ভূমিকাঃ নৈতিকতার সম্পর্ক সম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে সুখবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। সুখবাদের যে সকল শাখা-প্রশাখা রয়েছে তার মধ্যে আত্মসুখবাদ ও পরসুখবাদ অন্যতম। উপযোগবাদ ছাড়া সুখবাদ ভাবা যায় না। জেরেমী বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল ও সিজউইক হলেন উপযোগবাদের প্রতিষ্ঠাতা।
উপযোগবাদঃ জেরেমী বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল ও হেনরি সিজউইক দ্বারা প্রবর্তিত নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পর্কীয় মতবাদ পরার্থবাদ বা সর্ববাদী উপযোগবাদ নামে পরিচিত। এসব চিন্তাবিদ তাদের যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করলেও তাদের বক্তব্যের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে এবং তা হচ্ছে ব্যক্তিগত সুখের পরিবর্তে সার্বিক সুখের উপর গুরুত্বারোপ করা। তারা সবাই এক বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে, সর্বাধিক সংখ্যক লোকের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ আমাদের কামনা করা উচিত। তাদের মতবাদকে উপযোগবাদ বলার কারণ হলো, তারা উপযোগিতা বা কার্যকারিতাকে নৈতিকতা বা নৈতিক অবধারণের মানদণ্ড বলে মনে করেন।
মিলের উপযোগবাদঃ জন স্টুয়ার্ট মিল কর্তৃক প্রচারিত সর্ববাদী সুখবাদ নীতিবিদ্যার ইতিহাসে উপযোগবাদ নামে পরিচিত। বেন্থাম কর্তৃক প্রচারিত সর্ববাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণের প্রয়াস রয়েছে মিলের উপযোগবাদে। তিনি বেন্থামের স্থূল ইন্দ্রিয় সুখের পরিবর্তে মার্জিত সুখের কথা বলে উপযোগবাদের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার প্রয়াস পান। উপযোগবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মিল বলেন যে, উপযোগবাদ এমন এক উপযোগ নীতির কথা বলে, যা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক পরিমাণ সুখ কামনা করা উচিত বলে মনে করে। অর্থাৎ উপযোগবাদ সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক পরিমাণ সুখকে মানব আচরণের পরম নৈতিক আদর্শ বলে বিবেচনা করে। একটা কাজ কতটুকু ভালো বা শুভ, তা নির্ভর করে সেটি কতটুকু সুখ প্রদান করে তার উপর। যদি আমার কাজের দ্বারা বেশি সুখ পাওয়া যায়, তাহলে বলতে হবে আমার কাজের মূল্য বেশি রয়েছে। তার মানে সুখের পরিমাণ দিয়েই কাজের নৈতিকতা নির্ধারণ করতে হবে বলে মিল মনে করেন।
মিলের উপযোগবাদের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে মিলের উপযোগবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলোঃ
১. সুখের গুণগত পার্থক্যঃ সুখের গুণগত পার্থক্য বা কোনো সুখ অন্য সুখের চেয়ে কিভাবে মূল্যবান তা নিরূপণের কথা প্রসঙ্গে মিল বলেন, “দু'টি সুখের মধ্যে যদি একটি সুখ থাকে, যা পছন্দ করতে নৈতিক বাধ্যবাধকতার অনুভূতি উল্লেখ না করেও উভয়ের সম্পর্কে অবহিত সবাই বা প্রায় সবাই একটি সুখের প্রতি সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটাই হবে অধিকতর কাম্য সুখ।
২. মানুষ উচ্চতর বৃত্তির অধিকারীঃ মিল মনে করেন যে, মানুষের মধ্যে একটা উচ্চতর বৃত্তি রয়েছে। নিম্নতর বৃত্তি অপেক্ষা উচ্চতর বৃত্তিতে যদিও সুখ কম তথাপি তা ভালো। এই উচ্চতর বৃত্তিই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে।সুখের পরিপূর্ণ ভোগের অঙ্গীকারের জন্য খুব কম লোকই রয়েছেন, যারা কোনো নিম্নতর প্রাণীতে পরিবর্তিত হওয়ার জন্য সম্মতি দিয়ে থাকেন। কোনো বুদ্ধিমান মানুষ মূর্খ হওয়ার জন্য সম্মতি দেন না।
৩. যোগ্য বিচারকের রায়ঃ মিল সুখের পরিমাণের বিপরীতে সুখের গুণের পরীক্ষা এবং পরিমাপের নীতি সম্পর্কে বলেন যে, যোগ্য বিচারকের রায় হচ্ছে সুখের গুণগত পার্থক্য পরিমাপের আলস নীতি। দু'টি প্রদত্ত সুখের মধ্যে গুণের দিক দিয়ে কোনোটি উৎকর্ষপূর্ণ, তা নিরূপণ করার উদ্দেশ্যে যোগ্য বিচারকের রায়ের উপর নির্ভর করা উচিত।
৪. মর্যাদাবোধঃ মিল এর মতে, যোগ্য বিচারকদের দ্বারা অনুভূত অগ্রাধিকারের অর্থাৎ নিম্নতর বৃত্তির সুখের পরিবর্তে, নির্ধারিত উচ্চতর বৃত্তির সুখের প্রাধান্য দেয়ার চরম ভিত্তিই হচ্ছে মর্যাদাবোধ। মানুষ মর্যাদাবোধের ফলেই নিম্নতর বৃত্তির সুখকে বর্জন করে এবং উচ্চতর বৃত্তির সুখকে গ্রহণ করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপযোগ নীতির স্বপক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেয়া সম্ভব নয়। একথা প্রথমে বলার পরও মিল উপযোগ নীতির স্বপক্ষে পরোক্ষ প্রমাণ বা প্রামানিক তথ্য দেয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা চালান, তা বিভিন্ন ধরনের চিন্তার খোরাক জোগার করেছে।
0 মন্তব্যসমূহ