ সময়ে মানুষ তাহার সুখ-দুঃখের কোন গান বা গাথা নিজস্ব ভাষায় একেবারেই প্রকাশ করে নাই, এমন হইতে পারে না।”
মধ্যযুগের প্রারম্ভিক সময়ের পুঁথি সংরক্ষণে মানুষ অসচেতন ছিল। কাগজ তৈরি হয় নি বলে তালপাতায় লেখা হত। আজকের মত পুঁথি সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও বিবিধ ঔষধপত্র তখন ছিল না। এদেশে আজকের তুলনায় তখন বন্যা জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেশি থাকায় অনেক পুঁথি ধ্বংস হয়েছে। ইঁদুর, উইপোকা, তেলাপোকাসহ বিভিন্ন পোকামাকড়ের হাতে ধ্বংস হয়েছে অনেক পুঁথি। সচেতনতার অভাব ছিল যার প্রমাণ গোয়ালঘর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথি উদ্ধার।
এছাড়া উক্ত সময়ের মধ্যে বিশেষ কোন গ্রন্থ যে লিখিত হয় নি তাও কি জোর করে বলা যায়? এমনও তো হতে পারে যে চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মত কোন পুঁথি আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ