ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ হিসাবে নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদ আলোচনা কর



প্রশ্নঃ ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ হিসাবে নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদ আলোচনা কর।

অথবা, ইচ্ছার স্বাধীনতাবিষয়ক যে কোনো দুটি মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, ইচ্ছার স্বাধীনতাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

ভূমিকাঃ মানব জীবনে ইচ্ছার স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। মানব সমাজের বিচিত্র পরিবর্তনের ক্রমধারার মাঝে এক সময়ে তাদের স্বীয় ক্রিয়াকর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতা বোধ জেগে উঠে। সমষ্টির বিশ্বাস ও ব্যক্তির চিন্তাধারার মধ্যকার সংঘর্ষের ফলে ইচ্ছার স্বাধীনতার সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। ইচ্ছার স্বাধীনতা সমস্যাটি এখনো দর্শনের অঙ্গনে একটি জটিল সমস্যা। এ সমস্যাটিকে নানা দিক থেকে আলোকপাত করা হয়েছে। যেমন মনোবিজ্ঞান, নীতিবিদ্যা অর্থনীতি। এসব বিষয় থেকে প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে দার্শনিকরা ইচ্ছার স্বাধীনতাকে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন।

ইচ্ছার স্বাধীনতাবিষয়ক মতবাদ হিসাবে নিয়ন্ত্রণবাদঃ যে মতবাদ ঘটনাবলি সংঘঠনের ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় না তাকেই নিয়ন্ত্রণবাদ বলা হয়। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে যা কিছু ঘটে তা নিয়ন্ত্রিত, মানুষের ইচ্ছার কোন ভূমিকা সেখানে নেই। দার্শনিকেরা নিয়ন্ত্রণ বলতে বুঝেছেন কারণ ঘটিত। যা কিছু ঘটেছে তা পূর্ববর্তী কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

নিয়ন্ত্রণবাদের পক্ষে যুক্তিসমূহঃ নিয়ন্ত্রণবাদের পক্ষে যুক্তিসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

১. কার্যকারণ নিয়ম অনুযায়ী জাগতিক সব কার্যেরই এক বা একাধিক কারণ রয়েছে। কাজেই ইচ্ছারূপ কার্যের নিশ্চয় কারণ থাকবে।

২. মহাবিশ্বে শক্তির সর্বমোট পরিমাণ সমান, এর কোন হ্রাস বৃদ্ধি নেই। কাজেই ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়টি শক্তির নিত্যতা সূত্রের দিক থেকে সমর্থিত নয়৷

৩. জড়বাদ মস্তিষ্ককে দেহের উপবস্তু মনে করে। তাছাড়া জড়বাদ মনে করে প্রত্যেক পূর্বাবস্থা পরবর্তী অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে । জড়বাদ ইচ্ছার স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি শক্ত যুক্তি।

৪. সর্বেশ্বরবাদ অনুসারে জগৎ ঈশ্বরময়। ঈশ্বরই পরম সত্য। জগতের প্রতিটি বস্তুই ঈশ্বরের প্রকাশ। মানুষের ইচ্ছার কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই। মানুষের যাবতীয় কার্যাবলি ঈশ্বরের নির্দেশে পরিচালিত। কেননা মানুষ ঈশ্বরেরই অংশ।

নিয়ন্ত্রণবাদের সমালোচনাঃ নিয়ন্ত্রণবাদে ইচ্ছার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কথা সত্য যে আমাদের ইচ্ছা পরিবৃত্ত ও চরিত্রের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এ সত্ত্বেও মানুষ কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে কি ইচ্ছা গ্রহণ করবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ইচ্ছা একটি মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা এবং এর কারণ বলো মন নিজেই। তাছাড়া ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলেও সৃষ্টির সেরা।

স্বাধীনতার পক্ষে অনিয়ন্ত্রণবাদের যুক্তিসমূহঃ যে মতবাদ অনুযায়ী মানুষের ইচ্ছা কোন পূর্ব ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় তাই অনিয়ন্ত্রণবাদ। মানুষের কর্ম নিয়ন্ত্রিত না হলেই কেবল তাকে তার কাজের জন্য নৈতিকভাবে দায়ী করা সম্ভব অনিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে মানুষের ইচ্ছা হলো বন্ধনহীন। কিন্তু এ থেকে প্রমাণ হয় না যে মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা নেই।

অনিয়ন্ত্রণবাদের যুক্তিসমূহঃ অনিয়ন্ত্রণবাদীরা ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুক্তি প্রদান করেছেন। তা হলোঃ 

১. অদৃষ্টবাদের অসারতা এবং অনিয়ন্ত্রণবাদের মানুষ স্বাধীন মনন ক্ষমতা সাক্ষ্যবহন করে।

২. আমরা যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে আমরা স্বাধীন। আবার যখন বুঝতে পারি যে এটা ভুল হয়েছে তখন সেটারও পরিবর্তন আমরা করি।

৩. নৈতিক দায়িত্ব কর্ম ও মনন স্বাধীনতার অপরিহার্য প্রাথমিক প্রয়োজন । মানুষকে তার ক্রিয়াকলাপের জন্য আমরা স্বভাবতই সৎ বা অসৎ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। কিন্তু পছন্দ বা অপছন্দ অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা যদি তার না থাকে তাহলে মানুষকে এভাবে বিচার করার অর্থ হয় না।

অনিয়ন্ত্রণবাদের সমালোচনাঃ নৈতিক জীবনে তাৎপর্য রক্ষার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন রয়েছে এ কথা ঠিক যে স্বাধীনতা আমাদের সত্যিকারের আছে কিনা তা বিচার্য বিষয়। অনিয়ন্ত্রণবাদের যুক্তি সবার জন্য সমভাবে গ্রহণযোগ্য তা বলা যায় না। অনিয়ন্ত্রণবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের মত সঠিক যুক্তি দেখাতে পারেনি। যদি প্রাকৃতিক জগতে কার্যকারণ স্বীকার করা হয়, তাহলে ইচ্ছার বিশেষ ক্ষেত্রে একে অস্বীকার করা হয় কেন তার সদুত্তর অনিয়ন্ত্রণবাদ দিতে পারেনি।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়' যে ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ হিসাবে নিয়ন্ত্রণবাদ পুরোপুরি ত্রুটিযুক্ত নয়। মানুষের ইচ্ছাশক্তি কিছুটা প্রভাবিত এবং কিছুটা যে স্বাধীন এটা অনুধাবন করলেই বুঝা যায়। অনিয়ন্ত্রণবাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও অনিয়ন্ত্রণবাদ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে মানুষের মর্যাদা বোধকে অনেক উঁচুতে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক