কপিরাইট বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে কপিরাইট আইনের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা কর


প্রশ্নঃ কপিরাইট বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে কপিরাইট আইনের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা কর। 

What do you mean by copyright? Discuss the historical background of copyright law in Bangladesh.

কপিরাইটঃ শাব্দিক অর্থে কপিরাইটের অর্থ কপি করার অধিকার অর্থাৎ পুনরুউৎপাদন করার অধিকার। অনেকে কপিরাইটের বাংলা প্রতিশব্দ গ্রন্থস্বত্ব বলেন। কপিরাইটের ধারণার যখন উদ্ভব হয় তখন মূলত গ্রন্থকারের স্বার্থরক্ষার জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে এর বাংলা প্রতিশব্দ গ্রন্থস্বত্ব হয়ত সঠিক ছিল। বর্তমানে এ আইনের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এখন কপিরাইট বলতে কতিপয় কর্মের ওপর কতিপয় স্বার্থরক্ষার জন্য একচ্ছত্র আইনগত অধিকার বুঝায়। তাই কপিরাইটের বাংলা প্রতিশব্দ এখন আর গ্রন্থস্বত্ব সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় না। উপযুক্ত প্রতিশব্দ প্রবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত একে কপিরাইট বলাই শ্রেয়৷

কপিরাইট আইন, ২০০০ এর ২ (৬) ধারায়— বলা হয়েছে যে, ‘কপিরাইট' অর্থ এ আইনের অধীনে কপিরাইট। আর ১৪ ধারায় বলা হয়েছে এ আইনের উদ্দেশ্যে 'কপিরাইট' অর্থ নিম্নরূপঃ

(১) সাহিত্য, নাট্য ও সংগীত কর্মের ক্ষেত্রেঃ (ক) যেকোনো উপায়ে ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে কর্মটি সংরক্ষণ করাসহ যেকোনো বস্তুগত আঙ্গিকে কর্মটি পুনরুৎপাদন করা; (খ) সার্কুলেশনে রয়েছে এমন অনুলিপি ব্যতিরেকে, কর্মটির অনুলিপি জনগণের জন্য ইস্যু করা; (গ) জনসমক্ষে কর্মটি পারফর্ম করা অথবা তা জনগণের মধ্যে প্রচার করা; (ঘ) কর্মটির কোন অনুবাদ উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, পারফর্ম বা প্রকাশ করা; (ঙ) কর্মটির বিষয়ে কোন চলচ্চিত্র ছবি বা শব্দ রেকর্ড করা; (চ) কর্মটি সম্প্রচার করা বা কর্মটির সম্প্রচারকৃত বিষয় মাইক বা অনুরূপ অন্যকোনো যন্ত্রের সাহায্যে জনসাধারণকে অবহিত করা। (ছ) কর্মটি অভিযোজন করা; (জ) কর্মটির অনুবাদ বা অভিযোজনের ওপর (ক) হতে (চ) দফায় উল্লিখিত কোন কাজ করা।

(২) কম্পিউটার প্রোগ্রামের ক্ষেত্রেঃ (ক) উপরে উল্লিখিত সকল অধিকার প্রয়োগ করা, (খ) ইতোপূর্বে একইরূপ অনুলিপি বিক্রি করা বা ভাড়া দেওয়া হোক বা না হোক, কম্পিউটার প্রোগ্রামের অনুলিপি বিক্রি করা বা ভাড়া দেওয়া অথবা বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব করা৷

(৩) শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেঃ (ক) কোন দ্বিমাত্রিক কর্মের ত্রিমাত্রিক কর্মে অথবা ত্রিমাত্রিক কর্মের দ্বিমাত্রিক কর্মে অঙ্কনসহ যেকোনো বস্তুগত আঙ্গিকে কর্মটি পুনরুৎপাদন করা; (খ) কর্মটি জনগণের মধ্যে প্রচার করা; (গ) সার্কুলেশনে রয়েছে এমন অনুলিপি ব্যতিরেকে, কর্মটির অনুলিপি জনগণের জন্য ইস্যু করা; (ঘ) কর্মটিকে কোন চলচ্চিত্রের ছবির অন্তর্ভুক্ত করা; (ঙ) কর্মটির অভিযোজন করা; (চ) কর্মটির অভিযোজনের পর উপরিউক্ত অধিকার প্রয়োগ করা; (ছ) কর্মটি সম্প্রচার করা বা সম্প্রচারকৃত বিষয় মাইক বা অনুরূপ অন্যকোনো যন্ত্রের সাহায্যে জনসাধারণকে অবহিত করা।

(৪) চলচ্চিত্র ফিল্ম-এর ক্ষেত্রেঃ (ক) কর্মটির অংশবিশেষের প্রতিবিম্বের ফটোগ্রাফসহ ভিসিপি, ভিসিআর, ভিসিডি, ডিভিডি বা অন্য কোনভাবে এর অনুলিপি তৈরি করা; (খ) ইতোপূর্বে এরূপ অনুলিপি বিক্রি বা ভাড়া প্রদান করা হোক বা না হোক, ভিসিপি, ভিসিআর, ভিসিডি, ডিভিডি এর মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে ফিল্ম-এর অনুলিপি বিক্রি বা ভাড়া দেওয়া অথবা বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব করা; (গ) ফিল্মটির ভিসিপি, ভিসিআর, ভিসিডি, ডিভিডি বা অন্যকোনোভাবে এর শ্রবণযোগ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য অনুলিপি জনগণের মধ্যে প্রচার বা প্রদর্শন করা।

(৫) শব্দ রেকর্ডিং-এর ক্ষেত্রেঃ (ক) অভিন্ন রেকর্ডিং অঙ্গীভূত করে অন্যকোনো শব্দ রেকর্ডিং তৈরি করা; (খ) ইতোপূর্বে একইরূপ অনুলিপি বিক্রি যা ভাড়া দেওয়া হোক বা না হোক শব্দ রেকর্ডিং এর কোন অনুলিপি বিক্রি করা বা ভাড়া দেওয়া অথবা বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব করা; (গ) শব্দ রেকর্ডিং জনগণের মধ্যে প্রচার করা৷

অতএব দেখা যায় যে, কপিরাইট সারাক্ষণ অর্থে যা বুঝায় আইনগত অর্থে তার চেয়ে ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ।

কপিরাইট আইনের ঐতিহাসিক পটভূমিঃ কপিরাইট সুরক্ষার ধারণাটির উদ্ভব হয় প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের পর। পূর্বে মানুষ হাতে লিখে কোন লেখার কপি করত। কিন্তু প্রিন্টিং প্রেস আবিস্কারের পর যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য কপি করা যেত। এ অবস্থায় রচয়িতা বা প্রকৃত মালিকের অনুমোদন ব্যতিরেকেই প্রেসের মালিকগণ ও পুস্তক বিক্রেতাগণ ছাপায়ে বিক্রি করা শুরু করল। এতে পুস্তক রচয়িতাগণ এবং পুস্তক প্রকাশকগণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতি হতে উত্তরণের জন্য চিন্তাভাবনা শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে কপিরাইট আইনের উদ্ভব।

প্রথমদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির রাজা-রানীগণ এক ধরনের লাইসেন্স প্রদান করতেন যাকে বলা হতো প্রিভিলেজ। এ প্রিভিলেজ গ্রহীতাগণ তাদের পুস্তকাদি পুনরুৎপাদন ও বিতরণের জন্য একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করতেন। কেউ এর লঙ্ঘন করলে জরিমানা, আটক, লঙ্ঘনকৃত কপিসমূহ বা বাজেয়াপ্তকরণ এবং ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির বিধান ছিল। বর্তমান যুগের কপিরাইট ব্যবস্থার এটাই ছিল ভিত্তি। প্রাথমিকভাবে সাহিত্যকর্ম রক্ষার জন্য এর প্রবর্তন করা হয়, কিন্তু ক্রমশ সঙ্গীতকর্ম, শিল্প, ফটোগ্রাফ, নকশা, শব্দ রেকর্ডিং এবং অন্যান্য কর্মে সম্প্রসারণ করা হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রিভিলেজ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয় এবং ১৭০৯ সালে ইংল্যান্ডে কপিরাইট সংক্রান্ত একটি বিধিবদ্ধ আইন প্রবর্তন করা হয় যাকে বলা হয় স্ট্যাটিউট অব এ্যান। কপিরাইট আইনের ইতিহাসে এ আইনটি একটি মাইলফলক। এরপর ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরূপ আইন পাস করে। এ সকল আইন দ্বারা নিজ দেশের রচয়িতাদের কর্ম রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ইংল্যান্ডে ১৭৭৫ সালে একবার এবং ১৮৪২ সালে আর একবার আইন পাস করে পূর্বোক্ত আইনগুলো বিলুপ্ত করা হয়। এ আইনে দেশীয় গ্রন্থাকারের রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিন কমন ল এবং বিধিবদ্ধ আইনের মধ্যে প্রাধান্য নিয়ে বিরোধ চলে। শেষ পর্যন্ত Donaldson V Beckett (1774) মামলায় হাউজ অব লর্ডস-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিধিবদ্ধ আইনে কপিরাইট নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।

১৮৪২ সালের আইনটি বাতিল করে আবার ১৯১১ সালে আবার একটি আইন পাস করা হয় যা ভারতসহ সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে প্রযোজ্য ছিল। ১৯১৪ সালে ভারত সরকার ১৯১১ সালের আইনের আদলে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে প্রবর্তন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হবার পরও ঐ আইনটি বলবৎ ছিল। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার কপিরাইট অধ্যাদেশ করে যা ১৯৬৭ সাল হতে বলবৎ করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার এর ব্যাপক সংশোধন করে। পরে এটা রহিত করে কপিরাইট আইন, ২০০০ পাস করে যা বর্তমানে বাংলাদেশে বলবৎ আছে৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক