প্রশ্নঃ ব্রজবুলি কী? সংক্ষেপে ব্রজবুলি ভাষার স্বরূপ নির্ণয় কর।
উত্তরঃ বৈষ্ণব পদাবলী বাঙালির প্রাণের সাহিত্য। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক পদাবলী মধ্যযুগের সীমানা অতিক্রম করে আধুনিক যুগেও নন্দিত। বৈষ্ণব কবিরা শুধু এদেশের নয় বরং চিরন্তন মানব-মানবীর প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা-মিলন-বিরহসহ হৃদ্যিক অনুভূতি বিশেষ প্রযত্নে তুলে ধরেছেন। পদাবলীর এক বিশেষ গুণ এর ভাষা ব্যবহার। বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরও কিছু মিশ্র ভাষার পদ বাংলা পদাবলী সাহিত্যকে বিশিষ্ট ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্রজবুলি ভাষা। বাংলা ও মৈথিলী ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক হৃদয়গ্রাহী ভাষার নামই ব্রজবুলি ভাষা। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক পদ রচনাতেই কেবল এ ভাষা ব্যবহৃত হত। অন্য কোন ক্ষেত্রে এ ভাষার প্রয়োগ নেই। লোক বিশ্বাস যে, দূর অতীতে ব্রজধামে রাধা ও কৃষ্ণ যে ভাষায় তাদের হৃদয়ের আর্তি জানাত, অর্থাৎ প্রেম বিনিময় করত সেটাই ব্রজবুলি। অন্যভাবে বললে, ব্রজধামের বুলিকে ব্রজবুলি বলে আসলে এ ধারণাটি সম্পূর্ণত ভুল। ব্রজবুলি রাধা ও কৃষ্ণের ব্রজলীলার ভাষা যেমন নয়, তেমনি কোন জনগোষ্ঠির ভাষাও নয়। মূলতপক্ষে ব্রজবুলি এবং ব্রজভাষা (ব্রজবাসীর ভাষা) সম্পূর্ণ পৃথক।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে, ব্রজবুলির মূলে আছে প্রধানত দুটি ভাষা— অবহট্ঠ ও মৈথিল। ব্রজবুলি ভাষায় মৈথিল অংশ বেশি। এ মৈথিল ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর ভাষা, বিদ্যাপতি এই ভাষা অবলম্বন করেছিলেন। তবে পনেরো শতকের শেষপাদ হতে অবহট্ঠ মিশ্রিত রীতিতে পদ রচনার রেওয়াজ বিহার-বাংলা-উড়িষ্যা-আসাম-নেপালে চালু ছিল। কৃত্রিম রীতি চালু করার দুটি প্রধান কারণ-
(১) সাহিত্যিক লালিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন।
(২) পূর্ব-দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে জনবোধ্য করার উদ্দেশ্যেই কৃত্রিম মিশ্র ভাষার উদ্ভাবন ও সচেতন প্রয়োগ।
মুখ্যত, বিদ্যাপতির ললিত মধুর পদাবলীই (যা ব্রজবুলিতে লিখিত) বৈষ্ণবদের মনোহরণ করে এবং তা বৈষ্ণব পদকার বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য গোবিন্দদাসের বহুল প্রয়োগে বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সম্ভবত তাদের বাসনা ছিল উত্তর ভারতেও তাদের রচিত পদ গণবোধ্য ও লোকগ্রাহ্য হয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত প্রসারে সহায়ক হবে।
ব্রজবুলি অত্যন্ত শ্রুতিসুখকর ধ্বনিমাধুর্যপূর্ণ ভাষা। ফলে বিদ্যাপতির পর গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম দাস, জগদানন্দ, রায় শেখর প্রমুখ পদকারগণ ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন।
মৈথিল সুপ্রসিদ্ধ কবি বিদ্যাপতির পদাবলী বাংলাদেশে ব্রজবুলি ভাষার কারণে জনপ্রিয় হলে অনেকেই এ ভাষায় পদ রচনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মৈথিলী ভাষার স্বরূপটি ভালো করে বুঝে উঠতে না পারায় তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা প্রকৃত মৈথিলী ভাষার স্বার্থে বাংলা ভাষার সহযোগে ব্রজবুলি ভাষা গড়ে ওঠে। ব্রজবুলি ভাষায় কিছু বৈষ্ণব পদের দৃষ্টান্ত-
১। কবহু বান্ধএ কচ কবহু বিথারি
কবহু ঝাঁপএ অঙ্গ কবহু উঘারি।
(বিদ্যাপতি)
২। কণ্টক গাড়ি কমল সম পদতল
মঞ্জী চিরহি ঝাঁপি।
গাগরী-বারী ঢারি করি পিছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।
(গোবিন্দদাস)
৩। যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।
(বিদ্যাপতি)
8. এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।
(বিদ্যাপতি)
0 মন্তব্যসমূহ