বিচার প্রশাসন কি? দেওয়ানী বিচার ও ফৌজদারী বিচারের মধ্যে পার্থক্য কি? ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিসের ব্যাখ্যা দাও


প্রশ্নঃ বিচার প্রশাসন কি? দেওয়ানী বিচার এবং ফৌজদারী বিচারের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর। উদাহরণসহ ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিসের ব্যাখ্যা দাও।

উত্তরঃ বিচার প্রশাসন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ন্যায়ের অনুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য বিচার ব্যবস্থাকে বিচার প্রশাসন বলে। প্রাচীনকালে চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত—এ ধরনের প্রতিশোধমূলক বিচার বিধান ছিল এবং সাধারণ লোকেরাই এ বিচার কার্য পরিচালনা করতো। বর্তমানে বিচার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্রই বহন করে। স্যার জন স্যামণ্ডের মতে, বিচার প্রশাসন হল, “রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে কোন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাজে বসবাসকারী নাগরিকগণের অধিকার সংরক্ষণ করা।”

আধুনিক বিচার ব্যবস্থা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত--- (১) দেওয়ানী বিচার ও (২) ফৌজদারী বিচার। দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থায় মানুষের সাধারণ ও ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য প্রতিকারের মাধ্যমে বাদীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় সামাজিক শান্তি-শৃংখলা বিঘ্নিত হবার মত অপরাধ করলে এবং অন্যের শারীরিক বা সম্পত্তির গুরুতর ক্ষতিসাধন করলে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়।

দেওয়ানি বিচার ও ফৌজদারি বিচারের মধ্যে পার্থক্যঃ দেওয়ানী বিচার ও ফৌজদারী বিচারের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

(১) ব্যক্তিগত অধিকার কিংবা আইনগত স্বত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে দেওয়ানী বিচারের মাধ্যমে অধিকার পুনর্বহাল করা হয়। অপরদিকে, গণ-অধিকার ক্ষুণ্ন করে সামাজিক শান্তি- শৃঙ্খলা বিঘ্ন করা হলে কিংবা ফৌজদারী দণ্ডবিধিতে বর্ণিত অপরাধগুলি সংঘটিত করলে ফৌজদারী বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

(২) দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা দেওয়ানী কার্যবিধি মোতাবেক পরিচালিত হয়। কিন্তু, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা ফৌজদারী কার্যবিধি মোতাবেক পরিচালিত হয়।

(৩) দেওয়ানী বিচার দ্বারা কেবল ব্যক্তি বিশেষের অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। অপরপক্ষে, ফৌজদারী বিচার দ্বারা ব্যক্তি সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় অর্থাৎ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৪) দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে অধিকার বলবৎকরণ, সম্পত্তি প্রত্যর্পণ, সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন, নিষেধাজ্ঞা বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দ্বারা প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। পক্ষান্তরে, ফৌজদারী বিচারে অপরাধের প্রকৃতি ও গুরুত্ব অনুসারে কারাদণ্ড, জরিমানা, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি ধরনের শান্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রতিকার দেয়া হয়।

(৫) দেওয়ানী বিচার দেওয়ানী আদালতে সম্পন্ন হয়। ফৌজদারী বিচার কেবলমাত্র ফৌজদারী আদালতে সম্পন্ন হয়।

(৬) দেওয়ানী আদালতের সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতের নাম মুন্সেফ আদালত বা সহকারী জজ আদালত। মামলা আনয়নকারীকে বাদী ও বিরুদ্ধ পক্ষকে বিবাদী বা প্রতিপক্ষ বলে। ফৌজদারী আদালতের সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতের নাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। মামলা আনয়নকারী পক্ষকে বাদী পক্ষ বা অভিযোগকারী এবং অপর পক্ষকে আসামী বলে।

(৭) দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে একমাত্র ক্ষতিগ্ৰস্ত পক্ষ স্বয়ং মামলা দায়ের করে। ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে সরকার বা ক্ষেত্র বিশেষে স্বয়ং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ মামলা দায়ের করে।

(৮) দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে বাদীকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয় না, কিন্তু ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকেও সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়।

(৯) দেওয়ানী বিচারে বাদীকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিবাদীকে তার দাবী প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু ফৌজদারী বিচারে একমাত্র বাদীকে প্রমাণের ভার বহন করতে হয়।

(১০) দেওয়ানী বিচারে বাদীকে তার দাবী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের কোন আবশ্যকতা নেই, কিন্তু ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে আসামীকে শাস্তি। প্রদানের ক্ষেত্রে বাদীপক্ষকে তার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামান্য সন্দেহের অবকাশ থাকলে আসামীকে শাস্তি দেয়া যায় না।

এভাবে দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়।

ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিসঃ ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস বা বন্টনযোগ্য ন্যায়বিচার হচ্ছে সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিগণের মধ্যে সুযোগ সুবিধা ও দায়- দায়িত্ব সমানভাবে বণ্টন করা। অর্থাৎ অধিকার ও কর্তব্যের সুষম বণ্টন। যেমন-প্রত্যেক নাগরিকের সমান ভোটাধিকার থাকতে হবে এবং প্রত্যেককে আইনের বিধি অনুসারে করের বোঝা বহন করতে হবে। প্রাচীনকালে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটল ছিলেন এই নীতির প্রবক্তা। দেশের নাগরিকদের মধ্যে একটা ভারসাম্য বা সুষমভাব নিশ্চিত করাই বণ্টনমূলক ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক