বার্ন কনভেনশনের ঐতিহাসিক পটভূমি, উদ্দেশ্য ও মূলনীতি আলোচনা কর


প্রশ্নঃ বার্ন কনভেনশনের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা কর। বার্ন কনভেনশনের উদ্দেশ্য কী? এ কনভেনশনের আওতায় কপিরাইট সংরক্ষণের নীতিগুলো কী কী? উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এ মূল কনভেনশন ও ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশনের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে কোনটা প্রাধান্য পাবে?

Discuss the historical background of the Berne Convention. What is the purpose of the Berne Convention? What are the basic principles for copyright protection under this convention? Are there any provisions in this convention for developing countries? Convention and the Universal copyright convention which one shall prevail?

বার্ন কনভেনশনের ঐতিহাসিক পটভূমিঃ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কপিরাইট সংরক্ষণের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে। কিন্তু সংরক্ষণের নীতিগুলো সকল ক্ষেত্রে একই রকমের কিংবা অভিন্ন ছিল না। মুদ্রণ শিল্পের প্রসারের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোতে বই নকল করে প্রকাশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিভিন্ন দেশের জন্য একটি অভিন্ন কপিরাইট সংরক্ষণ নীতি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কতিপয় রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে একটি সম্মেলন করে ১৮৮৬ সালে বার্ন কনভেনশন গঠন করে। এ কনভেনশনের পূর্ণ নামকরণ করা হয় The Berne Convention for the Protection of Literary and Artistic Works, 1886. 

১৮৯৬ সালে প্যারিসে, ১৯০৮ সালে বার্লিনে সংশোধিত হবার পর ১৯১৪ সালে বার্নে সম্পূর্ণ করা হয়। আবার ১৯২৮ সালে রোমে, ১৯৪৮ সালে ব্রাসেলসে, ১৯৬৭ সালে স্টকহোমে, ১৯৭১ সালে প্যারিসে এবং সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে সংশোধিত হয়। বিশ্বের সকল দেশের জন্য এ ইউনিয়নের সদস্যপদ উন্মুক্ত রাখা হয়। অনুসমর্থন বা যোগদানের দলিল ওয়াইপোর মহাপরিচালকের নিকট জমা রেখে এর সদস্য হওয়া যায়। ৪ মে, ১৯৯৯ তারিখে বাংলাদেশ এ ইউনিয়নের সদস্যভূক্ত হয়।

বার্ন কনভেনশনের উদ্দেশ্যঃ বার্ন কনভেনশনের প্রস্তাবনা বলা হয়েছে যে, ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের সাথে শিল্পকর্মের রচয়িতাদের যতদূর সম্ভব একই ধরনের ও কার্যকর সুরক্ষা প্রদানই হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য। ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, যে সকল রাষ্ট্রে এই কনভেনশন প্রযোজ্য হবে তাদের সমন্বয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হবে। কাজেই একটি ইউনিয়ন গঠন এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহে সাহিত্য ও শিল্পকর্মের রচয়িতা সুরক্ষা প্রদানই হচ্ছে বার্ন কনভেনশনের উদ্দেশ্য।

অনুচ্ছেদ ২ (১) অনুযায়ী রচয়িতাগণের নিম্নোক্ত একচ্ছত্র অধিকার থাকবে (ক) অনুবাদ করার অধিকার (অনু: ৮), (খ) যেকোনো আকারে পুনরুৎপাদনের অধিকার (অনু: ৯), (গ) নাট্যকর্ম, সংগীতকর্মের ক্ষেত্রে তা সম্পাদন করা (অনু: ১১), (ঘ) সম্প্রচার ও জনগণের মধ্যে প্রচার করা (অনু: ১১ bis), (ঙ) জনসম্মুখে আবৃত্তি করা (অনু: ১১ ter), (চ) অভিযোজন করা কর্মটির বিন্যাস করা (অনু: ১২), (ছ) চলচ্চিত্রে অভিযোজন করে তার পুনরাবৃত্তি করা (অনু: ১৪), এ সকল অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়াও বার্ন কনভেনশনে কিছু নৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে রচয়িতার দাবি করা এবং রচয়িতার সম্মান বা সুনাম বিঘ্ন করে এরূপভাবে কর্মটির উৎপাদন বন্ধ করা।

বার্ন কনভেনশনের মূলনীতিঃ বার্ন কনভেনশনের মূলনীতিসমূহ মূলত ৩টি। এগুলো হচ্ছে-

প্রথমত: নাগরিকত্বের সুবিধা প্রদান (National treatment): কোনো কর্মের প্রণেতাকে সেদেশ যেরূপ সুরক্ষা প্রদান করে থাকে, বার্ন কনভেনশনের সকল সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রে একইরূপ সুবিধা পাবে যেন সেই প্রণেতা উক্ত রাষ্ট্রসমূহেরও নাগরিক; অর্থাৎ সদস্যরাষ্ট্রসমুহ তাদের নিজ নাগরিকদের যেরূপ সুবিধা প্রদান করে থাকে সেরূপ সুবিধা এক্ষেত্রে দিবে।

দ্বিতীয়ত: স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা (Automatic protection): কোনো কর্মের প্রণেতাকে অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্র তাদের নিজ নাগরিকের ন্যায় সুরক্ষা প্রদান করবে তার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হবে না; স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটা প্রদান করা হবে।

স্বাধীনভাবে সুরক্ষা প্রদান (Independence of protection): যেদেশে কর্মটির সৃষ্টি হয়েছে সেদেশে কীরূপ সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে তা অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। সদস্যরাষ্ট্র সমূহ তাদের নিজ দেশে যেরূপ সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে তা উক্ত কর্মটির প্রণেতাকে প্রদান করবে। তাই দেখা যায় যে, national treatment automatic protection and independence of protection- এ তিনটি বার্ন কনভেনশনের মূলনীতি।

বার্ন কনভেনশনের অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের প্যারিস এ্যাক্ট নামে খ্যাত সংশোধনীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কিছু বিধান করা হয়। অধিক সংখ্যায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য বার্ন কনভেনশন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা অসুবিধাজনক ছিল কেননা এদেশগুলো এমনিতেই তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে হিমসিম খাচ্ছিল। প্যারিস এ্যাক্টের সংযোজনীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কিছু বিধান করা হয়। এগুলো মূলত অনুবাদ ও বিদেশি কর্মের পুনরুৎপাদন সম্পর্কিত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রচলিত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যেগুলো অন্তর্ভুক্ত শুধুমাত্র যে সকল দেশ এ সুবিধা পাবে।

শিক্ষা গবেষণা বা বৃত্তি প্রদানে এবং যে সকল কর্ম এ কনভেনশনে সুরক্ষিত সে সকল কর্ম সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম সংক্রান্ত ব্যবহারের জন্য পুনরুৎপাদনের উদ্দেশ্যে উন্নয়নশীল দেশসমূহ বাধ্যতামূলক লাইসেন্স প্রদান করতে পারবে। কর্মের কপিরাইটের মেয়াদ শেষ হলে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে এবং কপিরাইটের মালিককে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদান সাপেক্ষে এরূপ লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে সাধারণত যে সকল ভাষায় মানুষ কথাবার্তা বলে শুধু যে ভাষায় অনুবাদ 'করার জন্য লাইসেন্স দেওয়া যায়। যে সকল ভাষা উন্নত দেশে সচরাচর ব্যবহৃত হয় বিশেষ করে ইংরেজি, ফারসি ও স্পেনীয় সে সকল ভাষায় অনুবাদ করতে হলে প্রথম প্রকাশের ৩ বছর অতিক্রান্ত হবার পর এবং সচরাচর ব্যবহৃত হয় না এরূপ ভাষায় অনুবাদ করতে হলে ১ বছর অতিক্রান্ত হবার পর এরূপ লাইসেন্স দেওয়া যায়।

পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে কতদিন পর বাধ্যতামূলক লাইসেন্স দেওয়া যাবে তা কর্মের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। সাধারণত প্রথম প্রকাশনার ৫ বছর পর এর প্রযুক্তিসহ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্র কর্মের প্রথম প্রকাশনার পর ৩ বছর এবং উপন্যাস, নাটক কবিতার জন্য ৭ বছর অতিক্রান্ত হবার পর এরূপ লাইসেন্স দেওয়া হয়।

বাধ্যতামূলক লাইসেন্স ছাড়াও কর্মের মালিকের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত লাইসেন্সও দেওয়া যেতে পারে।

বার্ন কনভেনশন ও ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশনের মধ্যে বিরোধঃ

১৮৮৬ সালে বার্ন কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। একই উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ইউ. সি. সি বা ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশন স্বাক্ষরিত। যদিও ইউ. সি. সি. পরে হয়েছে কিন্তু বার্ন কনভেনশনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। তাই এ দুটি কনভেনশনের মধ্যে বিরোধ দেখা গেলে বার্ন কনভেনশন প্রাধান্য পাবে এবং এটা ইউ. সি. সি কর্তৃক স্বীকৃত্ব। বাংলাদেশ এ দুটো কনভেনশনের সদস্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক