আন্তর্জাতিক আদালতের গঠন, ক্ষমতা বা এখতিয়ার ও কার্যাবলী আলোচনা কর। কিভাবে এর রায় বা সিদ্ধান্ত বলবৎ করা যায়?


প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক আদালতের গঠন, ক্ষমতা বা এখতিয়ার ও কার্যাবলী আলোচনা কর। কিভাবে এর রায় বা সিদ্ধান্ত বলবৎ করা যায়?

ভূমিকাঃ জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গ হলো আন্তর্জাতিক আদালত। এটি জাতিসংঘের প্রধান বিচারবিভাগীয় অঙ্গ। কিছু রাষ্ট্র ব্যতীত পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আইনগত বিষয়ে কোন বিরোধ দেখা দিলে এই সংস্থা তার বিচার করে৷

আন্তর্জাতিক আদালতের গঠনঃ

আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হবে সংবিধির ১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী।

আন্তর্জাতিক আদালতের প্রধান কার্যালয় নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত। তবে আদালত প্রয়োজন মনে করলে যে কোন সময় যে কোন স্থানে তার কার্যাদি পরিচালনা করতে পারবে।

সংবিধির ২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৫ জন সদস্য নিয়ে বিচার বিভাগ গঠিত হবে। 

যে সকল ব্যক্তি নিজ দেশে সর্বোচ্চ বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য বা আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে স্বীকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন এবং উচ্চ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী সেই সকল ব্যক্তি নিয়ে এই আদালত গঠিত হবে।

একই সময়ে একই রাষ্ট্র থেকে একাধিক ব্যক্তি নিয়োগ পাবেন না। বিচারকদের মেয়াদ হবে ৯ বছর। তবে তারা পূনঃ নির্বাচিত হতে পারবেন।

প্রথম নির্বাচনে যে সকল ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নির্বাচিত হবেন তাদের ৫ জনের মেয়াদ হবে বছর এবং আরো ৫ জনের মেয়াদ হবে ৬ বছর।

বিচারকগণ নিজেদের মধ্য থেকে সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচিত করবেন। যাদের মেয়াদ হবে ৩ বছর।

কোন বিচারক ইস্তফা দিতে চাইলে সভাপতি বরাবর আবেদন করতে হবে।

১৫ বিচারকের মধ্যে ৯ জন দ্বারা কোরাম হবে।

এই আদালত এক বা একাধিক চেম্বার গঠন করতে পারবেন। যার সদস্য হবে ৩ বা ততোধিক।

আন্তর্জাতিক আদালতের ক্ষমতা বা এখতিয়ার : আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার বা ক্ষমতা মূলত দুইভাগে বিভক্ত। (১) বিরোধমূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার, (২) উপদেশমূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার।

(১) বিরোধমূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার : আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধির ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিরোধমূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার পর্যালোচনা করা বলতে যা পাওয়া যায় তা হলো-

(i) স্বেচ্ছামূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার : আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধির ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত যে কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধির পক্ষ হতে পারবে। এছাড়া যে কোন রাষ্ট্র জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার বা ক্ষমতা স্বেচ্ছামূলকভাবে মেনে নিতে পারবে।

(ii) বাধ্যতামূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার : জাতিসংঘ সনদের ৯৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- আন্তর্জাতিক আদালতের রায় জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক প্রযোজ্য। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আদালত যে রায় প্রদান করবে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্র তা মানতে বাধ্য।

(iii) ঐচ্ছিক ক্ষমতা বা এখতিয়ার : আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধির ৩৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- পক্ষগণ ইচ্ছা করলে নিচের চারটি বিষয়ে আদালতের ঐচ্ছিক ক্ষমতার অধিভূক্ত হতে পারেঃ

(ক) কোন চুক্তির ব্যাখ্যার জন্য,

(খ) কোন ঘটনার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হলে আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব লংঘন বলে বিবেচিত হবে।

(গ) আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব লংঘনের ফলে ক্ষতিপূরণের প্রকৃতি ও পরিধি নির্ধারণ করা। 

(ঘ) আন্তর্জাতিক আইনের কোন প্রশ্ন।

(২) উপদেশমূলক ক্ষমতা বা এখতিয়ার : সাধারণ পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক প্রেরিত আইনগত কোন প্রশ্নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালত তার মতামত বা উপদেশ বা পরামর্শ প্রদান করতে পারবে। [জাতিসংঘ সনদ, অনুচ্ছেদ-৯৬(২)]

আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যাবলী : নিম্নে আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যাবলী উল্লেখ করা হলো :

(১) পরামর্শ দান : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের অনুরোধে আন্তর্জাতিক আদালত পরামর্শ দান করে থাকে।

(২) বিচার করা : আন্তর্জাতিক আদালত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আইনগত বিষয়ে কোন বিরোধ দেখা দিলে তার বিচার করে।

(৩) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : আন্তর্জাতিক আদালত বিভিন্ন দেশের বিরোধ নিষ্পত্তি করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

(৪) সন্ধি বা চুক্তির ব্যাখ্যা প্রদান : আন্তর্জাতিক আদালত বিভিন্ন সন্ধি বা চুক্তির ব্যাখ্যা প্ৰদান করে।

(৫) জটিল প্রশ্নের মীমাংসা : আন্তর্জাতিক আদালত আইন সংক্রান্ত জটিল প্রশ্নের রায় প্রদানের মাধ্যমে তা মীমাংসা করে।

কিভাবে এর রায় বা সিদ্ধান্ত বলবৎ করা যায় : আন্তর্জাতিক আদালতের রায় জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক প্রযোজ্য। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আদালত যে রায় প্রদান করবে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্র তা মানতে বাধ্য।

কিভাবে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বা সিদ্ধান্ত বলবৎ করা যায় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

(১) বল প্রয়োগ বা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে : আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কার্যকর বা বলবৎ করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। প্রয়োজনে বল প্রয়োগের মাধ্যমে বা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে রায় কার্যকর করা যেতে পারে।

(২) অর্থনৈতিক বয়কটের মাধ্যমে : কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অমান্য করলে তার উপর অর্থনৈতিক বয়কট করা যাবে।

(৩) অভিমত প্রদানের মাধ্যমে : কোন সুপারিশ করে বা অভিমত প্রদানের মাধ্যমেও আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকর করা যেতে পারে।

উপসংহারঃ আন্তর্জাতিক আদালত জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এই আদালতের উপদেশ কারো জন্য বাধ্যতামূলক না হলেও এর বিচারের রায় বাধ্যকর। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক