'মেঘনাদবধ কাব্যে'র নায়ক কে? রাবণ, মেঘনাদ নাকি ইন্দ্রজিৎ? |
প্রশ্নঃ 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র নায়ক কে? রাবণ না মেঘনাদ— বিশ্লেষণ কর।
অথবা, মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক কে? এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণসহ তোমার অভিমত দাও৷
অথবা, কাব্যের শিরোনাম মেঘনাদবধ, কিন্তু কাব্যের সর্বত্র হয়েছে দৈব লাঞ্ছিত রাবণের অকুণ্ঠ প্রশস্তি। এ কারণে কাব্যের নায়কত্ব প্রসঙ্গে সমালোচকদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তোমার মতামত দাও৷
অথবা, ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র নায়ক কে? রাবণ না ইন্দ্রজিৎ? যুক্তিসহ তোমার অভিমত বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) ‘মেঘনাদবধ কাব্যে'র সাধারণ লক্ষণ অনুযায়ী আপাতত মেঘনাদকে এ কাব্যের নায়ক বলে মানতে হয়। মেঘনাদ বধ এ কাব্যের প্রধান ঘটনা ও বর্ণনীয় বিষয়, ফলে এ ঘটনাকে অতি উজ্জ্বল করে পাঠক চিত্তে প্রতিভাত করতে মেঘনাদকে আমাদের দৃষ্টি দিগন্তে সর্বাপেক্ষা রশ্মিমান করে তুলেছেন। এ জন্য মেঘনাদই এ কাব্যমণিমালার মধ্যমণি, তাকে সর্বৈব বিস্ময় শ্রদ্ধা ও প্রীতির যোগ্য করে তুলতে কবি ত্রুটি করেন নি।
তাছাড়া মধুসূদন তার বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন— "I am going to celebrate the death of my favourite Indrajit." মেঘনাদের হত্যাজনিত পরাজয়ের কাহিনীই মর্মান্তিক বিষাদ ও হতাশার সুরে গাইবার জন্য to celebrate the death এর জন্য কবি অধীর ছিলেন। তাই মেঘনাদ ও তার মৃত্যু এ কাব্যের অন্য সকল ঘটনা ও চরিত্র হতে পৃথক প্রাধান্য লাভ করেছে।
কিন্তু অলংকারশাস্ত্রের নির্দেশনা বাদ দিলেও নায়ক অর্থে আমরা সেই চরিত্রকে বুঝি, যার Doing ও Suffering সমগ্র কাব্যের ভিত্তি বা মূল প্রতিপাদ্যরূপে বর্ণিত হয়ে থাকে। এ কাব্যে মেঘনাদ চরিত্র ও তার দারুণ দুর্ভাগ্য প্রধান বর্ণনীয় বিষয় হলেও, সে চরিত্রের Doing ও Suffering এর কোনটাই এ কাব্যে বড় একটা স্থান করে নেই। মেঘনাদের বিশিষ্ট কীর্তি অপেক্ষা নিদারুণ অক্ষমতাই আমাদেরকে সমধিক বিচলিত করে। মেঘনাদ এ কাব্যের ভিত্তি বা ধারণ স্তম্ভ নয়, কাব্যে প্রবাহিত ঘটনা স্রোতের অল্প ক্ষেত্রই সে অধিকার করে আছে। যদিও সেটুকুতেই কবি তাকে দরদের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
মহাকাব্য মূলত নায়ক-নির্ভর। ঘটনাস্রোত, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি আবর্তিত হয় নায়ককে ঘিরেই। তাই মহাকাব্যে নায়ক স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। ‘মেঘনাদবধ' কাব্যে কার্যত তা ঘটে নি। এখানে নায়কোচিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দু'জনই। মেঘনাদ যেমন প্রিয়, রাবণ তেমনি মেঘনাদ কবির কামনাগত আদর্শ, ফলে তার চরিত্র সর্বাঙ্গসুন্দর, নির্দোষ— কবি-কামনার মোক্ষধামে তার অবস্থান। কিন্তু কাব্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাবণের ভাগ্যই একটা অবিচ্ছিন্ন ডোররূপে অনুস্যূত হয়ে আছে। রাবণের বিশাল বক্ষের ক্ষতস্থলরূপে মেঘনাদ মূর্ত হয়েছে। এ কাব্যে রাবণের দুঃখের হেতু হয়েছে মেঘনাদ। মেঘনাদ তো গেল। কিন্তু বেদনার পসরা রেখে গেল রাবণের মাথায়। ফলে মেঘনাদ এ কাব্যের নায়ক হতে পারে নি।
তাছাড়া কবির মেঘনাদপ্রীতি তথা রোমান্টিক লিরিক, এপিক অভিপ্রায়কে দ্বিধাযুক্ত করেছে। মেঘনাদকে নায়ক করতে গিয়ে মেঘনাদপ্রীতির কারণে কবি তাকে শাস্তি ভোগ থেকে বিরত রেখেছেন, ফলে Doing ও Suffering এর ভার রাবণের কাঁধে চেপেছে। সজ্ঞানে কবি মেঘনাদকে নায়ক করতে চাইলেও মেঘনাদপ্রীতির জন্য কবি মেঘনাদকে সে সুযোগ ও দায়ভার থেকে দূরে রেখেছেন।
কাব্যে যে স্তব্ধ গম্ভীর অন্ধকার তার মধ্যে রাবণকেই আমরা খুঁজে পাই। যখন মেঘনাদ নেই, এমনকি কেউ-ই নেই, তখনও রাবণ আছে, রাবণকে দিয়ে কাব্যের আরম্ভ, তাকে দিয়েই সমাপ্তি। তাছাড়া রাবণই কাব্যে সকল ঐশ্বর্যের অধিকারী। জয়-পরাজয়, কীর্তি ও অকীর্তির ফলভোগী। শত্রুর সঙ্গে সন্ধি ও বিগ্রহ সে-ই করেছে, এ কাব্যের পরিণাম, রাবণেরই পরিণাম। মেঘনাদ এই পরিণামের উপায় মাত্র। সুতরাং কবির সজ্ঞান অভিপ্রায় যা-ই হোক, মেঘনাদের জীবন যত সুন্দর ও মৃত্যু যতই করুণ হোক— এ কাব্যে সে সব উপলক্ষ মাত্র, লক্ষ্য রাবণ চরিত্র ও রাবণ ভাগ্য।
তবে এটাও ঠিক যে, রাবণ ও মেঘনাদ একই কল্পনার দুই দিক। রাবণ যা হতে পারত- সতেজ, সুস্থ, যৌবন ধনে ধনী, আনন্দ, উৎফুল্লে স্নাত, সকল কর্মফল মুক্ত- তা হয়েছে মেঘনাদ। জীবনীশক্তি মেঘনাদ অপেক্ষা রাবণের বেশি, আর বেশি বলেই রাবণ পাপী, মেঘনাদ অপাপবিদ্ধ। পূর্ণ চাঁদ ছাড়া তাতে কলঙ্ক চিহ্ন থাকে না, যা মেঘনাদের জীবনে নেই, আছে রাবণের। মেঘনাদের জীবনে বসন্ত ভিন্ন অন্য ঋতুর চিহ্ন নেই— আছে শূচিতা, সৌন্দর্য। রাবণ সকল ঋতুর ধারক। মেঘনাদ ফুল, রাবণ ফল। মেঘনাদরূপ তারুণ্যের প্রৌঢ় পরিণাম রাবণ। পিতা রাবণ, পুত্র মেঘনাদের প্রাক্তন। মেঘনাদ মৃত্যুকে বরণ করে কিন্তু ফল ভোক্তা রাবণ।
অন্যভাবে দেখলে দেখা যায়— এ কাব্যে দেবতা অপেক্ষা মানুষকে বড় করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু মানুষের অহংকারকে, অটল শক্তির দম্ভকে কবি আরতি করতে পারেন নি, বরং পরাজয়ের মধ্যে তারই অন্তরালে মানব মহিমা তুলে ধরেছেন।
রাবণ দুরাচারী দুর্দম, আপনার অভ্যন্তরে সর্বনাশের যে বীজ বপন করেছে, তারই কর্মফলে তা পরিণতিতে প্রকটিত হয়েছে। সব ধ্বংস হয়েছে। কবি রাবণকে সর্বৈব মর্যাদায় মণ্ডিত করেছেন— রাজা, পিতা, ভ্রাতা, স্বামী, যোদ্ধা ও সরল স্বভাব ভক্ত। কোথাও নীচতা ও কপটতা নেই। রাবণ পাপ করেছে, ধর্ম ও সমাজে সে পতিত, ন্যায়বিচারে, কর্মফলের অমোঘ নিয়মে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনী তাই রাবণের প্রায়শ্চিত্তের কাহিনীই বটে।
রাবণ অবিচল, অনুশোচনাহীন, অকুতোভয়। বাহুবল ও হৃদয়বলেই সে সুরক্ষিত। কিন্তু রাবণের শাস্তি অন্যরূপ। ক্রমাগত কুলক্ষয়। তাতে অন্তরের আশ্রয়ে নামে ধ্বস। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মীয় বিয়োগে জর্জরিত। পরাজয়ের সকল জ্বালা, সকল মালা তাকেই পরতে হয়। কাব্যে মধুটুকু মেঘনাদের, হলাহলটুকুর ভোক্তা রাবণ।
কাব্যে যুদ্ধ একবারই— তাও রাবণকেই সারতে হয়— পুত্র হত্যার প্রতিশোধে। যুদ্ধ লঙ্কায় নয়, রাবণের বুকের মাঝে। রাবণকেই ঘিরে রয়েছে— চিত্রাঙ্গদা, ভক্তবৃন্দ, পুত্রবধূ, পুত্র- সবাই রাবণের দীপ্তি বৃদ্ধি করেছে, আবার তারা তাকেই ম্লান করেছে।
মেঘনাদ রাবণেরই একটা বিচ্ছিন্ন অংশমাত্র। রাবণ চরিত্রের এবং তার ট্রাজেডির পরিপূরক। তার ট্রাজেডির দিককে স্পষ্ট করতে মেঘনাদের মৃত্যু। এ ঘটনা এ কাব্যের প্রধান ঘটনা, কিন্তু সমগ্র কাব্য এ ঘটনার চেয়ে যেমন বড়, তেমনি মেঘনাদ অপেক্ষা রাবণ অনেক অনেক বিস্তৃত।
তাছাড়া মেঘনাদের মৃত্যুর পরও তিন সর্গ পরিব্যাপ্ত বেদনা রাবণের বুকের উপর দিয়েই গড়িয়েছে। সর্বত্রই রাবণের সক্রিয় উপস্থিতি। মেঘনাদ প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করে নায়কোচিত গৌরব ছিনিয়ে নিতে পারে নি। সে সুযোগ পেয়েছে রাবণ। রাবণই ধীর ও সংযতচিত্তে পুত্রের মৃতদেহ রেখে জ্বালার প্রতিশোধ নিয়েছে। এ সকল নিঃসন্দিগ্ধভাবে মহাকাব্যের নায়কোচিত গুণ।
মেঘনাদ মধুসূদনের মানসপুত্র, প্রীতিপ্রতিম। ফলে মেঘনাদ এ কাব্যে মায়ের দুলাল, পিতার নয়নমণি, পত্নীর কণ্ঠহার, শত্রুর দুঃস্বপ্ন। এসব বৈশিষ্ট্য তাকে প্রিয়ভাজন করে তুলেছে— মহাকাব্যের নায়ক করে তোলে নি। সে জন্য যে সক্রিয় সংগ্রামশীলতা, দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট প্রতিরোধ শক্তি দরকার—তা ছিল রাবণের।
রাবণের উজ্জ্বলিত নাট্যশালার সব দীপ একে একে নিভে গেছে, নিজেও নির্বাপিত হবার প্রতীক্ষায়। তবুও সবকিছু রক্ষা করার প্রাণান্ত চেষ্টা। কিন্তু অসহায় ভাগ্যের কাছে অসমর্পিত মানব।
ফলে মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক মেঘনাদ নয়, রাবণই এ কাব্যের নায়কের যোগ্যতম পুরুষ।
0 মন্তব্যসমূহ