হিসাবের প্রাথমিক বই বা Primary Books of Account কী? এর শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ কর


প্রশ্নঃ হিসাবের প্রাথমিক বইয়ের ধারণা ও শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর। 
Concept of Primary Books of Account and its Classification 

উত্তরঃ হিসাববিজ্ঞান প্রক্রিয়ার প্রথম স্তর হলো জাবেদা। Journal k শব্দটি এসেছে ফরাসি Jour শব্দ থেকে। Jour শব্দের অর্থ দিন। প্রতিদিনের লেনদেন প্রতিদিন লিপিবদ্ধ করা হয় বলে সম্ভবত এর নামকরণ করা হয়েছে Journal। যার বাংলা আভিধানিক অর্থ জাবেদা। সুতরাং জাবেদা হলো হিসাবের প্রাথমিক বই-যাতে লেনদেনগুলো সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে দুতরফা দাখিলার নীতি মোতাবেক ডেবিট ও ক্রেডিট বিশ্লেষণ করে তারিখের ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। লেনদেনগুলোকে সর্বপ্রথম জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয় বলে একে হিসাবের প্রাথমিক বইও বলা হয়। 

অতএব, সাধারণভাবে বলা যায়, কারবারে লেনদেনগুলো সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুযায়ী তা ডেবিট ও ক্রেডিট বিশ্লেষণ করে তারিখের ক্রমানুসারে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ যে বইতে লেনদেনগুলো লেখা হয় তাকে জাবেদা বলে। জাবেদাকে বলা হয়, হিসাবের প্রাথমিক হিসাবের বই, মৌলিক হিসাবের বই, (কেননা লেনদেন মৌলিক আকারে জাবেদায় লেখা হয়) কালীন হিসাবের বই এবং সহকারি হিসাবের বই, প্রথম পর্যায়ের বই, দৈনিক হিসাবের বই বলা হয়। লেনদেন জাবেদাভুক্ত ভুল-ত্রুটি হলে সহজে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়। জাবেদার ব্যাখা দ্বারা লেনদেনের উৎস ও কারণ জানা যায়। জাবেদা দ্বারা খতিয়ান প্রস্তুত করা সহজ হয়। 

প্রাথমিক বইয়ের শ্রেণিবিভাগ 
Sub-division or Classification of Prime books
 
প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় জগতে মাঝারি ও বড় আয়তনের প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকৃতির অসংখ্য লেনদেন সংঘটিত হয়। এগুলো একটি মাত্র জাবেদায় সংরক্ষণ করে খতিয়ানে স্থানান্তর করা সময়সাপেক্ষ, শ্রম ব্যয় ও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এরূপ বাস্তব অসুবিধা দূরীকরণের লক্ষ্যে একটি জাবেদার পরিবর্তে লেনদেনের প্রকৃতি ও ধরনের ভিত্তিতে একাধিক প্রাথমিক বই সংরক্ষণ করা হয়। একে প্রাথমিক বইয়ের শ্রেণিবিভাগ বলা হয়। এভাবে বিভক্ত প্রতিটি প্রাথমিক বইতে বিশেষ প্রকৃতির লেনদেন লিপিবদ্ধ করা হয় বলে একে বিশেষ প্রাথমিক বই বলা হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক বইয়ের শ্রেণিবিভাগ উক্ত প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সংখ্যা ও প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। 

লেনদেনের প্রকৃতি অনুসারে নিম্নরূপে প্রাথমিক বইয়ের শ্রেণিবিন্যাস করা যায়:
চিত্রঃ প্রাথমিক বইয়ের শ্রেণিবিভাগ

লেনদেগুলো হিসাবভুক্ত করা হয় বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে। নিম্নে এ প্রামাণ্য দলিলগুলো নিয়ে আলোচনা করার পর জাবেদার শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করা হবে। 

১. চালান (Invoice): মাল ক্রয় ও বিক্রয়ের প্রামাণ্য দলিলকে চালান বলা হয়। বিক্রেতা ক্রেতার বরাবর বিক্রয়কৃত মালের জন্য চালান প্রস্তুত করে তার এক কপি ক্রেতাকে মালের সাথে হস্তান্তর করে। চালানে কার নিকট পণ্য বিক্রয় করা হলো, কি পরিমাণ পণ্য বিক্রয় করা হলো, কি মূল্যে বিক্রি করা হলো এবং সর্বমোট কত টাকার পণ্য বিক্রয় করা হলো ইত্যাদি তথ্য বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকে। চালানের উপর ভিত্তি করে ক্রয় ও বিক্রয় বই লেখা হয়। চালান অনুযায়ী ক্রেতা ধারে মাল ক্রয় প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রয় বই বা ক্রয় জাবেদায় লিপিবদ্ধ করে এবং বিক্রেতা চালানের সাহায্যে ধারে মাল বিক্রয় প্রাথমিক পর্যায়ে বিক্রয় বই বা বিক্রয় জাবেদায় লিপিবদ্ধ করে। চালানের একটি নমুনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
চিত্রঃ চালান

২. ক্যাশমেমো ও বিল (Cashmemo and Bill): নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লেনদেনের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে বিক্রেতা বিক্রিত পণ্যের বিবরণ, দর, কমিশন, নিট মূল্য ইত্যাদি উল্লেখ করে যে যে ছাপানো রশিদ ক্রেতাকে সরবরাহ করে থাকে তাকে ক্যাশমেমো বলা হয়। ক্যাশমেমো সাধারণত তিন কপি প্রস্তুত করতে হয়। মূলকপি ক্রেতাকে দেয়া হয় এবং কার্বনকপিসমূহ বিক্রেতার নিকট থাকে। বিক্রেতা ধারে পণ্য বিক্রয় করার সময় বিক্রয়কৃত পণ্য মূল্যের জন্য চালানের সাথে বিল ক্রেতার নিকট পরিশোধের জন্য দাখিল করে। ক্রেতা চালান বিল বা ক্যাশমেমো ভাউচারের সাথে সংযুক্ত করে নগদান বইয়ের ক্রেডিট দিকে হিসাবভুক্ত করে।

ক্যাশমেমোর নমুনা (Specimen of Cash memo): 
চিত্রঃ ক্যাশমেমো

৩. ভাউচার (Voucher): বিক্রয়, ক্রয়, খরচ ও আয় নগদান বইতে লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত স্বাক্ষরিত প্রমাণপত্রকে ভাউচার বলা হয়। 

ভাউচারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Play and Larson বলেন, "Voucher is a business paper used is summarizing a transaction and applying it for recording and payment.” 

A.W. Holmes এর মতে, “লেনদেনের সমর্থনে যে লিখিত দলিল থাকে তাকে ভাউচার বলা হয়।”

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায়, হিসাবের খাতায় লিখিত যেকোনো লেনদেনের সমর্থনে রক্ষিত কোনো দলিল বা লিখিত সমর্থনকে Voucher বা প্রমাণপত্র বলা হয়। 

ভাউচার এর শ্রেণীবিভাগঃ ব্যবহারিক দিক হতে ভাউচারকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 
ক. ডেবিট ভাউচার; ও 
খ. ক্রেডিট ভাউচার। 

ক. ডেবিট ভাউচার (Debit Voucher): পণ্য ক্রয় বিভিন্ন প্রকার খরচের জন্য ব্যবহৃত ভাউচারকে ডেবিট ভাউচার বলা হয়। ডেবিট ভাউচার ক্যাশমেমো হতে প্রস্তুত করা হয়। ডেবিট ভাউচারের সাথে চালান ও ক্যাশমেমোর কপিসমূহ সংযুক্ত করা হয়ে থাকে। ডেবিট ভাউচারে ধারাবাহিকভাবে নম্বর প্রদানপূর্বক উক্ত ভাউচার নম্বর নগদান বইয়ের ক্রেডিট দিকে নির্দিষ্ট ঘরে উল্লেখ করে নগদান বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়। নগদান বইয়ের নির্দিষ্ট ঘরে রাখার উদ্দেশ্য হলো যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনে ভাউচার সহজে খুঁজে বের করা যায়। 

কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ খরচ হয়। এসব খরচের সঠিক হিসাব রাখার জন্য ডেবিট ভাউচারের প্রয়োজন হয়। ডেবিট ভাউচারের মাধ্যমে নগদান বই সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া ডেবিট ভাউচার খরচের প্রামাণ্য দলিল।

ডেবিট ভাউচারের নমুনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
চিত্রঃ ডেবিট ভাউচার

খ. ক্রেডিট ভাউচার (Credit Voucher): পণ্য বিক্রয় ও বিভিন্ন প্রকার আয়ের জন্য ব্যবহৃত ভাউচারকে ক্রেডিট ভাউচার বলা হয়। ক্রেডিট ভাউচারের সাথে চালানের কপি ও ক্যাশমেমো বা প্রাপ্তি রশিদ সংযুক্ত করে তাতে প্রয়োজনীয় নম্বর প্রদান করে ক্যাশবুকের ডেবিট দিকে লিখা হয়। ক্রেডিট ভাউচারের নম্বর ক্যাশবুকের ডেবিট দিকে নির্দিষ্ট ঘরে লিখা থাকে যাতে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে ক্রেডিট ভাউচারটি সহজে খুঁজে বের করা যায়। ক্রেডিট ভাউচার একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্ত আয়ের প্রামাণ্য দলিল। ক্রেডিট ভাউচার হতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আয়ের উৎস জানা যায়। ক্রেডিট ভাউচারের সাহায্যে নগদান বই লেখা হয়। 

ক্রেডিট ভাউচারের নমুনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
চিত্রঃ ক্রেডিট ভাউচার

৪. জার্নাল ভাউচার (Journal Voucher): সকল অ-নগদ লেনদেন লিপিবদ্ধ করতে ব্যবহৃত ভাউচারকে জার্নাল ভাউচার বলা হয়। জার্নাল ভাউচারের সাথে সংশ্লিষ্ট লেনদেনের সমর্থনসূচক প্রমাণপত্র সংযুক্ত থাকে বা প্রমাণপত্রের সূত্র উল্লেখ থাকে। ডেবিট-ক্রেডিট ভাউচারের ন্যায় জার্নাল ভাউচারেরও ধারাবাহিকভাবে ভাউচার নম্বর প্রদানপূর্বক সাধারণ খতিয়ানে তা একবার ডেবিট দিকে এবং আরেকবার ক্রেডিট দিকে লিপিবদ্ধ করা হয়। খতিয়ানের নির্দিষ্ট ঘরে ভাউচার নম্বর উল্লেখ করা হয় যাতে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে ভাউচার সহজে খুঁজে বের করা যায়। 

জার্নাল ভাউচারের ছক নিম্নে দেয়া হলো:
চিত্রঃ  জার্নাল ভাউচার

সাধারণ ক্যাশিয়ার প্রস্তুত করে এবং ব্যবস্থাপক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ভাউচারটি হিসাবভুক্ত করার সময় হিসাবরক্ষক এতে স্বাক্ষর প্রদান করে। একইভাবে ক্রেডিট ভাউচার লেখার সময়, যার কাছ থেকে আয়ের টাকা পাওয়া গেল তার নাম এবং আয়ের বিস্তারিত বিবরণ লিখতে হয়। ক্রেডিট ভাউচারও ক্যাশিয়ার প্রস্তুত করেন এবং হিসাবভুক্ত করার সময় হিসাবরক্ষক এতে স্বাক্ষর দিয়ে থাকেন। ডেবিট ও ক্রেডিট ভাউচারে অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে আলাদা আলাদা নম্বর প্রদান করতে হয়। 

৫. ডেবিট নোট (Debit note): ক্রয়কৃত মাল যখন ক্রেতা কারণবশত বিক্রেতাকে ফেরত পাঠায় তখন উক্ত ফেরত মালের পূর্ণ বিবরণ যথা: মালের পরিমাণ, দর ও মূল্য ইত্যাদি একখানা কাগজে লিখে তা উক্ত মালের সাথে বিক্রেতার কাছে প্রেরণ করে এবং বিক্রেতাকে অবহিত করা হয় যে, তার হিসাব খাত উক্ত ফেরত মালের জন্য ডেবিট করা হয়েছে। ক্রয়কৃত পণ্য ফেরতের জন্য ব্যবহৃত এরূপ কাগজকে ডেবিট নোট বলা হয়। ডেবিট নোট চালান থেকে আলাদা করে দেখানোর জন্য সাধারণত লালকালি ব্যবহার করা হয়। ডেবিট নোটের সাহায্যে ক্রয় ফেরত বই লেখা হয়।

নিম্নে ডেবিট নোটের একটি নমুনা দেয়া হলো: 
চিত্রঃ ডেবিট নোট

৬. ক্রেডিট নোট (Credit Note): বিক্রেতার কাছে বিক্রিত মাল ফেরত আসলে সে উক্ত ফেরত মালের সম্পূর্ণ বিবরণ যথা-মালের পরিমাণ, দর ও মূল্য উল্লেখ করে একটি কাগজে লিখে ক্রেতার কাছে প্রেরণ করে এবং তাকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, তার বা তাদের হিসাবখাত উক্ত ফেরত মালের মূল্যের জন্য ক্রেডিট করা হয়েছে। একে ক্রেডিট নোট বলা হয়। ক্রেডিট নোট থেকে বিক্রয় ফেরত বই লিপিবদ্ধ করা হয়। 

নিম্নে ক্রেডিট নোটের একটি নমুনা দেয়া হলো:
চিত্রঃ ক্রেডিট নোট


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক