চৈতন্যচরিতামৃত কী?


প্রশ্নঃ চৈতন্যচরিতামৃত কী? সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ কোন ক্ষণজন্মা সৃষ্টিশীল মহৎ মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্য নির্মিত হয়, তাকে জীবনী সাহিত্য বলে। সমগ্র মধ্যযুগে কেবল শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকে অবলম্বন করে জীবনী সাহিত্য গড়ে ওঠে। চৈতন্যদেবের জীবনীকাব্য প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় এবং পরে বাংলা ভাষায় রচিত হয়। বৃন্দাবনদাস বাংলা ভাষায় 'চৈতন্যভাগবত' লিখে বৈষ্ণব সমাজে ‘চৈতন্যলীলার ব্যস' বলে সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু গ্রন্থটিতে চৈতন্যদেবের শেষ জীবন সংক্ষিপ্ত আকারে চিত্রিত, সেটাকে বিস্তৃত করার মানসে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত জীবনীকাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের এ মহাগ্রন্থ শুধু মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেরই এক অনবদ্য শ্রেষ্ঠ জীবনীকাব্য। শুধু জীবনীকাব্যই নয়, এত সুগভীর পাণ্ডিত্য, দার্শনিকতা, ভক্তিশাস্ত্রে অতন্ত্র নিষ্ঠা শুধু সে যুগে নয়, সর্বযুগে বিরল। মননের ভাষা, দার্শনিক প্রকাশ ভঙ্গিমা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রভৃতির স্বাক্ষর গ্রন্থটিতে রয়েছে। তাই চৈতন্যচরিতামৃত শুধু জীবনীকাব্যরূপেই নয়, বরং গৌড়, উৎকল, বৃন্দাবন, দক্ষিণভারত এই সমস্ত অঞ্চলের ভক্তিধর্ম ও দার্শনিকতাকে তিনি যেভাবে দক্ষতার সাথে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, তা সমগ্র মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাহিত্যে দুর্লভ। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দশখানি গ্রন্থের মধ্যে এটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ অকৃতদার আদর্শ বৈষ্ণব। নিত্যানন্দের স্বপ্নাদেশ লাভ করে তিনি গৃহত্যাগ করে বৃন্দাবনে গিয়ে ভক্তিশাস্ত্র ও বৈষ্ণবশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। গ্রন্থে নিত্যানন্দকে তিনি গুরু বলে বন্দনা করেছেন। বৃন্দাবনের আচার্য ও গুরুদের বিশেষ অনুরোধে বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবতের সংক্ষিপ্ত অংশকে বিস্তৃত করে রচনা করতে তিনি সম্মত হন।

‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থটির রচনাকাল নিয়ে নানা মত আছে। কাব্যটির শেষে উল্লেখিত সংস্কৃত শ্লোকানুসারে এর রচনাকাল দাঁড়ায় ১৬১২ বা ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দ। কেউ কেউ বলেন ১৫৬০–১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। কৃষ্ণদাস রচিত অন্যান্য গ্রন্থ, চরিতামৃতে উল্লেখিত বৈষ্ণব আচার্যের তালিকা, বৃন্দাবনে গোবিন্দ মন্দিরের উল্লেখ ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট বলা যায় যে, কাব্যটি ১৫৯০-৯২ খ্রিস্টাব্দের পর রচিত। সম্পূর্ণ হতে অনেক দিনই লেগেছে। কাব্যটিতে মোট বাষট্টি অধ্যায়। কবির ইচ্ছে ছিল যে, বুন্দাবনদাস যে সমস্ত বর্ণনা বিস্তৃত করেছেন সেগুলো বাদ দিয়ে কেবল চৈতন্যের শেষ জীবন বিস্তৃত লিখবেন, কিন্তু চৈতন্যের প্রথম জীবনের কাহিনী বাদ দিলেও— বৈষ্ণব দর্শন, ভক্তিশাস্ত্র ও চৈতন্যতত্ত্ব নিয়ে এত গভীর আলোচনায় মত্ত হয়েছেন যে গ্রন্থের আয়তন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া কবি অতিশয় বৃদ্ধ, ফলে গ্রন্থের অন্ত্যখণ্ডে বিস্তারিত বলার সুযোগ পান কি না, তাই আদি ও মধ্যখণ্ডে বহু কাহিনী তিনি কেবল স্পর্শ করে গেছেন।

কিন্তু অন্ত্যখণ্ডে তিনি দিব্যোন্মাদ, দশাগ্রস্ত চৈতন্যদেবের অন্তর্জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবরসের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। তদুপরি কাব্যটিতে চৈতন্য জীবনের গভীর তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও পরিণাম, ভক্তিশাস্ত্র, দর্শন ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের মূল তত্ত্বকথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা মেলে। বৈষ্ণবের রস সাধনা, রাধা-কৃষ্ণের যুগল রসতত্ত্ব, সখী সাধনা, চৈতন্যাবতারের তাৎপর্য প্রভৃতি দার্শনিক তত্ত্বকথাকে তিনি সরলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পাণ্ডিত্যের সাথে বিনয়, জ্ঞানের সাথে প্রেম, মননের সাথে হৃদয়ানুরাগ তার এ কাব্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে। চৈতন্যদর্শন ও চৈতন্যজীবনী কাব্য হিসেবে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' কাব্য বাংলাদেশে ও সাহিত্যে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক