দেহ-মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ দেহ-মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, দেহ-মনের সম্পর্ক বিষয় প্রধানত কোন কোন মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। সেগুলোর একটি ভূমিকামূলক আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষের দেহ ও মন পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত এবং এদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। দেহ ও মন পরস্পর নির্ভরশীল। দেহ সুস্থ থাকলে মনও প্রফুল্ল থাকে এবং দেহ অসুস্থ হলে পড়লে মনেও অসুস্থতা অনুভূত হয়। তবে দেহ ও মনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা নিয়ে বেশ মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই মতভেদের ওপর ভিত্তি করে দর্শনের ইতিহাসে দেহ ও মনের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নে সেই মতবাদগুলোর মধ্যে প্রধান মতবাদগুলো আলোচনা করা হলো-

(১) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদঃ ডেকার্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের সমর্থক। তার মতে, দেহ ও মন দু'টি পৃথক সত্তা। দেহ বিস্তৃতিসম্পন্ন, কিন্তু মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। দেহের চেতনা নেই, কিন্তু মনের চেতনা আছে। দেহ যান্ত্রিক নিয়মের অধীন। মন উদ্দেশ্য বা আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ডেকার্ট বলেন, উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। জ্ঞানের বেলায় দেহ মনের ওপর কাজ করে, আর কাজ করার সময় মন দেহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তার মতে, মস্তিষ্কের মধ্যে যে পিনিয়েল গ্রন্থি আছে তার মাধ্যমেই এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে থাকে।

(২) প্রয়োজনবাদ বা উপলক্ষবাদঃ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের ত্রুটি দূর করতে গিয়ে দেকার্তের অনুসারী গুঁয়েলি (১৬২৫-১৬৬৯), মালেবাঁশ (১৬৩৮-১৭১৫) ও অন্যান্যেরা প্রয়োজনবাদ বা উপলক্ষবাদের প্রবর্তন করেন। তাদের মতে, দেহ ও মন যেহেতু পরস্পর বিরোধী দু'টি স্বতন্ত্র সত্তা, সেহেতু মস্তিষ্কে অবস্থিত পিনিয়াল গ্রন্থির মাধ্যমে এদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয়। তারা দেহ ও মনের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দেহ ও মনের মধ্যে সরাসরি কার্যকারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করে ঈশ্বরকে টেনে আনেন এবং বলেন যে, দেহ বা মনে প্রয়োজন দেখা দিলে, বা মাঝে মাঝে যখন কোনো পরিবর্তন ঘটে, তখন দেহ বা মনে অনুরূপ পরিবর্তন ঈশ্বর সংঘটিত করেন।

(৩) সমান্তরালবাদঃ দার্শনিক স্পিনোজা সমান্তরালবাদের প্রবক্তা। সমান্তরালবাদ অনুসারে দেহ ও মনের মধ্যে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্ভব নয়। দেহ ও মন পাশাপাশি থাকে; যেমন- দু'টি সমান্তরাল রেখা পাশাপাশি থাকলেও একটি অপরটিকে প্রভাবিত করতে পারে না। তার মতে, ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। এই ঈশ্বরের অসংখ্য গুণ আছে, এই অসংখ্য গুণের মধ্যে আমরা মাত্র দু'টি গুণই জানি— দেহ বা বিস্তৃতি এবং মন বা চৈতন্য। দেহ বা মন ঈশ্বরের দুই সমান্তরাল গুণ। দেহে যখন কোনো পরিবর্তন হয় তখন মনেও অনুরূপ পরিবর্তন ঘটে থাকে। ঈশ্বরের মধ্যে চিরকাল দেহ ও মন পাশাপাশি দেখা যায়। সমান্তরালবাদ অনুসারে দেহ ও মন একই ঈশ্বরের দু'টি দিক মাত্র।

দেহ ও মন যেহেতু একই ঈশ্বরের দু'টি প্রকাশ বা দিক, সেহেতু প্রতিটি মানসিক ক্রিয়ার অনুরূপ একটি দৈহিক ক্রিয়া এবং প্রতিটি দৈহিক ক্রিয়ার অনুরূপ একটি মানসিক ক্রিয়া আছে। দেহে যখন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়, তখন অনুরূপ পরিবর্তন দেহে দেখা দেয়। যদিও উভয়ের মধ্যে কোনো কার্যকারণিক সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ সমান্তরালবাদ মানসিক ও দৈহিক ঘটনার মধ্যকার পারস্পরিক সম্বন্ধের বিষয়কে স্বীকার করে, কিন্তু এদের মধ্যে যে প্রত্যক্ষ কার্যকারণিক সম্পর্ক রয়েছে, এ কথা অস্বীকার করে। স্পিনোজা দেহ ও মনকে ঈশ্বরের দু'টি আকৃতি বলে মনে করেন৷ তাই সমান্তরালবাদকে কেউ কেউ দ্বৈতাকৃতিবাদও বলেন।

(৪) পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদঃ পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ সম্পর্কিত ধারণা আধুনিক বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজের চিন্তায় লক্ষ্য করা যায়। তার মতে, ঈশ্বর সৃষ্টির সময়ই দেহ ও মনের মধ্যে এক শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এ শৃঙ্খলা অনুসারে দেই ও মন পরস্পরের মধ্যে নিত্যসঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে। তিনি দেহ ও মনকে দু'টি ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, দু'টি ঘড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে বা ঘড়ি দু'টি তৈরির সময় এমন শৃঙ্খলা স্থাপন করা হয়েছে যার ফলে দু'টি ঘড়ি আলাদাভাবে অবস্থান করেও একই রকম সময় নির্দেশ করে চলেছে। তিনি বলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাডই অন্য মোনাডগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির সময় তাদের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এর ফলে জগতে কোথাও কোনো অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা নেই। সবকিছুই নিয়ম-শৃঙ্খলামত চলছে।

(৫) উপবস্তুবাদঃ উপবস্তুবাদ অনুসারে জড়ই জগতের মৌলিক সত্তা এবং তাই মন বা চেতনা বলে জগতে কোন মৌলিক সত্তা নেই। মন-মস্তিষ্কেরই উপবস্তু বা উপসত্তা। দেহের সাথে মনের সম্পর্ক মানুষের সাথে ছায়ার সম্পর্কের মত। মানুষের গতি তার ছায়ার গতির কারণ। পক্ষান্তরে, ছায়ার গতি মানুষের গতির কারণ নয়। অনুরূপভাবে, দৈহিক পরিবর্তনের ফলেই মানসিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং মানসিক পরিবর্তনের ফলে দৈহিক পরিবর্তন সাধিত হয় না।

(৬) আত্মগত ভাববাদঃ দেহ ও মন সম্পর্কে আলোচনায় বার্কলি আত্মগত ভাববাদী মত দেন। তার মতে, মন বা তার ধারণাগুলোই হলো একমাত্র সত্য এবং সব জাগতিক বস্তুই মনের ধারণামাত্র। তাই দেহ ও মনের সম্পর্ক ধারণামাত্র ও মন নির্ভরশীল। তার এই মতবাদই আত্মগত ভাববাদ।

(৭) ঐচ্ছিক ভাববাদঃ শোপেন হাওয়ার ইচ্ছামূলক ভাববাদের প্রবর্তন করেন। তার মতে, জগৎ এক অন্ধ, অচেতন ও সর্বজনীন ইচ্ছার বাহ্যিক প্রকাশমাত্র। দেহকেও তিনি এক অচেতন ইচ্ছারই বাহ্যিক প্রকাশ বা রূপ বলে মনে করেন, তবে সে ইচ্ছা হল একান্তই ব্যক্তিগত। তিনি বলেন, ইচ্ছার ক্রিয়া এবং দেহের গতি দু'টি পৃথক বস্তু নয়, কার্যকারণ সম্পর্ক এদেরকে একত্র করে। এরা কারণ ও কার্যের সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়, এরা এক বা অভিন্ন। কিন্তু এদের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্নভাবে ঘটেছে। অর্থাৎ দেহ বাহ্য সত্তা ও ইচ্ছা প্রকৃত সত্তা।

(৮) বস্তুগত ভাববাদঃ হেগেলের মতে, এই বিশ্বজগৎ এক পরম সত্তার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। জড়, জীবন, মন সবকিছুতেই কম-বেশি তার পরিব্যাপ্তি লক্ষ করা যায় । জড়ে তার প্রকাশ নগণ্য, জীবে একটু বেশি; কিন্তু মনে তার চেয়ে বেশি। তাই দেখা যায়, মন দেহের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সত্তা। এটি দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

(৯) অভিন্নতাবাদঃ অভিন্নতাবাদ অনুসারে মানসিক অবস্থা ও মস্তিষ্কের সম্পাদন সব দিক দিয়ে, এমনকি সংখ্যাগতভাবেও এক ও অভিন্ন। কোনো ব্যক্তি বিশেষ মানসিক অবস্থায় রয়েছে, এ কথা বলার অর্থই হলো ঐ ব্যক্তির মস্তিষ্কে বিশেষ ঘটনা ঘটছে। যদিও ঐ ব্যক্তি জানে না যে এটা কি, তবুও দৈহিক ও মানসিক অবস্থা এক ও অভিন্ন। এ ছাড়া দেহ-মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে অন্য মতবাদগুলোর মধ্যে রয়েছে- সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ, উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ, দ্বিপার্শ্ববাদ, আচরণবাদ, দৈহিকবাদ ইত্যাদি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে দার্শনিকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচার করেছেন। বার্ট্রান্ড রাসেল, রাইল প্রমুখ দার্শনিক বর্তমানকালে দেহ ও মন সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই সমস্যার কোনো সুষ্ঠু সমাধান আজও মেলেনি বরং সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। এত অবশ্য ভবিষ্যতের আলোচনার জন্য অন্য দার্শনিকদের পথ প্রশস্ত করেছেন। তাই এককভাবে আমরা কোনো মতবাদই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতে পারি না। অবশ্য পরবর্তীকালের মতবাদগুলোও যথেষ্ট অভিনবত্বের দাবি রাখে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক