একটি মামলার পক্ষভুক্তি না করা এবং ভুলে পক্ষভুক্তি না করা বলতে কি বুঝায়? সেট-অফ এবং কাউন্টার ক্লেইম কী?


প্রশ্নঃ একটি মামলার পক্ষভুক্তি না করা এবং ভুলে পক্ষভুক্তি না করা বলতে কি বুঝায়? একটি মামলায় ঘটনার কারণসমূহ সংযুক্তকরণ বলতে কি বুঝায়? সেট-অফ এবং কাউন্টার ক্লেইম এর সংজ্ঞা ও পার্থক্য নিরূপণ কর।

পক্ষগণের সংযোগ ও অপ-সংযোগ সংক্রান্ত বিধিমালাঃ দেওয়ানী মামলায় দু'টি পক্ষ থাকে। যে মামলা দায়ের করে তাকে মামলার বাদী বলে এবং যার বিরুদ্ধে তা দায়ের করা হয় তাকে বিবাদী বলে। বাদী একজন বা তার বেশিও হতে পারে। অনুরূপভাবে বিবাদী এক বা একাধিক হতে পারে। অনেক সময় বিবাদী ব্যতীত অন্যান্য কতিপয় ব্যক্তির মোকাবিলায় মামলা বিচারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এরূপ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার চাওয়া হয় না। কিন্তু তাদেরকে মোকাবিলা বিবাদীরূপে (proforma defendant) মামলায় পক্ষ করা হয়।

উদারহণঃ ক, খ, গ তিনজন একত্রে এক খণ্ড জমির মালিক। ঘ এই জমিটি বেদখল করেছে। এমতাবস্থায় ক খ গ তিন জনে একত্রে পুনরুদ্ধারের জন্য ঘ এর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। এক্ষেত্রে ক যদি মামলা করতে চায়, কিন্তু খ ও গ মামলা করতে অনচ্ছুিক হয় তবে ক একাই ঘ এর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু যেহেতু ক জমিটির এক তৃতীয়াংশ দাবী করে এবং তার দাবী অনুযায়ী খ ও গ দুই তৃতয়ী অংশের মালিক সেহেতু খ ও গ এর মোকাবিলায় এ বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। তাই এক্ষেত্রে ঘ কে মূল বিবাদী করে এবং খ, গ কে মোকাবিলা বিবাদী করে ক কে মামলা দায়ের করতে হবে। অবশ্য মামলা চলাকালে ইচ্ছা করলে খ ও গ তাদের দুই তৃতীয়াংশ ভূমির মূল্যের উপর কোর্ট ফি দিয়ে মোকাবিলা বিবাদী হতে সহবাদী হিসেবে মামলা চালাতে পারে, অবশ্য তাদের দাবী যদি ইতোমধ্যে তামাদি না হয়ে থাকে।

মোকাবিলা বিবাদীদের অনেক সময় যথার্থ পক্ষ (Proper Parties) বলা হয়৷ মামলার আবশ্যকীয় পক্ষদের যে কোন একজন পক্ষ না হলে মামলা চলে না এবং তা খারিজ হয়ে যায়।

কতকগুলি মামলা আদালতে আরজির পরিবর্তে দরখাস্ত বা আবেদনপত্র জমা দিয়ে মামলা শুরু করা যায়। যেমন প্রজাস্বত্ব আইনের অগ্রক্রয়ের মামলা। এই জাতীয় মামলায় বাদীকে বলা হয় দরখাস্তকারী এবং বিবাদীকে বলা হয় প্রতিপক্ষ। এক্ষেত্রেও প্রয়োজন বোধে মোকাবিলা প্রতিপক্ষ হতে পারে এবং সহদরখাস্তকারী হতে পারে।

ভুল করে কাউকে মামলার পক্ষ করা হলে তাকে বলা হয় পক্ষের অপ-সংযোগ (Misjoinder of Parties) এবং আবশ্যকীয় পক্ষকে মামলায় পক্ষভুক্ত না করলে তাকে পক্ষভাবে (Nonjoinder of parties) বলে।

যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তির পৃথক মামলা করা উচিত কিন্তু আদেশ ১ বিধি ১ এর বিধান লংঘন করে বিভিন্ন ব্যক্তি একটি মামলা করে তখন বলা হয় বাদীপক্ষের অপসংযোগ।

বাদীপক্ষের অপ-সংযোগ হলে বিবাদী পক্ষকে যথাসম্ভব মামলার প্রথম সুযোগ জবাব দিবার সময়ে এই অপ- সংযোগের আপত্তি উত্থাপন করতে হবে। অন্যথায় বিবাদীপক্ষ এই অপসংযোগ মেনে নিয়েছে বলে আদালত ধরে নিবেন। বিবাদীপক্ষ যথাসময়ে বাদী পক্ষের অপসংযোগ সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করলে এবং আদালত তা যথার্থ মনে করলে আদেশ ১ বিধি ২ মোতাবেক আদালত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই বিধিতে বলা হয়েছে যে, যেক্ষেত্রে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, কতিপয় ব্যক্তিকে বাদীপক্ষে সামিল করা হলে মামলার বিচার অনুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটতে পারে, সে ক্ষেত্রে আদালত বাদীগণকে স্ব স্ব ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ বা পৃথক বিচার অনুষ্ঠানের আদেশ বা অবস্থানুযায়ী অন্য কোন উপযুক্ত আদেশ দিতে পারেন।

আদেশ ১. বিধি ৩ এর বিধান লংঘন করলে বিবাদী। পক্ষের অপ-সংযোগ বলা হবে। এই বিধিতে বলা হয়েছে যে, একই কার্য বা কার্যাবলীর অথবা লেনদেনের দরুন যাদের বিরুদ্ধে একত্রে, পৃথকভাবে বা পর্যায়ক্রমে কোন প্রতিকার দাবী করা যায় এবং যেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে মামলা দায়ের করা হলে আইন ও তথ্য সংক্রান্ত একটি সাধারণ প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে, অনুরূপ সকলকে একই মামলার বিবাদী শ্রেণীভুক্ত করা যায়। এই বিধি লংঘন করে পৃথক মামলা করা হলে বিবাদী পক্ষের অপ-সংযোগ দোষ হবে।

বাদী পক্ষের অপসংযোগের ন্যায় কোন মামলায় বিবাদী পক্ষের অপ-সংযোগ হলে যথাসম্ভব প্রথম সুযোগে এ সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করতে হবে। অন্যথায় বিবাদীপক্ষ এই অপ-সংযোগ মেনে নিয়েছে বলে গণ্য করা হবে।

চার মামলার কারণসমূহ সংযুক্তিকরণঃ

মামলার কারণ (Causes of action) : প্রত্যেক মামলার আরজিতে নালিশের কারণ সংযোজিত হতে হবে। এর উপর ভিত্তি করেই মোকদ্দমা পরিচালিত হয়ে থাকে। যে সকল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বাদী তার পক্ষে আদালতের রায় পেতে ইচ্ছা করে, সেগুলিকে নালিশের কারণ বলা হয়। দাবীর সমর্থনে মূল বিষয়গুলি নালিশের কারণ; কিন্তু মূল বিষয়গুলি প্রমাণ করতে যে সকল সাক্ষ্যের প্রয়োজন হবে সেগুলি নালিশের কারণ নয়। তাই যে ঘটনাক্রম হতে মামলার উদ্ভব হয়েছে তাকেই দেওয়ানী আইনে কারণ সংযোজন বলে।

নালিশের কারণ বিষয়ে অপসংযোগ তিন ভাবে হতে পারে। (১) বাদীপক্ষের অপসংযোগের সহিত নালিশের কারণে অপসংযোগ ঘটতে পারে (২) বিবাদীপক্ষের অপসংযোগের সহিত নালিশের কারণের অপসংযোগ ঘটতে পারে এবং (৩) বিভিন্ন নালিশের কারণ সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবীর জন্য একটি মাত্র মামলা দায়ের করা হলে নালিশের কারণের ও অপসংযোগ হয়।

উদাহরণঃ (১) ক, খ, ও গ এর বিরুদ্ধে একত্রে একটি মামলা দায়ের করে। দাবী করা হয় যে, ক, খ, এর বর্গা ফসলের মূল্য বাবদ ১ হাজার টাকা এবং গ এর দোকানের বাকী বাবদ ১ হাজার টাকা পাওনা আছে, এক্ষেত্রে বিবাদী পক্ষের অপসংযোগের সহিত মামলার কারণে অপসংযোগ ঘটেছে বলে গণ্য করা হবে।

(২) ক, খ এর বিরুদ্ধে তিন রকমের দাবী একত্রিত করে মামলা দায়ের করে। বর্গা ফসলের মূল্য বাবদ ১ হাজার টাকা, দোকানের বাকী বাবদ ১ হাজার টাকা এবং চুক্তিভঙ্গের ক্ষতিপূরণের জন্য ১ হাজার টাকা। মোট ৩ হাজার টাকা দাবী করে মামলা দায়ের করে। এক্ষেত্রে মামলার কারণের অপসংযোগ হবে।

আদেশ ২ বিধি ৭ অনুযায়ী নালিশের কারণ সম্পর্কিত অপসংযোগ বিষয়ে যাবতীয় আপত্তি মামলার প্রথম সুযোগে বা বিচার্য বিষয় প্রণয়ন সময়ে উত্থাপন করতে হবে, অন্যথায় পক্ষগণ এই জাতীয় অপসংযোগ দোষ মেনে নিয়েছে বলে ধরা হবে।

সেট অফ ও কাউন্টার ক্লেইম এর মধ্যে পাথক্য ‘সেট অফ' হচ্ছে বাদীর পাওনা অর্থ উদ্ধারের মামলায় বাদীর নিকট ও বিবাদীর পাওনা অর্থ সমন্বয়ের দাবী। ৮ অর্থ আদেশের ৬(১) বিধিতে বলা হয়েছে যে, পাওনা উদ্ধারের দাবীতে দায়েরকৃত কোন মামলায় যদি বাদীর নিকট হতে আইনত বিবাদীর প্রাপ্য অর্থ দ্বারা বিবাদীর বিরুদ্ধে বাদীর দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ করতে চায় এবং উক্ত অর্থের পরিমাণ যদি নির্ধারিত থাকে এবং তা আদালতের আর্থিক এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বাদীর মামলার ন্যায় বিবাদীর দাবীর ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ একই পর্যায়ে পড়ে তবে মামলার প্রথম শুনানির তারিখেই বিবাদী তার পাওনা টাকার বিবরণ সম্বলিত একটি লিখিত জবাব দাখিল করতে পারবে, প্রথম শুনানির পর আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে অনুরূপ লিখিত জবাব দাখিল করা যাবে না। একে ‘সেট অফ' বলে। একটি পাল্টা মামলার আরজির ন্যায় লিখিত জবাবও কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করে যাতে আদালত মূল দাবি এবং সেট অফ এর ব্যাপারে এক সঙ্গে চূড়ান্ত রায় প্রদান করতে পারেন। তা কাউন্টার ক্লেইম বা পাল্টা বাদী কোন পাওনা আদায়ের লক্ষে বিবাদীর বিরুদ্ধে কোন মামলা করলে বিবাদীরও কোন পাওনা দাবী করলে তাকে পাল্টা দাবী বলে। বাদীর দাবীর পরিমাণ যদি বিবাদীর দাবীর পরিমাণের চেয়ে কম হয় তখন তা সেট অফ অকার্যকর হয় তখন বিবাদীকে পাল্টা দাবী করতে হয়।

সেট অফ ও কাউন্টার ক্লেইমের মধ্যে পার্থক্য সেট অফ ও কাউন্টার ক্লেইম বা পাল্টা দাবির মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্যগুলি বিদ্যমানঃ

১. সেট অফের দাবী একটি নির্ণীত সংখ্যক অর্থের ক্ষেত্রে অথবা বাদীর একই লেনদেন হতে উদ্ভব হয়ে থাকে। কিন্তু পাল্টা দাবীর ক্ষেত্রে তা একই লেনদেন হতে উদ্ভুত হুবার প্রয়োজন হয় না।

২. সেট অফ হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি বিধিবদ্ধ পন্থা এবং লিখিত জবাবে এটা উল্লেখ করতে হবে অপরদিকে, পাল্টা দাবী হচ্ছে আক্রমণের একটি পন্থা যার মাধ্যমে বিবাদী বাদীর বিরুদ্ধে তার দারী এমনভাবে কার্যকর করতে পারে যা একটি স্বতন্ত্র মামলা দ্বারা করা যায়।

৩. সেট অফের ক্ষেত্রে বাদীকে তার সীমাবদ্ধতার বাধার ওজর প্রতিষ্ঠার জন্য এটা প্রমাণ করতে হবে যে, বাদীর মামলা শুরু করার দিন থেকে সেটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাল্টা দাবীর ক্ষেত্রে বাদীকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে এটা তখন বাধাগ্রস্ত হয়েছে যখন এটা ওজরস্বরূপ উত্থাপন করা হয়েছে।

৪. সেট অফ হচ্ছে আত্ম পক্ষ সমর্থনের জন্য বিবাদীর দাবী যা বাদীর দাবীর বেশী নয়। কিন্তু পাল্টা দাবীর ক্ষেত্রে বিবাদীর দাবী যেহেতু পাল্টা মামলার ন্যায় সেহেতু তা বাদীর দাবী অতিক্রম করতে পারে।

বস্তুত, এভাবেই সেট অফ ও পাল্টা দাবীর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক