নীতিবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কবিষয়ক মতবাদগুলো আলোচনা কর


প্রশ্নঃ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কবিষয়ক মতবাদগুলো ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নীতিবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কবিষয়ক মতবাদগুলো আলোচনা ও বিচার কর।
অথবা, ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কবিষয়ক যে সব মতবাদ রয়েছে সেগুলো আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যা হলো সমাজে বসবাসকারী মানব আচরণ সম্পর্কীয় একটি আদর্শনিষ্ঠ বিদ্যা। সমাজ বহির্ভূত আচরণ নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় নয়। সামাজিক পরিবেশে মানুষ কাজকর্ম করে বলে তার আচরণ সমাজের অন্যান্য মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। নীতিবিদ্যা আদর্শের ভিত্তিতে এর মূল্যায়ন করে। নৈতিক আদর্শের আলোকে ব্যক্তির সাথে সমাজে অপর ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। যেগুলো নীতিবিদ্যার আলোচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কে নৈতিক মতবাদঃ ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক সম্বন্ধে নৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টিকোণ থেকে যে সব মতবাদ রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমেই ব্যক্তি ও সমাজ বলতে কী বুঝায় সেটা জানা দরকার।

ব্যক্তি (Individual): ব্যক্তি বলতে আমরা সাধারণত ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপকে বুঝে থাকি। কেননা এটা দেখা যায় যে, ব্যক্তির নিজস্ব ক্রিয়াকলাপ নিয়েই ব্যক্তির স্বরূপ গড়ে ওঠে।

সমাজ (Society): মূর্ত অর্থে সমাজ বলতে একটা সামাজিক দল (Social group) এবং বিমূর্ত অর্থে যে কোনো দলের সামাজিক জীবনকে বুঝায়।

নৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টিকোণ থেকে এক ব্যক্তির সাথে অপর ব্যক্তির সম্পর্ক অর্থাৎ সমাজের এক ব্যক্তির সাথে অপরাপর ব্যক্তির সম্পর্ক ব্যক্তির নৈতিক সম্পর্ক নিয়ে তিনটি মতবাদ গড়ে উঠেছে। যাথা- ১. আত্মবাদ (Egoism) ২. পরার্থবাদ (Altruism) ৩. সর্ববাদ (Universalism)। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

আত্মবাদ (Egoism): আত্মবাদের মতে ব্যক্তির একমাত্র কর্তব্য হলো তার নিজের মঙ্গল বা স্বার্থ রক্ষা করা সমাজের অপরাপর ব্যক্তির স্বার্থ বিবেচ্য বিষয় নয়। এই মতবাদে অনেক সময় এভাবেও বলা হয়ে থাকে যে, মানুষ এমন উপাদানে গঠিত যে কাজ তার সুখ বয়ে আনবে, তাই সে করবে। আত্মবাদের এরকম ব্যাখ্যা মনস্তাত্ত্বিক আত্মবাদ (Psychological Egoism) নামে খ্যাত। এ মতবাদ অনুসারে ব্যক্তি সমাজের একজন সদস্য হলেও সে সমাজেরসহ সদস্যদের মঙ্গলের দিকে দৃষ্টি দেয় না। তার কাজ যদি আপাতদৃষ্টিতে অন্যের সুখ বয়ে আনে, তবুও তার ঐ কাজ নিজ স্বার্থই রক্ষা করে। যে ব্যক্তিটি সমাজের এক গরিব ব্যক্তিকে অর্থ দান করলে গরিব ব্যক্তিটি ঐ অর্থ দ্বারা উপকৃত হলেও এর দ্বারা দাতার স্বার্থই রক্ষিত হলো। অর্থাৎ দাতার জন্য এই দানশীল খেতাব বয়ে আনল যা আত্মস্বার্থেরই নামান্তর।

সমালোচনাঃ দর্শনের কোনো বিষয় সমালোচনার উর্ধ্বে নয় এখানে একবাক্যে কোনো কিছু মেনে নেওয়া হয় না। আত্মবাদী মতবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিভিন্ন দিক থেকে এ মতবাদের সমালোচনা রয়েছে।

প্রথমতঃ এই মতবাদে সুখবাদের কুটাভাষ (Pradox of Hedonism) বর্তমান। ব্যক্তি যতই নিজের সুখ কামনা করুক বা লাভ করুক না কেন, সে তা থেকে সব সময়ই যেন বঞ্চিত। নিজের সীমাহীন কামনা বাসনাই ব্যক্তিকে তার সুখ থেকে বঞ্চিত করে। বস্তুত আনন্দ বা সুখ লাভের অন্যতম উপায় হলো সুখের প্রতি সীমাহীন আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করা। 

দ্বিতীয়তঃ আত্মবাদের অপর রূপ মনস্তাত্ত্বিক-আত্মবাদ মেনে নিয়ে নৈতিক আত্মবাদ (Ethical Egoism) অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ ব্যক্তি যদি স্বভাবগতভাবে সব সময় নিজের স্বার্থ অনুসন্ধান করে। তবে মানুষের সব সময় সুখ অনুসন্ধান করা উচিত- এ কথার কোনো অর্থ হয় না।

তৃতীয়তঃ আত্মবাদ মানবজাতির নৈতিক সংজ্ঞার গুরুত্ব অস্বীকার করে। সমাজে নৈতিক জীবনযাপন করা বিবেকসম্মত কাজ। এই বিবেক মানুষকে নিজের সুখ ছাড়াও সমাজের অপরাপর সদস্যদের সুখ সন্ধানে অনুপ্রাণিত করে।

চতুর্থতঃ আত্মবাদ মানব প্রকৃতির আংশিক দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলে একে একটি পূর্ণাঙ্গ মতবাদ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না। মানুষের স্বভাবে যেমন স্বার্থবোধ রয়েছে তেমনি তার প্রকৃতিতে পরার্থবোধও রয়েছে।

পরার্থবাদ (Altruism): এই মতবাদ অনুযায়ী নিজের মঙ্গলের দিকে না তাকিয়ে, সমাজের অপরাপর সদস্যের মঙ্গল কামনা করাই প্রতিটি ব্যক্তির একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। ব্যক্তি যদি সত্যিই তার সমাজ ও সম্প্রদায়ের মঙ্গল কামনা করে, তবে সেখানে তার নিজ স্বার্থের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ নেই। এই মতবাদের সাথে আত্মবাদের পার্থক্য হলো এটি আত্মোৎসর্গ অনুমোদন করে। অপর পক্ষে আত্মবাদ আত্মোপলব্ধিতে বিশ্বাসী। এই মতবাদ সর্ববাদ হতে ভিন্ন এই জন্য যে, ব্যক্তির অপরত্বের (Otherness) উপর এটি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে। এখানে ব্যক্তির তার নিজের সুখ বা মঙ্গল অনুসন্ধান করার সুযোগ নেই।

সমালোচনাঃ আত্মোৎসর্গের পন্থা সব সময় সঠিক পন্থা নয় বলে এই মতবাদেও বিভিন্ন ধরনের এটি ধরা হয়েছে। যথা -

প্রথমত, স্পেন্সার মনে করেন যে বিশুদ্ধ আত্মবাদের মত বিশুদ্ধ পরার্থবাদ ও সাধারণের মঙ্গল খর্ব করে। ব্যক্তি যদি মঙ্গল অনুসন্ধানের সময় নিজের স্বাস্থে দিকে লক্ষ্য না রেখে কেবল অপরের পরিচর্যা বা মঙ্গলের দিকে খেয়াল রাখে তাহলে তার স্বাস্থ্য হানির ফলে নিজেই এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং অপরকে সাহায্য করতে অক্ষম হবে।

দ্বিতীয়, রাশড্যাল মনে করেন যে, আত্মোৎসর্গের স্বার্থে আত্মোৎসর্গ অযৌক্তিক ও অনৈতিক। আমাদের বিবেক আমদের এইটুকু বলে যে, আমাদের প্রতিবেশীর বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য আমাদের আত্মস্বার্থের কিছু অংশ ত্যাগ করা উচিত।

তৃতীয়ত, এটা দেখা যায় যে, সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিই যদি নিজের স্বার্থ বা মঙ্গল উপেক্ষা করে সমাজের স্বার্থ রক্ষার দিকে লক্ষ্য রাখে। তাহলে তো স্বীয় স্বার্থ বা মঙ্গল রক্ষা করার মতো কারো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে আত্মবাদ যেমন একটা চরম মতবাদ পরার্থবাদও তেমনি চরম মতবাদ।

সর্ববাদ (Universalism): এই মতবাদ অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হলো তার সমাজ বা সাম্প্রদায়ের সামগ্রিক মঙ্গল সাধন করা। এ মতবাদ আত্মবাদ ও পরার্থবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করার দাবি রাখে। কেননা সমাজের সার্বিক মঙ্গল ব্যক্তির নিজের ও অপরের মঙ্গলকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। সর্ববাদ অনির্দিষ্টভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে। ব্যক্তি তার নিজের সম্প্রদায়ের তার দেশের সমগ্র মানবজাতির এমনকি সমস্ত প্রাণিকুলের মঙ্গল কামনা করতে পারে।

সমালোচনাঃ সমালোচনা দৃষ্টিকোণ থেকে সর্ববাদ ও ত্রুটি মুক্ত মতবাদ নয়। যথা-

প্রথমত, এ মতবাদ ব্যক্তির মূর্তমঙ্গল (Concrete good) কামনা না করে তার সমাজ বা সম্প্রদায়ের অমূর্ত মঙ্গল (Abstract good) কামনা করে। সর্বসাধারণের মঙ্গলই যদি আমাদের একমাত্র কাম্য হয় তবে অবশ্যই আমাদের এর মূর্ত প্রকৃতি সম্পর্কে জানা দরকার।

দ্বিতীয়ত, সর্ববাদ আত্মোৎসর্গের ধারণাকে হয় সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে। অথবা, একে বিভ্রান্তিকর করে ফেলে। কেননা এ মতবাদ অনুসারে সমাজের অপরাপর ব্যক্তির মঙ্গল কামনা করতে গিয়ে প্রকারান্তে আমরা নিজেদের মঙ্গলই অধিকতর কামনা করি।

তৃতীয়ত, সব ব্যক্তি যে সবভাবে সব রকম সুখ কামনা করে বা উপভোগ করতে পারে তা ঠিক নয়। আধ্যাতিক মঙ্গলে হয়ত অংশীদার হওয়া যায় কিন্তু নিম্নস্তরের কিছু পার্থিব সুখ আছে যা অংশীদার ভিত্তিতে উপভোগ্য নয়। সুতরাং প্রত্যেক মানুষের নৈতিক কর্তব্য সর্বসাধারণের মঙ্গল অনুসন্ধান করে সমভাবে তার উপভোগ করা সর্ববাদীদের এই দাবির ব্যবহারিক কোনো মূল্য নেই।

উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক বিষয় নৈতিক মতবাদগুলো নৈতিকতার ভিত্তিতেই প্রণীত। কিন্তু এককভাবে কোনোটিই সর্বজন গৃহীত নয়। বিভিন্ন দিক দিয়ে এগুলো সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তথাপি নীতিবিদ্যার আলোচনার ক্ষেত্রে উক্ত মতবাদগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক