উত্তরঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে সব মুসলমান কবি স্মরণীয় হয়েছেন, যাদের প্রতিভায় বাংলা কাব্যে অভিনব বৈচিত্র্যের সঞ্চার হয়েছিল- তাদের প্রায় সকলের কাব্য মুসলমান সমাজেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু দু'একজন কবির কাব্যের প্রভাব হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা যথার্থই বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের কবি, শুধু মুসলমান সমাজের কবি নন। তাদের একজন হলেন দৌলত কাজী।
সপ্তদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত কবি দৌলত কাজীর লোরচন্দ্রানী বা সতীময়না রোমান্টিক আখ্যানকাব্য হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই তিনি নানা বিদ্যা অর্জন করেন।
মধ্যযুগে বাংলার বাইরে সুদূর আরাকানে বাংলা ভাষার চর্চা হত। আরাকান রাজ অমাত্যরা প্রায় সবাই ছিলেন বাঙালি। আরাকানরাজ থিরি থু ধম্মার (শ্রী সুধর্মা) রাজসভায় তিনি পরম সমাদরে গৃহীত হন এবং আরাকানের সমর সচিব আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ও উপদেশে ১৬২১ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে হিন্দি কবি মিয়াসাধনের কাহিনী অবলম্বনে লোরচন্দ্রানী বা সতীময়না রচনা করেন। কাব্যটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রচনার পর অকালে কবি দৌলত কাজী মৃত্যুবরণ করেন। পরে প্রসিদ্ধ কবি আলাওল আরাকানরাজ সান্দ থু ধম্মার (চন্দ্র সুধর্মা) প্রধানমন্ত্রী সুলেমানের নির্দেশে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের এ কাব্যের বাকি এক-তৃতীয়াংশ সমাপ্ত করেন। দৌলত কাজীই আরাকান রাজসভার প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি দৌলত কাজী হিন্দি কবি মিয়াসাধনের ‘মৈনা কো সত' কাব্য থেকে তার সতীময়না বা লোরচন্দ্রানীর উপাদান সংগ্রহ করেন। গ্রাম্য হিন্দিতে লেখা সাধনের কাব্যকে দৌলত কাজী বাংলা পয়ার ত্রিপদীতে রূপান্তর করেন। সতীময়নার কাহিনী সারা ভারতেই প্রচলিত ছিল এবং আছে।
দৌলত কাজী কাব্যটির যে অংশ লিখেছেন তা সংক্ষেপে এরূপ-
গোহারী দেশের রাজার কন্যা চন্দ্রানীর সাথে এক নপুংসক বামনের বিয়ে হয়। মহাবীর লোরক/লোরের সাথে চন্দ্রানীর সাক্ষাৎ হলে উভয়ে উভয়ের প্রতি অনুরক্ত হন। লোর তার প্রথমা স্ত্রী ময়নামতীকে ত্যাগ করে চন্দ্রানীকে নিয়ে পালানোর পথে চন্দ্রানীর স্বামী লোরকে বাধা দিলে তাকে হত্যা করেন। লোর চন্দ্রানীকে বিয়ে করেন এবং শ্বশুরের দেশে রাজা হন।
এদিকে ময়না স্বামী বিরহে কাতরা। এক লম্পট রাজকুমার ময়নার প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে ব্যর্থ হয়। এ পর্যন্ত লিখে দৌলত কাজীর অকাল মৃত্যু হয়। তবে যেটুকু তিনি লিখেছেন তার কাহিনী খুব সংযত ও পরিচ্ছন্ন। ময়নার সতীত্ব, প্রলোভনের সামনে অবিচল নিষ্ঠা, পলাতক স্বামীতে অপরিসীম শ্রদ্ধা প্রভৃতি বিষয় কবি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। সতীময়নার আদর্শ চরিত্রের চেয়ে চন্দ্রানীর রোমান্টিক চরিত্র বেশি প্রাণবন্ত হয়েছে। কবি ময়নার সতীত্বে শ্রদ্ধাশীল হলেও, চন্দ্রানীর উপর শিল্পীর পক্ষপাতিত্ব প্রকট। দৌলত কাজীর পরিচ্ছন্ন ভাষা, নিপুণ ছন্দজ্ঞান অতি উৎকৃষ্ট। লোরচন্দ্রানী বা সতীময়না কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভেঙে এক অভিনব আদর্শের পথ তৈরি করেছে। বিশেষত দেব প্রাধান্যের যুগে রক্তমাংসে গড়া মানুষের কাহিনী রচনার সূত্রপাতে দৌলত কাজী নন্দিত ও অবিস্মরণীয়।
তার কাব্যের নমুনা-
নিরঞ্জন সৃষ্টি নর অমূল্য রতন।
ত্রিভুবনে নাহি কেহ তাহার সমান।
নর বিনে চিন নাহি কিতাবে কোরান।
নর সে পরমদেব তন্ত্র মন্ত্র জ্ঞান।
নর সে পরমদেব তন্ত্র মন্ত্র জ্ঞান।
নর সে পরমদেব নর সে ঈশ্বর।
নর বিনে ভেদ নাই ঠাকুর কিঙ্কর।
আধুনিক যুগে দেবতা স্থলে মানুষের প্রাধান্য কবি দৌলত কাজীর কাব্যে প্রথম অনুরণিত হওয়ায় তিনি আমাদের আধুনিক কবিদের অগ্রজ।
0 মন্তব্যসমূহ