অথবা, রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্বটি আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ সাম্য, মেত্রী, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দিশারী হলেন জ্যা জ্যাক রুশো। রুশোর যুগান্তকারী গ্রন্থ 'Social Contract' পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুগান্তকারী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'Man is born but every where he is chain.' তিনি মনে করেন ব্যক্তি যেহেতু স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে সেহেতু তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা উচিত। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় রুশোর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক চুক্তি মতবাদটি তার দার্শনিক চিন্তার অন্যতম ফসল।
সামাজিক চুক্তিঃ রুশোর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ক চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটে ‘প্রকৃতির রাজ্যকে সম্বল করে।' তিনি বিশ্বাস করেন, প্রকৃতির রাজ্য ছিল পৃথিবীতে স্বার্গের ন্যায়। এই রাজ্যে মানুষ ছিল সুখী, আনন্দ উচ্ছল ও শান্তিময়। মানুষের জীবন ছিল সৎ, স্বাভাবিক ও সুন্দর। মানুষ সুখী, সহজ সরল এবং সততার জীবনে অভ্যস্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক Dunning বলেন, 'In the natural man are to be found the elements of perfect happiness. He is independent, contented and self sufficing.' কিন্তু প্রকৃতিতে এই অবস্থা ক্ষণস্থায়ী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। সাম্য বিনষ্ট হয় এবং মানুষের মধ্যে হিংসা, বিরোধ ও সংঘর্ষ দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় মানুষ। এটাই রুশোর সামাজিক চুক্তি নামে পরিচিত।
সামাজিক চুক্তির শর্তাবলীঃ অন্যান্য চুক্তির ন্যায় রুশোর সামাজিক চুক্তিরও শর্ত রয়েছে। তবে রুশোর সামাজিক চুক্তির শর্ত ছিল দু'টিঃ
(১) রাজনৈতিক সমাজঃ রাজনৈতিক সমাজ ছিল সামজিক চুক্তি মতবাদের প্রথম শর্ত। মানুষ তার দেহ ও সম্পত্তি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য সমগ্র জনসমাজের সমর্থন পেতে নিজেদেরকে এক রাজনৈতিক সমাজে একীভূত করে।
(২) স্বাধীনতার স্বাতন্ত্র্যঃ মানুষ চুক্তি সম্পাদনের সময় যথাসম্ভব স্বাধীনতার স্বাতন্ত্র নিজেদের হাতে রেখে দেয়। এটা রুশোর চুক্তির দ্বিতীয় শর্ত।
চুক্তির বিভিন্ন দিকসমূহঃ রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ ছিল সমাজ সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। রুশোর সমাজিক চুক্তি মতবাদটি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত দিকসমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
(১) একতাঃ সামাজিক চুক্তির ফলে সমাজে একতা সৃষ্টি হয়। এই চুক্তির ফলে সকলে একই পর্যায়ে উপনীত হয়। কারণ তখন জনগণ সমস্ত ক্ষমতা ত্যাগ করে। ফলে সাম্যের সৃষ্টি হয়। হবসের সামাজিক চুক্তিটি অনেকটা একইরূপ। কিন্তু হবসের মতে, রুশোর জনগণ কোন ব্যক্তির নিকট ক্ষমতা ত্যাগ করেনি। বরং তারা সমস্ত সম্প্রদায়ের নিকট ক্ষমতা ত্যাগ করে। অর্জনের জন্যই বর্জন ছিল রুশোর সামাজিক চুক্তির মূলকথা।
(২) সমাজের সঙ্গে জনগণের চুক্তিঃ রুশোর চুক্তির একটি বিশেষ দিক হলো সমাজের সঙ্গে জনগণের চুক্তি। হবসের চুক্তি যেখানে এক ব্যক্তির সাথে জনগণের চুক্তি, সেখানে রুশোর চুক্তি সমাজের সঙ্গে জনগণের চুক্তি। চুক্তির উদ্দেশ্য সমাজ সৃষ্টি করা হলেও এই চুক্তি সমাজের সাথে জনগণের।
(৩) সার্বক্ষণিক ও গতিশীলতাঃ সার্বক্ষণিক ও গতিশীলতা রুশোর সামাজিক চুক্তির একটি বিশেষ দিক। রুশোর চুক্তি কোন বিচ্ছিন্ন চুক্তি নয় বরং তা সার্বক্ষণিক ও গতিশীল। পরবর্তীতে ভবিষ্যত বংশধরগণ স্বাভাবিকভাবেই সম্প্রদায়ের অধীনস্ত হয়। কারণ চুক্তি প্রকৃতিগত কোন বাহ্যিক কর্তৃপক্ষের সাথে নয়। এটি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে প্রত্যেক ব্যক্তির যোগফলের সৃষ্ট সমষ্টির চুক্তি। তাই রুশোর চুক্তিটি সার্বক্ষণিক ও গতিশীল।
(৪) সমষ্টির স্বার্থঃ রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদে সমষ্টির স্বার্থের সমন্বয় ঘটেছে। রুশোর সমাজ নিরংকুশ ক্ষতার অধিকারী বলে এতে ব্যক্তির কোন বিপদ নেই। আর বিপদ হলেও তা একজনের জন্য নয় বরং সকলের জন্য বিপদ। রুশোর সামাজিক চুক্তিতে ব্যক্তির সমস্ত ব্যক্তিগত দিক বর্জনের কথা বলা হয়েছে। এ চুক্তিতে সমষ্টির সাথে যা করণীয় তা করতে বলা হয়েছে মাত্র।
(৫) নৈতিকতার বিকাশঃ রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদে নৈতিকতা বিকাশের কথা বলা হয়েছে। রুশোর অনুসারীদের মতে, চুক্তি কেবল বস্তুগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নয় বরং নৈতিকতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধনের জন্য তারা সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করে।
(৬) গণসার্বভৌমত্ব সৃষ্টিঃ রুশোর মতে, চুক্তি দ্বারা সার্বভৌমত্বের জন্ম হয়। চুক্তির ফলে ব্যক্তি জনগণের সঙ্গে এবং সমাজের সদস্য হিসেবে সার্বভৌমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়।
(৭) জনগণ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশঃ রুশো কিছু বিশেষ অর্থবহ শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে চুক্তির মতবাদকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করেছেন। তিনি বলেছেন, চুক্তির ফলে যে সংস্থার আবির্ভাব ঘটল সেটা হবে রাষ্ট্র। অর্থাৎ জনগণ একবার যদি নিজেদেরকে যৌথ জীবনের সাথে মিশিয়ে দেয় তাহলে তারা সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হয়ে যাবে। তার মতে, চুক্তি থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় সংস্থা সম্পূর্ণরূপে সঠিক কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে।
(৮) সামাজিক চুক্তি অর্থশূন্য নয়ঃ রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তির কার্যকারিতা বা বৈধতা কোন সদস্য অস্বীকার করতে পারে না। এটা একটা অর্থশূন্য ফরমুলা নয়। চুক্তির শর্ত মেনে চলার জন্য প্রত্যেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চুক্তিবদ্ধ প্রতিটি ব্যক্তি যৌথ জীবনযাপনের শর্তে আবদ্ধ।
(৯) চিরস্থায়ী চুক্তিঃ রুশোর মতে, এটা সমষ্টিগত চুক্তি এবং এর উদ্দেশ্য হলো সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। সকলেই সার্বভৌমের অংশ। কাজেই চুক্তি ভঙ্গ বা সার্বভৌমত্ব পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদটির কতিপয় সামলোচনা থাকা সত্ত্বেও এই চুক্তিটির গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না। কেননা এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রের আহ্বান জানিয়েছেন। তার উদাত্ত কণ্ঠে- সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী এই চুক্তির মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছে। আর এই চুক্তির মাধ্যমেই তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক সমাজ গঠন সম্ভব হয়।
0 মন্তব্যসমূহ