প্রশ্নঃ মর্সিয়া সাহিত্য কী?
উত্তরঃ মর্সিয়া শব্দের অর্থ শোক বা আহাজারি। মর্সিয়া কাব্য বা সাহিত্য মূলত শোককাব্য। শোকের উৎস যুদ্ধক্ষেত্র। কারবালা যুদ্ধের কাব্যই ষোল-সতের শতক থেকে বাংলার মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় হতে থাকে। কারণ, কারবালার যুদ্ধ হোসেনের সাথে এজিদের। আলীর পুত্র হাসান-হোসেনের অনুসারীরা শিয়া হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে দাক্ষিণাত্যের শিয়াদের ও ইরানী শিয়াদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, সে সূত্রেই ষোল শতক থেকেই শিয়াদের শোকের কাহিনী বাংলায় গুরুত্ব পায়।
তাছাড়া মুসলমান মাত্রেই হযরত মুহম্মদ (স) এর সঙ্গে জড়িত। তারই দৌহিত্র হাসান- হোসেনের প্রতি সে কারণেই আমাদের সহানুভূতি। আর এ জন্যই বাংলায় শোককাব্য তথা কারবালার বেদনাসিক্ত কাহিনী আমাদের কাছে আদরণীয়।
মর্সিয়া সাহিত্য বলতে প্রধানত কারবালার কাহিনী, তথা হযরত আলী (রা) এর পুত্র, হযরত মুহম্মদ (স) এর দৌহিত্রের যে শোচনীয় ও বেদনার্ত পরাজয়, যা আমাদেরকে শোক সাগরে ভাসায় তাকেই বুঝায়। এ সাহিত্যে নায়ক বিজয়গৌরবহীন এবং পরাজিত ও পাশবিকভাবে নিষ্ঠুরের হাতে মৃত্যুবরণ করে বলেই এ সাহিত্যের রস হয়ে উঠে করুণ। শোকের বা কান্নার আধার বলেই এ বিলাপ প্রধান সাহিত্যের নাম মর্সিয়া বা শোক সাহিত্য।
এ কাব্য বেদনার বলেই আমাদের কাছে নন্দনীয় নয়। এ কাব্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় মানুষের কিছু সহজাত প্রবৃত্তি। যেমন— অন্যায়ের প্রতিবাদে জীবনপণ; জীবন দেব কিন্তু ইজ্জত দেব না; জানের চেয়ে মান বড়, তার চেয়ে বড় স্বাধীনতা। হোসেন অত্যাচারী এজিদের অনুগত থাকলে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেন নি। জীবনের বিনিময়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় মানুষ যুগে যুগে ন্যায়ের পক্ষেই বেদনার্ত হয়ে উঠে। মর্সিয়া সাহিত্যে কারবালার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যারা লিখেছেনঃ
১. দৌলত উজির বাহরাম খানের- ইমাম বিজয়;
২. হায়াৎ মাহমুদ- কারবালা কাব্য;
৩. শেখ ফয়জুল্লাহ – যয়নবের চৌতিশা;
8. মুহম্মদ খান মক্তুল হোসেন কাব্য;
৫. আব্দুল আলিম- হানিফার লড়াই;
৬. নজর আলী- হানিফার কারবালা যাত্রা;
৭. আমান উল্লাহ- মোহাম্মদ হানিফার লড়াই ;
৮. নসরুল্লাহ খন্দকার- কারবালা কাহিনী।
‘কারবালা' শব্দটি উচ্চারিত হলেই মুসলমানের সামনে এক বেদনার্ত শোকগাঁথার চিত্র ভেসে উঠে, যা নিয়ে মধ্যযুগের মর্সিয়া সাহিত্য রচিত। আজও তা নানাভাবে আমাদেরকে আন্দোলিত করে, করে শোকার্ত।
প্রশ্নঃ খনার বচন বলতে কী বুঝ ?
উত্তরঃ পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ ও জাতির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য ব্যক্তি বিশেষের একক প্রচেষ্টার ফসল নয়। বিভিন্ন দেশের লোকসাহিত্যের প্রকৃতি বিভিন্ন। লোকসাহিত্য নির্ভর করে প্রত্যেক দেশ-জাতির পেশা/বৃত্তিকে শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্ৰ করেই। অর্থাৎ দেশের মানুষের চালচলন, রীতিনীতি, কর্ম, উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে লোকসাহিত্য। খনার বচন লোকসাহিত্যের উপাদান। খনার বচন মূলত গঠনের দিক থেকে ছড়ার মত। খনার বচনের কিছু কিছু রাবণের নামেও পরিচিত। আসলে খনা বা রাবণ এর কেউই এগুলোর রচয়িতা নয়। কৃষিপ্রধান বাংলায় বিভিন্ন ফসল উৎপন্নের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, ভাল-মন্দ, সুলক্ষণ-দুর্লক্ষণ নিয়ে ছড়া আকারে খনার বচনগুলো সৃষ্টি হয়েছে এবং লোকপরম্পরায় তা চলে আসছে। খনার বচনের সাহিত্যিক মূল্য তেমন নেই, তবে এতে সমাজের একটি বিশেষ ছবি পাওয়া যায়। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে খনার বচনের গুরুত্ব অত্যন্ত প্রবল। এগুলোতে বাস্তবরসের ও জ্যোতিষভাবের লক্ষণ থাকায় আমাদের সমাজের একটি বিশেষ দিকের আলোকপাত করায় এগুলোর মূল্য অনস্বীকার্য। দীর্ঘদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফলে এগুলো সৃষ্ট বলে এগুলোর মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। এগুলো এক ধরনের বিজ্ঞানও বটে। কেননা খনার বচনগুলো দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল। যেমন
ঃ
কলা রুয়ে না কাট পাত
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
অর্থাৎ, কলাগাছ রোপণ করে যদি পাতা কাটা না হয়, তাতে প্রচুর কলা জন্মে। কিন্তু পাতা কাটলে কলা ফলে না ৷
যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।
অর্থাৎ, মাঘ মাষের শেষে যদি বৃষ্টি হয় তবে দেশে ভাল ফসল হয় এবং দেশ ফসলে সমৃদ্ধ হয়৷
হাতে বিশে করি ফাঁক।
আম-কাঁঠাল পুঁতে রাখ।
গাছাগাছি ঘন সবে না।
ফল তাতে ফলবে না।
অর্থাৎ, আম বা কাঁঠাল চারা একটা থেকে অন্যটা বেশ ফাঁকে লাগাতে হয়। ঘন গাছের পিঠে গাছ থাকলে আম-কাঁঠাল গাছে ভাল ফল ধরে না। মূলত খনার বচন কৃষিজীবী মানুষের চাষবাসের নির্দেশক।
প্রশ্নঃ সেকশুভোদয়ার পরিচয় দাও৷
উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যার ভাষা বাংলা। প্রাচীন যুগে অর্থাৎ ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চর্যাপদের মত অন্য কোন গ্রন্থ না পাওয়া গেলেও বেশ কিছু নিদর্শনের পরিচয় মেলে। সেসব নিদর্শনের মধ্যে ‘সেকশুভোদয়া' অন্যতম। এ সময়ের বাংলা ভাষা অবিমিশ্র নয়। প্রাকৃত ভাষা থেকে অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে আসামী, উড়িয়া, ভোজপুরিয়া এরূপ বহু প্রাচ্য ভাষার সংমিশ্রণে ‘সেকশুভোদয়া' রচিত বলে ভাষাবিদদের ধারণা। ‘সেকশুভোদয়া' লক্ষ্মণসেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচনা। এ গ্রন্থের প্রথম দিকে কয়েকটি বাংলা গান ও চর্যার উল্লেখ আছে। এর কোনটি মাহাত্মা গান কোনটি বা প্রেমমূলক। সেকশুভোদয়া মূলত প্রাচীন যুগের কিছু সংগীতের সমষ্টি। সেকশুভোদয়াকে অনেকে প্রাচীন নয় বলে মনে করেন।
0 মন্তব্যসমূহ