অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় টমাস হবসের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ টমাস হব্স ছিলেন আধুনিক যুগের অন্যতম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। রাষ্ট্রচিন্তা বিশেষ করে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক দর্শনে তিনি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অনেক দার্শনিক তথা চিন্তাবিদ ধর্মকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে স্থান দেন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে টমাস হবস ধর্মকে রাজনীতির উপর কোনো রূপ প্রভাব বিস্তার করতে দেননি। তবে এটিও ঠিক নয় যে, তিনি ধর্ম বা গির্জা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেননি। কেননা তার অমর সৃষ্টি 'Leviathan' গ্রন্থে ধর্ম ও গির্জা সম্পর্কে আলোচনা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। টমাস হবস তার সমস্ত দর্শনের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে গির্জা ও ধর্মকে জড়বস্তু এবং গতি ও মানবিক আকাঙ্খার আলোকে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পান। এ কারণেই সতের শতকে রাজনৈতিক ইতিহাসে হসের দর্শন তাকে অপরাপর রাজনৈতিক দার্শনিকদের তুলনায় উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
রাষ্ট্র চিন্তায় হবসের অবদানঃ টমাস হব্স তার অনবদ্য গ্রন্থ 'Leviathan' রচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনে তার অবদান অনস্বীকার্য। নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় টমাস হবসের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলোঃ
(১) প্রকৃতির রাজ্য প্রসঙ্গেঃ টমাস হবস প্রকৃতির রাজ্যের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ইউরোপের শাসন তথা আইন শৃঙ্খলার মধ্যে যদি কিছু মাত্র শৈথিল্য প্রকাশ পায়, তাহলে ইউরোপের অধিবাসীরা আবার প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করবে। অপ্রিয় হলেও হসের এ অভিমতটি যে সত্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ অবিরাম ভয়ভীতি ও ভয়াবহ মৃত্যু বিভীষিকার মধ্যে বাস করে।
(২) শক্তি ও প্রতারণাঃ টমাস হবসের রাষ্ট্রচিন্তায় প্রকৃতির রাজ্যে শক্তি ও প্রতারণা বিদ্যমান ছিল। মানুষের ন্যায় অন্যায় বিচারের কোনো সুযোগ ছিল না। তখন জোর যার মুল্লুক তার এই নীতি বিরাজ করতো। শক্তির বলে যার যা ইচ্ছা তাই করতো। তা ছাড়া রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতির রাজ্য বেশ শক্তিশালী ছিল।
(৩) আইন সম্পর্কে হবসের ধারণাঃ হবসের রাষ্ট্র দর্শনের অন্যতম অবদান হলো আইন সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা প্রদান। তিনি বলেন, আইন হলো সার্বভৌমের আদেশ যা অপরের ওপর বর্তায়। তাছাড়া তিনি আরো মনে করেন যে, প্রাকৃতিক আইন সত্যিকারের কোনো আইন নয়। হবস প্রাকৃতিক আইন বলতে এমন সব নিয়ম-কানুন ও বিধি বিধানকে বুঝিয়েছেন যেগুলো মানুষের যুক্তি থেকে জন্মলাভ করেছে।
(৪) ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে পৃথকীকরণঃ হবস রাষ্ট্র ও সার্বভৌমের নৈর্ব্যক্তিক নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে পৃথক করেন। সুদূর অতীতে এরিষ্টটল, মধ্যযুগে মার্সিলিও অব পাদুয়া এবং আধুনিককালে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি যা করতে চেয়েছেন তা করতে পারেননি। অথচ হবস তা সম্ভব করে তোলেন। অনেকে মনে করেন, হবসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাজনীতিকে আরো উন্নত করেন।
(৫) রাষ্ট্র ও গির্জা সম্পর্কিত ধারণাঃ হবসের গির্জা সম্পর্কিত ধারণা এ রকম গির্জা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কতকগুলো লোকের একটি সংস্থা, যা অদ্বিতীয় সার্বভৌমত্বের ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্ত যা সার্বভৌমের নির্দেশে একত্রিত হয় এবং সার্বভৌমের ক্ষমতা ছাড়া যার অধিবেশনে একত্রিত হওয়া অনুচিত। এ প্রসঙ্গে হবস আরো বলেন যে, সার্বভৌমই রাষ্ট্রের প্রধান ধর্মযাজক। তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে সার্বভৌমের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের সমর্থক হলেও সাধারণভাবে তিনি ধর্মীয় সহনশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন।
(৬) রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে প্রত্যক্ষ সংযোগঃ.হবস তার রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, সবকিছুই রাষ্ট্রের জন্য, কোনকিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় এবংকোনো কিছুই রাষ্ট্রের বাইরে নয়। (Everything for the state, nothing against the state, nothing outside the state.) হবস রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে আলাদা করে রাখেননি।
(৭) ব্যক্তি স্বাধীনতাঃ হবসের রাষ্ট্রদর্শনে ব্যক্তি স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হয়। সার্বভৌম শক্তি ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তিনি বলেন, সার্বভৌম শক্তি যেসব কাজের ওপর কোনো নিষেধ আরোপ করেনি, ব্যক্তি সেসব কাজ করতে পারবে। সার্বভৌম শক্তি ক্রয় বিক্রয়, নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন ও বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি কাজে বাধা দিতে পারবে না। এজন্য হসকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
(৮) সরকারের শ্রেণীবিভাগঃ টমাস হব্স সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান হিসেবে সরকারকে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিভক্ত করার পর এদের গুণাগুণের তুলনামূলক আলোচনা করে। রাজতন্ত্রকেই সর্বশ্রেষ্ঠ সরকার বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরো বলেন, যেহেতু মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। সেহেতু কোনো সরকারই স্বার্থপরতা ও স্বজনপ্রীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়ে পারে না।
(৯) উপযোগবাদের জনকঃ ইংরেজ দার্শনিক টমাস হব্সকে উপযোগবাদের জনক বরা হয়। প্রকৃতির রাজ্যের অসহ্য ও ঘৃন্যপরিবেশ থেকে মুক্তি লাভের আশায় মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র গঠন করেছিল। সুতরাং চুক্তি, রাষ্ট্রীয় সংগঠন বা সার্বভৌম তত্ত্ব ইত্যাদির ভিত্তি হলে উপযোগিতা সভ্য সমাজের উপযোগিতা মানুষ উপলব্ধি করেছিল বলে রাষ্ট্র গঠনে তারা উদ্যোগ নিয়েছিল। সেজন্য আধুনিক পন্ডিতগণ বলেন যে, বেন্থাহ ও মিলের উপযোগবাদের উৎস হলো হবসের চিন্তাধারা।
(১০) সামাজিক চুক্তিঃ হবস মনে করেন, সামাজিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। রাজা চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেন না। এটা একটা একতরফা চুক্তি। রাজা সকল চুক্তির ঊর্ধ্বে। তাই তিনি চুক্তির কোনো পক্ষ নন। অন্যদিকে জন লক মনে করেন যে, দুটি পর্যায়ে চুক্তি সম্পাদিত হয়। যথা- (ক) সমাজ চুক্তি (খ) শাসন চুক্তি। প্রথম চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় চুক্তির মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়।
(১১) সার্বভৌম ক্ষমতাঃ টমাস হব্স রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে সার্বভৌমের চরমাধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সার্বভৌম হলো অভিজাত্য সর্বজনীন, চরম সীমাহীন এবং অপ্রকাশ বা অকথ্য। অর্থাৎ সার্বভৌমই আইন। সার্বভৌম ক্ষমতা হলো নিরঙ্কুশ।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তায় হসের অবদান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে তাকে অমর করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি তৎকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তার রাষ্ট্রদর্শন প্রদান করেন। তিনি যেসব ধারণা প্রদান করেন তা আধুনিক ধারণা বলে অভিমত দেন। একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, ইংরেজি ভাষাভাষী লেখকদের মধ্যে এ যাবৎ রাষ্ট্র দর্শনের ওপর যারা পান্ডিত্য অর্জন করেন, তাদের মধ্যে ভাবের সুষ্ঠু ও গঠনশৈলীর কুশলতার দিক দিয়ে হবসই সম্ভবত শ্রেষ্ঠ দার্শনিক।
0 মন্তব্যসমূহ