অথবা, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের তত্ত্বের ব্যাখ্যা দাও।
ভূমিকাঃ আমরা প্রতিনিয়ত ব্যক্তিত্ব শব্দটির মুখোমুখি হই। প্রায়ই আমরা বলি ‘অমুকের ব্যক্তিত্ব চমৎকার'। এই বাক্য দ্বারা ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির আচরণের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের একটি সামগ্রিক রূপ। যেমন ব্যক্তির দোষ, গুণ, সামর্থ্য, চেহারা, বিশ্বাস, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, আবেগ ইত্যাদি। এককথায় ব্যক্তির সারসত্তাই হলো ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তিত্বের মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psycho analysis theory of personality): ব্যক্তিত্বের অনুধ্যানে ফ্রয়েডের প্রভাব এত বেশি যে ফ্রয়েডের কোনো না কোনো ধারণা ব্যবহার না করে ব্যক্তিত্বের ব্যাখ্যা কষ্টকর। (Sigmund Freud (1856-1939) যে মতবাদ প্রবর্তন করেন, তাকে মনোসমীক্ষণ মতবাদ নামে অভিহিত করা হয়। আসলে মনোসমীক্ষণ ছিল Freud এর একটি মনোচিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সাহায্যে তিনি মানসিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করতেন। মনোসমীক্ষণ মতবাদ ব্যক্তিত্বের তিনটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছে।
(১) ব্যক্তিত্বের গঠন (Structure of personality)
(২) ব্যক্তিত্বের বিকাশ (Development of personality)
(৩) ব্যক্তিত্বের গতিশীলতা (Dynamics of personality)
নিম্নে প্রত্যেকটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
(১) ব্যক্তিত্বের গঠন (Structure of personality): Freud-এর মতানুসারে ব্যক্তিত্বের গঠন তিনটি উপাদানে বিভক্ত। যথাঃ (ক) ইদম (id) (খ) অহম (ego) এবং (গ) অধিসত্তা (Super ego)
ব্যক্তিত্বের উক্ত তিনটি সত্তা একে অন্যটি থেকে স্বাধীন নয়। উক্ত তিনটি সত্তার সমন্বিত ক্রিয়ার ফলেই ব্যক্তির স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পায়।
(ক) ইদম (id): ইদম হলো ব্যক্তিত্বের আদিম সত্তা। ইদম হতে অহম এবং অধিসত্তার সৃষ্টি। এটি মানসিক শক্তির আধাররূপে কাজ করে। আমাদের কামনা-বাসনার সমষ্টিই হলো ইদম। পরিণতি যাই হোক না কেন, ইদম সর্বদা সুখি নীতিতে (Pleasure principle) বিশ্বাসী। যখন ব্যক্তির কোনো কামনা-বাসনার সৃষ্টি হয়, ইদম তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি কামনা করে থাকে। ইদমের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর কোনো বাস্তবতা জ্ঞান নেই। এটা ব্যক্তির অবচেতন আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্টি হয়।
(খ) অহম (Ego): অহম ব্যক্তিত্বের সচেতন অংশ। একে বস্তুগত এবং সামাজিক পরিবেশের বাস্তবতার সাথে বোঝাপড়া করে চলতে হয়। ইদম চায় তার আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি; কিন্তু সে নিজে তা পূরণ করতে পারে না। অহমই এটা করে থাকে। অহম আসলে ব্যক্তির কার্যনির্বাহী সত্তা, এর দ্বারা ব্যক্তির সকল কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত সত্তা। অহমের দু'টি প্রভু– ইদম ও অধিসত্তা। এ দুই প্রভুর মন যুগিয়ে তাকে চলতে হয়। উক্ত দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশ হয়। অন্যথায় ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় দেখা দেয়।
(গ) অধিসত্তা (Super ego): ব্যক্তিত্ব গঠনের সর্বশেষ অবস্থা হলো অধিসত্তা। একে অনেকসময় বিবেক বলা হয়। সামাজিক মূল্যবোধ স্বীকার করার ফলে অধিসত্তার সৃষ্টি হয়। অধিসত্তা হলো ব্যক্তিত্বের নৈতিক শক্তি। বাস্তব অপেক্ষা আদর্শের সাথে অধিসত্তার সম্পর্ক বেশি। এটা সর্বদা আরাম আয়েস অপেক্ষা পূর্ণতার পেছনে ছোটে। অধিসত্তা অনেক সময় ব্যক্তিত্বের জন্য সমস্যারূপে দেখা দেয়।
(২) ব্যক্তিত্বের বিকাশ (Development of personality): ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব বিকাশের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেন এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশে শৈশব এবং প্রথম শৈশবকালের ভূমিকার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেন। ব্যক্তিত্ব বিকাশের সময়কে ফ্রয়েড মোটামুটি চারটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। স্তর চারটি নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
(ক) মুখ কাম স্তর (Oral stage): শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে সর্বপ্রথম স্তর হলো মুখ-কাম স্তর। প্রথম বছরে শিশু স্তন্য পান করে এবং পরে দাঁত দিয়ে কামড়ে আহায্য গ্রহণ করে। ফ্রয়েড মনে করেন, স্তন্যপান এবং চর্বনক্রিয়ায় শিশুরা যে আনন্দ পায় সেটা যৌন তৃপ্তিরই নামান্তর। তিনি আরও বলেন, শিশুর এই মুখ-কাম স্তরে কোনো বাধার সম্মুখীন হলে তার পরবর্তী জীবনে আক্রমণাত্মক আচরণ বিকাশ লাভ করে। সে তর্ক করা, বক্তৃতা দেয়া এবং মদ্যপান বা সিগারেট খাওয়া ভালোবাসে।
(খ) পায়ুকাম স্তর (Anal stage): শিশুর বয়স যখন ১ থেকে ৩ বছর তখন শিশুকে স্তন পান থেকে বিরত রাখা হয়। এসময় সে যৌন তৃপ্তির পথ হিসেবে পায়ুদ্বারের উদ্দীপনাকে বেছে নেয়। কিন্তু পিতামাতার কঠোর শাস্তির জন্য সে এসব প্রক্রিয়া অবদমিত করে ফেলে এবং কোষ্ঠবদ্ধ রেখে যৌন তৃপ্তির বিকল্প পথ আবিষ্কার করে। এ বয়সের কঠোর শাস্তি শিশুকে ভবিষ্যৎ জীবনে মলত্যাগের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলতে পারে যা পরিণত জীবনে কৃপণতা, অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
(গ) আত্মরতি স্তর (Phallic stage): ৩ থেকে ৬ বছর বয়সে শিশুর যৌনতৃপ্তির কেন্দ্র হলো যৌনাঙ্গ। এ বয়সে শিশু নিজের যৌন অঙ্গকে উদ্দীপিত করে আনন্দ পায়। এটাকে আত্মরতি স্তর এ কারণে বলা হচ্ছে যে শিশু নিজের যৌন অঙ্গের উদ্দীপনা থেকে যৌন সুখের উৎস আবিষ্কার করে। এ বয়সে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। ছেলে শিশু মায়ের প্রতি এবং মেয়ে শিশু বাবার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এ দু'টি ঘটনাকে যথাক্রমে ইডিপাস ও ইলেকট্রা কমপ্লেক্স বলা হয়।
(ঘ) যৌনস্তর (Genital stage): এটা ব্যক্তিত্ব বিকাশের সর্বশেষ পর্যায়। এখানে সরাসরি যৌনাঙ্গের ব্যবহারের মাধ্যমে বিপরীত লিঙ্গকে ব্যবহার করে যৌনসুখ অনুভব করে। যৌবনে মেয়েরা ছেলেদের প্রতি এবং ছেলেরা মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়। কিন্তু ইডিপাস কমপ্লেক্সের সময় শিশুকে যদি কঠোরভাবে শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে যৌবনে তার মধ্যে সমকামিতা দেখা যায়।
তত্ত্বটির সমালোচনাঃ ফ্রয়েড মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব ঐ সময় সমালোচনার ঝড় তোলে। নিম্নে তার তত্ত্বের কতকগুলো ত্রুটি দেয়া হলোঃ
(১) তার তত্ত্বের প্রথম সমালোচনা হলো তার মতবাদ সম্পূর্ণরূপে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত রোগীর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
(২) ফ্রয়েড কখনও শিশু নিয়ে গবেষণা করেননি বরং বয়স্ক ব্যক্তি থেকে তার শৈশব সম্পর্কে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত।
(৩) তিনি সকল পর্যবেক্ষণ অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে করেছিলেন।
(৪) তিনি ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রকাশের মধ্যে যৌন শক্তির প্রাধান্য দিয়েছেন।
(৫) এ মতবাদের অনেক অংশকে অভিজ্ঞতার আলোকে যাচাই করে দেখা সম্ভব নয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, Frued-এর মতবাদের বিরুদ্ধে যত সমালোচনাই থাক না কেন কেউই তার মতবাদকে অসমতা বলে প্রমাণ করতে পারেনি। বরং তার মতবাদের ফলে মনোবিজ্ঞানের ব্যক্তিত্বের গবেষণায় আরও বেশি বলবৃদ্ধি করেছে। তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো অবচেতন মনের আবিষ্কার।
0 মন্তব্যসমূহ