প্রশ্নঃ লাইলী-মজনু কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তরঃ মধ্যযুগের বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার শ্রেষ্ঠ সম্পদ দৌলত উজির বাহরাম খাঁ বিরচিত ‘লাইলী-মজনু' (১৫৪৫-৫৩ খ্রিঃ)।
লাইলী-মজনুর প্রণয় কথা একটি কল্পিত উপাখ্যান। এই অপরূপ উপাখ্যানটি কার মানস সন্ততি, তা জানার উপায় নেই। আরবি সাহিত্যের ইতিহাস এ উপাখ্যান সম্বন্ধে নীরব লাইলী-মজনু সম্পর্কে কোন কিংবদন্তীও চালু নেই আরবে। ফুলে বলা যায়, এ কাহিনী আরব উদ্ভূত নয়, যদিও ঘটনাস্থল আরব এবং পাত্রপাত্রী আরবীয়। কাব্যটির মূল কাহিনী ফারসি কাব্য থেকে গৃহীত হলেও মূলত এ কাব্যের আদি রচয়িতাকে সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এটুকু বুঝা যায় যে, ফারসি নানা কাব্যে এ কাহিনী ছড়ানো থাকায় কবি তা থেকে মূল কাহিনী নিয়ে কাব্যটিকে বাঙালি সমাজজীবন সাপেক্ষে নির্মাণ করেছেন । মধ্যযুগের সাহিত্য ক্ষেত্রে লাইলী-মজনু নানা গুণে অনন্য। এ কাব্য বাল্যপ্রেমে অভিশপ্ত দুই বিরহী হৃদয়ের রক্তক্ষরা বেদনার জমাট অশ্রু। এর গীতোচ্ছ্বাস, এর কারুণ্য, নীতিনিষ্ঠ মানবিকতা পাঠককে অভিভূত করে।
আরবের ধনী আমীরের পুত্র কএস একটু বড় হয়ে পাঠশালায় গেলে সেখানে লাইলীর সাথে তার সাক্ষাৎ। দু'জন দু'জনকে ভালবাসতে শুরু করে। বিদ্যার্জন অপেক্ষা প্রেমপাঠই তাদের কাছে মুখ্য এবং শপথ করে এ প্রেম তাদের ভঙ্গ হবে না কোনদিন। লাইলীর পাঠশালা বন্ধ হয়ে যায়। মজনু গোপনে দেখা করতে গিয়ে লাইলীর বাবার লোকজনের হাতে মার খায় এবং দেওয়ানা হয়ে সে নজদবনে গিয়ে দিন কাটায়। জোর করে লাইলীর বিয়ে দিলেও সে স্বামীকে পদাঘাত করে। নজদবনে লাইলী মজনুর কাছে গিয়ে পরিণয়ে আবদ্ধ হতে বলে। মজনু লাইলী লাইলী বলে তরুলতাকে জড়িয়ে ধরে, লাইলী ধ্যানে সে জগৎ সংসার নিরপেক্ষ, কিন্তু ব্যক্তি-লাইলীকে সে বিয়ে করতে সম্মত হয় না। কারণ যে বিশেষ লাইলীর ধ্যান করে এখন নির্বিশেষ লাইলীকে খোঁজে। কাব্যটি সুফি দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। লাইলী শেষ পর্যন্ত মারা যায়। মজনুও তার কবরের কাছে এসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
লাইলী-মজনু কাব্যের বিশেষত্ব এখানে যে, কবি লাইলীর বারমাসি বর্ণনায় চৌতিশার ব্যবহার করেছেন। যে কোন বর্ণ দিয়ে শুরু করে ৩৪টি পদ একই বর্ণে রচিত।
কাব্যটির কাহিনী আরবের হলেও লেখক তাকে বাঙালি সমাজের রীতিনীতিতে মেপেছেন। এ কাব্যে লাইলী নারী হয়ে যতটা সক্রিয় মজনু ততটা নয়। সে প্রেমে উন্মাদ হয়েছে, কিন্তু প্রেম সংঘটনে সক্রিয় হয় নি। ফলে মজনুর মধ্যে পৌরুষের অভাব পরিলক্ষিত হয়। কাহিনীটিতে মজনুর জন্য দুঃখ পায়। ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয় নি। তবে লাইলী চরিত্রের সক্রিয়তা আমাদের বিমুগ্ধ করে।
লাইলী-মজনু প্রেমের কাব্য হিসেবে আমাদের কাছে মাইলফলক। হাসতে হাসতে প্ৰেম করে দুটি জীবন কাঁদতে কাঁদতে শেষ- এ মহিমাটুকু কাব্যের শরীরে প্রোথিত। তাছাড়া কবির কবিত্বশক্তি কাব্যটিকে উত্তীর্ণ করেছে।
0 মন্তব্যসমূহ