ভূমিকাঃ সুখবাদীরা সুখকেই নৈতিকতার মানদণ্ড এবং বুদ্ধিবাদীরা বুদ্ধিকেই নৈতিকতার মানদণ্ড বলে মনে করে। কিন্তু এ দু'টি মতবাদ এককভাবে নৈতিকতার কোনো সন্তোষজনক মতবাদ দিতে পারে না। এ কারণে এ দু'টি মতবাদ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত জীব বলে তার স্বভাব বুদ্ধিবৃত্তি ও জীববৃত্তি এ উভয় বৃত্তির দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে।
পূর্ণতাবাদঃ পূর্ণতাবাদ বা কল্যাণবাদ অনুসারে পূর্ণতালাভ বা আত্মোপলব্ধি মানব জীবনের পরম কল্যাণ। অর্থাৎ পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধিই নৈতিক মানদণ্ড। প্লেটোর মতে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারা কামনা-বাসনা জাতীয় প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমেই পূর্ণতা বা কল্যাণ আসে ৷
ব্যক্তি ও অপরাপর মানুষের কল্যাণঃ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে সুস্থভাবে বসবাস করতে হলে মানুষকে সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে পারে। সমাজবিহীন মানুষের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন অর্থহীন। সমাজই নৈতিকতা বিকাশের জন্য প্রধান শিক্ষাক্ষেত্র। সমাজে বসবাস করতে হলে ব্যক্তি মানুষকে তার নিজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, কোনো মানুষই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। প্রতিটি মানুষের তার সমাজের অপরাপর মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয়ঃ পূর্ণতাবাদের মতে, পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধি নৈতিকতার মানদণ্ড। এ মতবাদ মনে করে যে, আত্মোপলব্ধি বলতে মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশকে বোঝায় । মানুষ যেহেতু বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন জীব সেহেতু মানুষের পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি ও বিচার বুদ্ধি -এই উভয় দিকের বিচার করতে হয়। এ কথা বলার সাথে সাখে পূর্ণতাবাদ সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।
বুদ্ধিবাদ চরম মতবাদঃ অন্যদিকে বুদ্ধিবাদ বা বিচারবাদ বিচার বুদ্ধির পূর্ণতা লাভকে মানব জীবনের পরম লক্ষ্য বলে মনে করে। অর্থাৎ এ মতবাদ অনুসারে বিচার বুদ্ধিই নৈতিকতার মানদণ্ড। এ মতবাদ বিচার বুদ্ধিকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে কেবল মানুষের বিচার বুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। আর এর ফলে এ মতবাদ মানব জীবনের অনুভূতিশীল দিককে উপেক্ষা করেছে।
আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধনঃ পূর্ণতাবাদীদের মতে, আত্মোপলব্ধির অর্থই হচ্ছে বিচার বুদ্ধির দ্বারা কামনা-বাসনার নিয়ন্ত্রণ। আর বিচার বুদ্ধির এ নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে কামনা বাসনাকে বিনা বিচারে পরিবর্জন করাও নয়, আবার সেগুলোকে বিনা বিচারে চরিতার্থ করাও নয়। পূর্ণতাবাদের মতে, জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সুষম সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। বিচার বুদ্ধির দ্বারা কামনা-বাসনার মধ্যে যখন সঙ্গতি স্থাপিত হয়, তখনই আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়। যার ফলে পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধি ঘটে থাকে।
আত্মবাদ ও পরার্থবাদের মধ্যে সমন্বয়ঃ পূর্ণতাবাদ, আত্মবাদ ও পরার্থবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। আত্মবাদের মতে, মানুষের কাছে তার নিজের সুখই কাম্য এবং তা নৈতিকতার মানদণ্ড। মানব প্রকৃতির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে এ মতবাদ মনে করে যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজের সুখই কামনা করে। মন্দের তুলনায় অধিকতর ভালোই মানুষের কামনার উদ্দেশ্য। প্রতিটি মানুষ স্বভাবত স্বার্থপর। প্রতিটি মানুষ তার নিজের সুখ সব সময় অন্বেষণ করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পূর্ণতাবাদ নৈতিক অবধারণের সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। পূর্ণতাবাদ অনুসারে পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধিই মানব জীবনের পরম আদর্শ। এটি সুখবাদ, বুদ্ধিবাদ, আত্মবাদ ও পরার্থবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি ভারসাম্য পূর্ণ সমাজ গঠনের কথা বলেছেন।
প্রশ্নঃ পূর্ণতাবাদ কি? এটা কি নৈতিক মানদণ্ড সম্পর্কীয় একটি সন্তোষজনক মতবাদ?
ভূমিকাঃ সুখবাদীরা সুখকেই নৈতিকতার মানদণ্ড এবং বুদ্ধিবাদীরা বুদ্ধিকেই নৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড বলে মনে করে। কিন্তু এ দু'টি মতবাদ একই সাথে নৈতিকতার সন্তোষজনক মতবাদ হতে পারে না। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব বলে মানব স্বভাব বুদ্ধিবৃত্তি ও জীববৃত্তি। এই উভয় বৃত্তির দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে।
পূর্ণতাবাদঃ পূর্ণতাবাদ বা কল্যাণবাদ অনুসারে পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধিই নৈতিকতার মানদণ্ড। প্লেটোর মতে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারা কামনা বাসনা জাতীয় প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করলে মানুষের পূর্ণতা আসে। এরিস্টটলের মতে, সদগুণ অনুযায়ী মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই মানুষের পূর্ণতা বা কল্যাণ আসে। তিনি মনে করেন মানব জীবনের উৎকর্ষতা ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির চেয়ে বুদ্ধির উপর নির্ভর করে। আধুনিক যুগে হেগেল এবং তার অনুসারীরা পূর্ণতাবাদ নিয়ে সবিশেষ আলোচনা করেছেন।
পূর্ণতাবাদ নৈতিক মানদণ্ড সম্পর্কীয় একটি সন্তোষজনক মতবাদ কিনাঃ পূর্ণতাবাদ অনুসারে মানব জীবনে পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধিই একমাত্র কাম্য। মানুষের জীবনে কোনো কাজের নৈতিক বিচার করা হয় আত্মোপলব্ধি বা পূর্ণতারূপ নৈতিক আদর্শের দ্বারা নৈতিক মানদণ্ড সম্পর্কীয় যে কয়টি মতবাদ গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়, সেগুলোর মধ্যে পূর্ণতাবাদ অন্যতম। নৈতিক অবধারণের মানদণ্ড সম্পর্কীয় নানা রকম মতবাদ রয়েছে। যেমন সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদ। তারা যথাক্রমে সুখ ও বুদ্ধিকেই নৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড বলে মনে করে। মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে তার সম্পর্ক স্থাপন করে চলতে হয়। সে কখনো আত্মবাদী হয়ে সমাজে চলতে পারে না। মানুষকে তার নিজ চেষ্টার দ্বারা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হয়। একটি মতবাদকে তখন আদর্শ সম্পর্কীয় মতবাদ বলা যাবে যেটি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ আনয়ন করে এবং সমাজের অন্যান্য জীবের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে পূর্ণতাবাদকে একটি সন্তোষজনক মতবাদ বলা যায়।
উপসহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পূর্ণতাবাদ নৈতিক অবধারণের মানদণ্ড সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। পূর্ণতাবাদের আদর্শ হলো আত্মোপলব্ধি বা পূর্ণতা। পূর্ণতাবাদ, সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদ, আত্মবাদ ও পরার্থবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সে কারণে এর অন্তর্নিহিত মূল্য অপরিসীম।
0 মন্তব্যসমূহ