লোক প্রশাসন ও অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর


প্রশ্নঃ লোক প্রশাসন ও অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর (A Comparative Study Between Public Administration and Other Social Sciences)। 

ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ বিভিন্ন ধরনের আচরণের মাধ্যমে তার জীবনের পূর্ণতা দেখতে চায়। মানুষের আচরণ আলোচনার জন্যই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞান। লোক প্রশাসন এ সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত একটি শাস্ত্র। যেহেতু প্রতিটি সমাজবিজ্ঞানই মানবীয় জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সেহেতু ধারণা হতে পারে যে, একটি সমাজবিজ্ঞানের সাথে আর একটি সমাজবিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। মূলত এ ধারণা অমূলক, কেননা এর কোন যথার্থতা নেই। প্রকৃতপক্ষে, কোন সমাজবিজ্ঞানকে সুষ্ঠুভাবে জানতে হলে অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের সাথে তার সম্পর্ক অনুধাবন করা উচিত। এক সময় ছিল যখন জ্ঞানের প্রতিটি শাখার স্বাতন্ত্র্যের গুরুত্ব আরোপ করার রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালের গর্ভে এ প্রবণতা যে মুক্ত জ্ঞানের পক্ষে মারাত্মক তা প্রমাণিত হয়েছে। এ যুগে তাই জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতার উপর জোর দেয়া হয়েছে। তাই লোক প্রশাসনের সাথে অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক বিচার করাই আমাদের প্রতিপাদ্য। 

লোক প্রশাসন ও অর্থনীতি (Public Administration and Economic): মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আলোচনাই হলো অর্থনীতি। সীমাবদ্ধ উপায়-উপকরণের দ্বারা সীমাহীন অভাব মেটানোর প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করেই মানুষের যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সৃষ্টি হয়। ধনবিজ্ঞানী অধ্যাপক মার্শাল(Marshall)-এর মতানুসারে, “মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ কার্যাবলির আলোচনাই হলো অর্থনীতি।” তাই অর্থনীতি আলোচনায় উৎপাদন, বিনিময়, ভোগ ও বণ্টন মুখ্য বিষয় হিসেবে দেখা যায়।

অ্যাডাম স্মিথ অর্থনীতিকে ‘ধনের বিজ্ঞান' (Science of Wealth) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে অর্থনীতির সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন অধ্যাপক এল. রবিনস্ (L. Robbins)। তার মতে; "Economics is a Science which studies human behaviour as a relationship between end and scarce means which have alternative uses." এ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মানুষের অভাব অসীম কিন্তু তাদের সম্পদ সসীম বা সীমিত। এ সীমিত সম্পদ দ্বারা মানুষের অফুরন্ত অভাব কিভাবে মিটান যায় অর্থনীতি তাই করে।

অন্যদিকে, লোক প্রশাসন হচ্ছে সরকারের কার্যাবলি এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জনশক্তি এবং সম্পদের সুষ্ঠু সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা। এক কথায় লোক প্রশাসনও সরকারি যা রাষ্ট্রীয় কার্য নির্বাহ করার কাজে নিয়োজিত। আর রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির মধ্যে অর্থনীতির কার্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে লোক প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। লোক প্রশাসনকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং তাদের সমাধান হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও এমনটা ছিল না। তখন রাষ্ট্র প্রধানত “মুক্ত করে দাও” (Laissez Faire) নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি ছিল নিতান্ত স্বল্প এবং পুলিশী কার্য নির্বাহই ছিল রাষ্ট্রের একমাত্র কার্য। তখন রাষ্ট্র ছিল এক প্রকার পুলিশী রাষ্ট্র (Police State)। কিন্তু শিল্প-বিপ্লব এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে রাষ্ট্র তথা সরকারি কার্যাবলির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর ফলে সরকার প্রত্যক্ষভাবে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। এভাবে রাষ্ট্র মানুষের অর্থনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে অগ্রসর হয়েছে।

তাই, বর্তমানযুগে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি বৃদ্ধি ও প্রসারের সাথে সাথে লোক প্রশাসনের গুরুত্ব যথেষ্ট পরিমাণে অনুভূত হচ্ছে। বস্তুত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক তথা যাবতীয় কার্যের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব প্রশাসকদের হাতে অর্পিত হয়েছে। প্রশাসনিক সংস্থা বর্তমানে সম্পদের উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন ও বিনিময় ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। প্রশাসকদের দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সার্বিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি প্রশাসনিক নীতিকে তার অর্থনৈতিক ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা প্রত্যেক প্রশাসন ব্যবস্থার অন্যতম ও পবিত্রতম দায়িত্ব। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি বিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রশাসনের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।

তাছাড়া লোক প্রশাসন এবং অর্থনীতির বিষয়বস্তু মূলত এক ও অভিন্ন। অর্থনীতি অবশ্যম্ভাবীরূপে একটি সীমিত সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা। এটা উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময় ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। কিভাবে এবং কি পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে, কি উৎপাদন করতে হবে, কিভাবে এবং কি পরিমাণ বণ্টন করতে হবে এবং কিভাবেই বা উৎপাদিত দ্রব্যসমূহ বিনিময় করতে হবে অর্থনীতির মাধ্যমেই তা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে লোক প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তদুপরি সরকারি অর্থ-ব্যবস্থা (Public Finance) অর্থনীতির একটি বিশেষ দিক। এটাতে কর ব্যবস্থা, সরকারি ব্যয়, সরকারি ঋণ প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা করা হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে লোক প্রশাসনেরও একটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে অর্থ প্রশাসন। অর্থ প্রশাসনে কর প্রশাসন, রাষ্ট্র প্রশাসন, হিসাব ও নিরীক্ষা প্রশাসন প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়ে থাকে। এ দিক হতে লোক প্রশাসন এবং অর্থনীতি এক ও অভিন্ন।

লোক প্রশাসনকে বিবিধ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে নিয়োজিত থাকতে হয়। এটাকে ব্যবসায় সংক্রান্ত বহু প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় এবং বেকার সমস্যার সমাধান করতে হয়। এটাকে আবার সুবিধাজনক বাণিজ্যিক ভারসাম্য এবং জাতির আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এক নতুন ধরনের প্রশাসনিক সংস্থার সৃষ্টি করেছে, আর তা হচ্ছে সরকারি কর্পোরেশন। রাষ্ট্র জনগণের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ এবং সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের কার্য গ্রহণ করছে । উপরন্তু অর্থনৈতিক এবং শিল্প ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক ও শিল্প সংক্রান্ত সিভিল সার্ভিস (Economic and Industrial Civil Service)-এর গোড়াপত্তন করছে। এ সিভিল পদ্ধতি সরকারের কার্যক্রমে বাণিজ্যিক পদ্ধতিসমূহের ব্যাপক ব্যবহার ত্বরান্বিত করছে এবং করতেছে।

সবশেষে বলা যায় যে, লোক প্রশাসন যেমন অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে প্রশাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরই প্রশাসনের সাফল্য সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। তা লোক প্রশাসন ও অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক, একটি ছাড়া অপরটির কথা আলোচনা করা সম্ভবপর নয়।

লোক প্রশাসন ও ইতিহাস (Public Administration and History): লোক প্রশাসন ও ইতিহাসের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। লোক প্রশাসন আলোচনা এবং এর বিকাশ সাধন করতে ইতিহাসের সাহায্য প্রয়োজন। অতীতকালে প্রশাসন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল, প্রশাসনিক সংস্থার কার্যাবলি কিভাবে পরিচালিত হত, প্রশাসনের সাথে নাগরিকের কিরুপ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং প্রশাসনিক সংগঠন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা কিভাবে নাগরিকদের জীবন প্রভাবিত করত তা সবিস্তার আলোচনা করতে এবং এর পটভূমিকায় পুরনো পদ্ধতির ত্রুটি দূরীকরণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির উদ্ভাবনে ইতিহাস খুবই সহায়ক। লোক প্রশাসন এ ব্যাপারে ইতিহাসের নিকট বহুলাংশে ঋণী।

এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White)-এর 'The Jacksonians', 'The Jaffersonians' এবং কৌটিল্যের ‘অথশাস্ত্র', আবুল ফজলের আইন-ই আকবরী', প্রভৃতি গ্রন্থ প্রশাসনিক ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নিদর্শন। অপরাপর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং কৃষ্টিগত প্রতিষ্ঠানসমূহের মত প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শিকর বা ভিত্তিও অতীতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। কালের বিবর্তনে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে এবং এগুলো প্রশাসন ব্যবস্থার উপর রেখাপাত করেছে। সুতরাং প্রশাসনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে একে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হবে।

সাম্প্রতিককালে প্রশাসনে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের কারণে প্রশাসনিক ইতিহাস নামে একটি নতুন শাখা বিকশিত হচ্ছে। কারণ পুরনো ফাইলপত্র এবং রেকর্ডসমূহ ভবিষ্যৎ কাজের নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অনেক সময় পুরনো নথিপত্র, রেকর্ডসমূহ এবং নজিরসমূহ সংসদে মন্ত্রিদের প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহায্য করে। পুরনো ফাইলপত্র এবং রেকর্ডসমূহ ভবিষ্যৎ কাজের নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নে বিশেষভাবে সাহায্য করে। সুতরাং অতি সহজে বলা যায় ইতিহাসের সাথে লোক প্রশাসনের নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

লোক প্রশাসন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Public Administration and Political Science): রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে লোক প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু রাষ্ট্র। এটা রাষ্ট্রের উৎপত্তি, রাষ্ট্রের সংগঠন ও বিকাশ, রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য, মানুষের রাজনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রের কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনাতে মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব বলে ধরে নেয়া হয়। ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর একটি তালিকা প্রণয়ন করে। এ তালিকা অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমগ্র বিষয়বস্তুকে চারটি ভাগে দেখান হয়। এগুলো হলো-

১। রাষ্ট্রীয় মতবাদ বা সিদ্ধান্ত ও তাদের ইতিহাস।

২। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও তার অন্তর্গত শাসনতন্ত্র, জাতীয় সরকার, প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থা ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুলনামূলক আলোচনা।

৩। রাজনৈতিক দল, উপদল ও সংস্থাসমূহ শাসনকার্যে নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও জনমত। 

৪। আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রনীতি ও সংগঠন।

অপরদিকে, লোক প্রশাসনের উদ্ভব রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকেই। এমন এক সময় ছিল যখন এ দু'টি বিষয়কে পৃথক করে দেখা হত না। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং লোক প্রশাসন একই জিনিসের দু'টি দিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাবলিক পলিসি নির্ধারণ করে, লোক প্রশাসন তা বাস্তবে রূপায়িত করে। এ হিসেবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা যায়। কিন্তু একটা অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বর্তমানকালে লোক প্রশাসন শুধু পাবলিক পলিসি বা সাধারণ আইন বাস্তবায়নের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অংশ নিয়ে থাকে। মন্ত্রী বা আইনসভার প্রতিনিধিদের নানা পরামর্শ ও তথ্য সরবরাহ করেই তারা নীতি নির্ধারণের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং লোক প্রশাসন পরস্পরের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।

মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে হলে আইন পাস এবং বস্তুনিষ্ঠ নীতি প্রণয়ন একান্তভাবে আবশ্যক। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। আইন এবং নীতিকে বাস্তবায়িত করা না গেলে তা মানুষের কোন কাজেই লাগে না। লোক প্রশাসনের উপর বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত। এ থেকে লোক প্রশাসনের উপর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নির্ভরশীলতা সহজেই অনুমেয়। অনুরূপভাবে লোক প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা আইন ও নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যই। কাজেই রাষ্ট্র লোক প্রশাসনের কাজের পরিসর বেঁধে দিয়ে তাকে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে। এভাবে দেখা যায রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের অবদানে সমৃদ্ধ। এদের মধ্যে আপেক্ষিক পার্থক্য আছে, তবে পার্থক্যের চেয়ে সম্পর্কই বেশি।

বিভিন্ন ধরনের সরকারি নিয়ন্ত্রণ, সরকার কর্তৃক উন্নয়নমূলক কার্য সম্পাদন, বিভিন্ন জনসংস্থার প্রতিষ্ঠা, অর্পিত ক্ষমতাবলে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা এবং সরকারের বড় বড় বিভাগের কার্যের পরিসর বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থার গুরুত্বও বহুলাংশে বেড়ে গেছে। তবু রাষ্ট্রনীতি শাসনব্যবস্থা বিবর্জিত নয়, কিংবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সরাসরি বিষয়বস্তু নয়। রুন্টসলির মতে, সর্বজনীন এবং বিশাল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে কাজ তা হলো রাষ্ট্রনীতি আর প্রশাসন হলো ব্যক্তিগত ও খুঁটিনাটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাজ। তবে উভয়ের ক্ষেত্র পৃথক পৃথক হলেও একটি বিষয়কে নিয়েই উভয়কে কাজ করতে হয়।

সুতরাং বলা যায় যে, এ দু'টি সমাজবিজ্ঞান পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাষ্ট্রের নীতিকে সম্বল করে যেমন লোক প্রশাসনের কাজ শুরু তেমনি লোক প্রশাসনের উপর নীতির সফলতা নির্ভরশীল। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির কোন আলোচনা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো লোক প্রশাসনের মস্তিষ্ক আর লোক প্রশাসন হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের হাত-পা আর উভয়কে নিয়ে একটি সমগ্র সত্তা।

লোক প্রশাসন ও সমাজবিজ্ঞান (Public Administration and Sociology): সমাজবিজ্ঞান সাধারণত সমাজের দিক নিয়ে আলোচনা করে। সমাজবিজ্ঞানে সমাজের অন্তর্গত সকল সংঘ, সমিতি ও রীতিনীতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। পক্ষান্তরে, লোক প্রশাসন ব্যবস্থা সমাজ ব্যবস্থারই নামান্তর। লোক প্রশাসন মানুষের সামাজিক প্রয়োজনেই কাজ করে, মানুষকে নিয়েই তার সব কারবার। সামাজিক পরিবেশ এবং মানুষের সংস্কৃতি প্রশাসনকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে। কাজেই লোক প্রশাসনকে বুঝতে হলে একটি রাষ্ট্রের জনসমষ্টির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। অধ্যাপক আর. এম. ম্যাকাইভার (R. M. Maclver) সমাজকে “সামাজিক সম্পর্কের সামগ্রিক পদ্ধতি”(The whole system of social relationship) বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

সমাজ তথা সমাজের মূল কাঠামো, প্রকৃতি এবং সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েই সমাজবিজ্ঞানের কাজ। আর এ সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত নিয়মাবলি ও ক্রিয়াকলাপ লোক প্রশাসনের কার্যক্ষেত্র। কাজেই সমাজবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসনের মধ্যে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান দ্বারা এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির ক্রিয়াকলাপের অনুশীলন দ্বারা লোক প্রশাসন বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করে থাকে।

সুতরাং সমাজবিজ্ঞান এবং লোক প্রশাসন পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রশাসনকে কোন সংগঠনের উদ্দেশ্য সাধনের সংঘবদ্ধ মানসিক প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে৷ এ সংগঠনে অসংখ্য নরনারী সমবেত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংগঠনের উদ্দেশ্য হাসিল করতে সচেষ্ট হয়। আর তা করতে গিয়ে তাদের একত্রে সমবেত ভাবে কাজ করতে হয়। এভাবে সংগঠনে কর্মরত কর্মচারীবৃন্দ এক প্রকার সামাজিক গোষ্ঠীর (Social Group) অধীনে সংঘবদ্ধ হয়। এ সামাজিক “গোষ্ঠীর মধ্যে আবার কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর (Sub-Groups) সৃষ্টি হয় এবং এরা সম্মিলিতভাবে প্রশাসনিক সংস্থার ক্রিয়াকলাপ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। প্রশাসন ব্যবস্থাকে অবশ্যই এ সকল সংস্থা এবং গোষ্ঠীর উৎপত্তি, কার্যাবলি এবং প্রভাব সম্পর্কে অবগত থাকতে হয়। একমাত্র সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানই প্রশাসকদের তা সুষ্ঠুভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যতীত অধিকাংশ সমস্যাই সমাধানের বহির্ভূত থেকে যাবে।

বস্তুত আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থার সামগ্রিক ভিত্তি সমাজবিজ্ঞানের তথা সামাজিক নৃতত্ত্বের (Social Anthropology) উপর নির্ভর করে রয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন লেখক, যেমনঃ ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber), হার্বাট এ. সাইমন (Herbert A. Simon), রবার্ট ডুবিন (Robert Dubin), ট্যালকট্ পারসনস্ (Talcott Parsons) প্রমুখ প্রধানত সামাজিক পদ্ধতি ও বিশ্লেষণের উপর জোর প্রদান করেছেন। এ দিক হতে লোক প্রশাসন ও সমাজবিজ্ঞান পরস্পর গভীর যোগসূত্রে আবদ্ধ।

লোক প্রশাসন ও আইন (Public Administration and Law): লোক প্রশাসন ও আইন পরস্পরের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত। আইন লোক প্রশাসনের সীমা নির্দেশ করে দেয় আর এ সীমার মধ্যে অবস্থান করেই প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। লোক প্ৰশাসন বহির্ভূত কোন কাজ করাই হলো লোক প্রশাসনের দায়িত্ব। তবে অর্পিত ক্ষমতাবলে এবং আইনসভার উপর প্রভাব বিস্তার করে লোক প্রশাসন ও আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সুতরাং এ দু'টি বিষয় পরস্পরের সাথে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত বলা যায়।

লোক প্রশাসন এবং আইন পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। উড্রো উইলসন যথার্থই বলেছেন, “সরকারি আইনের সুবিন্যস্ত এবং ব্যাপক প্রয়োগই হলো লোক প্রশাসন।” (Public Administration is the systematic and detailed execution of public law.) লোক প্রশাসন এবং আইনের এ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্যই লোক প্রশাসনকে আইনের একটি বিশেষ শাখা বলে গণ্য করা হয়। আধুনিককালে লোক প্রশাসন আইন প্রশাসনের সাথেও জড়িত। অধিকাংশ আইন সংক্রান্ত প্রস্তাবই প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগ (Administration Departments) হতে উৎপত্তি হয়। এভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ এবং বিভাগসমূহ আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এটা হস্তান্তরিত আইন বা ভার অর্পিত আইন (Delegated Legislation) বলে অভিহিত।

লোক প্রশাসন এবং আইন অপর একটি বিশেষ দিক হতে সম্পর্কযুক্ত। আইন প্রশাসকদের দায়িত্ব যথাযথভাবে কার্যকর করার হাতিয়ারস্বরূপ। প্রশাসকদের আইন বহির্ভূত কার্যাবলি আদালত কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ আইন দ্বারা রহিত করা হয় । এর অর্থ এ নয় যে, প্রশাসকদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে কোন প্রকার বিশেষ ক্ষমতা নেই। প্রশাসকদের অবশ্য কিছুটা বিশেষ ক্ষমতা থাকা আবশ্যক যাতে তারা প্রয়োজনবোধে স্বেচ্ছায় কার্য পরিচালনা করতে পারে। শাসনতান্ত্রিক আইনের (Constiutional Law) সাথেও প্রশাসনের গভীর যোগসূত্র পরিলক্ষিত হয়। লোক প্রশাসন শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সঠিক ব্যাখ্যা এবং বিভক্তিকরণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

লোক প্রশাসন ও নীতিশাস্ত্ৰ (Public Administration and Ethics): মানুষের আচার ও নৈতিকতা নিয়ে নীতিশাস্ত্র আলোচনা করে। নীতিশাস্ত্রের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হলো আচরণগত ও নীতিগত নিয়মাবলি নির্ধারণ করা। নৈতিকতার প্রয়োজন প্রশাসনের ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য। প্রত্যেকটি প্রশাসনিক বিষয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন জড়িত থাকে। যে প্রশাসন ব্যবস্থা জনগণের ন্যায়বোধের বিরোধী তা কখনো দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে না।

প্রশাসনের নিজস্ব বিচারের মানদণ্ড থাকা উচিত। তাদের মতে, মিতব্যয়িতা এবং দক্ষতা প্রশাসনের দু'টি প্রধান মানদণ্ড। কিন্তু সমালোচকের মতে, এ দু'টি কখনো প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিচারের মানদণ্ড হতে পারে না। কারণ এটা কোন নৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের প্রতি ধাবিত হয় না। প্রশাসনকে অর্থনৈতিক করার চেষ্টা করলে তা অবশ্যই ভেঙ্গে পড়বে। প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য জনগণকে উত্তম জীবন যাপনে সহায়তা করা। উত্তম জীবন যাপন কখনো নৈতিকতা বিবর্জিত হতে পারে না। নৈতিক মূল্যবোধের উপর প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠা আবশ্যক। নৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে প্রশাসন এবং এর কার্যক্রমের যথার্থতা বিচার করতে হবে। নৈতিক দিক হতে যা অন্যায় তা প্রশাসকের দিক হতে ন্যায় বলে বিবেচিত হতে পারে না। সে জন্য প্রশাসকদের অধিক পরিমাণে নৈতিক নীতি দীক্ষা দিতে হবে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, নৈতিকতাকে বাদ দিয়ে লোক প্রশাসন একেবারেই পা বাড়াতে পারে না।

লোক প্রশাসন ও মনোবিজ্ঞান (Public Administration and Psychology): লোক প্রশাসনের মধ্যে মনোবিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সাম্প্রতিককালের অনেক লেখকগণ উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকালের লেখকগণ লোক প্রশাসনের আইনগত দিক ছাড়া অন্য কোন দিককে স্বীকার করতেন না। লোক প্রশাসনের আচরণগত এবং মনস্তাত্ত্বিক দিকটিকে তারা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন। সে জন্য সে যুগের প্রশাসন ব্যবস্থায় মনোবিজ্ঞান তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। কিন্তু আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থার অধ্যয়নে মনোবিজ্ঞানের প্রভাব বহুল পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। সহজ কথায় মনোবিজ্ঞান বলতে বুঝায় মনের বিজ্ঞান। তবে এ ধারণা সঠিক নয়, কেননা মানব মন অদৃশ্য এবং এটা সহজে বোধগম্য নয়। আমরা মানব মনকে বরং মানুষের আচরণ হতে বুঝতে পারি। কাজেই মনোবিজ্ঞানকে আচরণের বিজ্ঞান বলাই সমীচীন।

বর্তমানকালে প্রশাসনিক বিষয়সমূহ এবং সমস্যাগুলোকে মনস্তাত্ত্বিক নিয়মাবলির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা চলছে। মনোবিজ্ঞান যে সকল মানবিক সংগঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা এখন সর্বজনবিদিত। যা সমাজবদ্ধ মানুষ নিয়ে আলোচনা করে, কোন সামাজিক বিজ্ঞানই তার মনস্তাত্ত্বিক উপাদানসমূহ উপেক্ষা করতে পারে না। প্রশাসন যে একটি মানবিক বিষয় বর্তমানে তা স্বীকৃত সত্য বলে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনকে এখন আর পূর্বের ন্যায় আইনগত এবং আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা বলে মনে করা হয় না বরং প্রশাসন ব্যবস্থায় কর্মরত ব্যক্তিবর্গ ও কর্মচারীদের মনস্তত্ত্ব আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, আচার ব্যবহার, অভ্যাস, বিশ্বাস প্রভৃতির এক মূর্ত প্রতীক বলে মনে করা হয়। প্রশাসনিক সংগঠনে কর্মচারীদের কাঠামোগত পদসোপান এবং আইনগত সম্পর্ক ছাড়া কাঠামোগত এবং অনিয়মিত সম্পর্ক বিরাজ করে। কর্মচারীদের মনোভাব, মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপরই প্রশাসনিক সংগঠনের কার্যক্রমের সার্থকতা নির্ভরশীল করে।

সম্প্রতি প্রশাসনকে সঠিক পরিমাণে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ হতে বুঝার চেষ্টা করা হয়েছে। পূর্ববর্তীকালে এ মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের প্রতি তেমন গুরুত্ব আরোপ না করার ফলে প্রশাসন ব্যবস্থায় অনেক দোষ-ত্রুটি দেখা দিয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে নানা প্রকার কলহ, সংঘর্ষ, হরতাল সংঘটিত হয়েছে। কারণ তখন শ্রমিকদের মানসিকতার প্রতি কোন নজর দেয়া হয় নি। এ কারণেই শিল্প মনোবিজ্ঞান নামে স্বতন্ত্র জ্ঞানের শাখার উদ্ভব হয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থা তখনই সুষ্ঠু হয় যখন তা জনগণের মানসিকতা, ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। সুষ্ঠু প্রশাসনকে অবশ্যই সমাজের তথা জনগণের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে কর্মচারী প্রশাসন বহুল পরিমাণে কর্মচারীদের মনস্তত্ত্ব ও মানসিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। সরকারি চাকরিতে লোক সংগ্রহ এবং নিয়োগ পদ্ধতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান যথেষ্ট সহায়তা করেছে।

সাম্প্রতিককালে যে কোন সরকারি সংগঠনে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা এবং কলাকৌশলের ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া কর্মচারীদের কাজে উৎসাহ দান, মনোবল, খ্যাতি ও প্রতিপত্তি প্রভৃতি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। বিভিন্ন উপদেষ্টা পরিষদ, কমিটি সভা, প্রচার কমিটির কার্যাবলি এবং কর্মচারী ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের মীমাংসা করা প্রভৃতি কার্য অবশ্যম্ভাবীরূপে মনস্তাত্ত্বিক। এভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, লোক প্রশাসনের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।

লোক প্রশাসন ও ভুগোলবিদ্যা (Public Adminsitration and Geography): কোন দেশের সরকার-ব্যবস্থা তথা প্রশাসন-ব্যবস্থা তার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলির দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। ভৌগোলিক পরিবেশ জনগণের জীবন-যাত্রার পদ্ধতি এবং সে সাথে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সমস্যাদির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি ধরনের প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ প্রায়ই কোন দেশের প্রশাসনিক এলাকাসমূহের সীমানা নির্ধারণ করে। কোন দেশের আয়তন, ভূ প্রকৃতি, নদ-নদী ও পাহাড়-পর্বতের অবস্থান ইত্যাদি অনুযায়ী সেখানকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা সহজসাধ্য বা কঠিন হয়ে থাকে। আর এ যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজসাধ্যতা বা কঠিনতা অনুযায়ীই সেখানে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হবে না বিকেন্দ্রীভূত হবে, তা নির্ধারিত হয়।

এরূপে, কোন্ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশের আলোকে এর প্রশাসন-ব্যবস্থা অধ্যয়ন করার গুরুত্ব রয়েছে। জন এম. গউস (John M. Gaus) তার 'Reflection on Public Administration' গ্রন্থে প্রশাসনে ভৌগোলিক অবস্থা, পরিবেশের তাৎপর্য সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রবার্ট এ. ডাল অনুরূপভাবে পরিবেশগত অবস্থানের মধ্যে লোক প্রশাসনকে আলোচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে ফ্রেড. ডব্লিউ. রিগস্ (Fred. W. Riggs) রচিত 'The Ecology of Public Administration' একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক