শিক্ষণের বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত প্যাভলভের চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ প্রক্রিয়া বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ শিক্ষণের বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত প্যাভলভের চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ প্রক্রিয়া বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ প্রত্যেক সমাজই সুসভ্য মানুষ আশা করে থাকে। কিন্তু মানুষকে সুসভ্য হতে হলে অবশ্যই তাকে স্বীয় সমাজের অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষণের মাধ্যমে জানতে হয়। কেননা, শুধুমাত্র শিক্ষণের মাধ্যমেই একজন সভ্য ও সুশিক্ষিত দায়িত্বপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে। এমনিভাবে সভ্য, সুশিক্ষিত ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য তাকে অসংখ্য আচরণ শিক্ষা করতে হয়। শিক্ষণ মানুষের জীবনে একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার।

প্যাভলভের চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ প্রক্রিয়াঃ বিখ্যাত রুশ শরীরতত্ত্ববিদ মাইভান প্যাভলভ (১৮৪১- ১৯৩৬) এই মতবাদের জনক। এই মত অনুযায়ী প্রত্যেক প্রাণী স্বাভাবিকভাবে কতগুলো বিশেষ উদ্দীপকের প্রতি কতকগুলো বিশেষ প্রতিক্রিয়া করে। এ ধরনের উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়াগুলো হলো স্বাভাবিক। যেমনঃ তেঁতুল দেখলে স্বাভাবিকভাবে জিভে পানি আসে, মাংস দেখলে স্বভাবতই ক্ষুধার্ত কুকুরের লালা ক্ষরণ হয়, উচ্চ শব্দ শুনলে শিশু স্বাভাবিকভাবে ভয় পায় ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলো শিক্ষালব্ধ নয়। প্যাভলভ প্রমাণ করলেন যে, যদি একটি স্বাভাবিক উদ্দীপকের সাথে একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপককের বারবার উপস্থাপন করা হয়, তাহলে স্বাভাবিক উদ্দীপকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াটি নিরপেক্ষ উদ্দীপকে সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ এর পর নিরপেক্ষ উদ্দীপক স্বাভাবিক উদ্দীপকের অনুপস্থিতিতেই উক্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াটি ঘটাতে পারে।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, যে উদ্দীপক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তাকে অসাপেক্ষ উদ্দীপক বলে। এই অসাপেক্ষ উদ্দীপকের প্রতি যে প্রতিক্রিয়া করা হয় তাকে, বলে অসাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া। যেমনঃ মাংস হলো অসাপেক্ষ উদ্দীপক এবং মাংসের প্রতি লালা নিঃসরণ হলো অসাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ঘণ্টাধ্বনি শুনে কুকুর সচরাচর লালা নিঃসরণ করে না। লালা নিঃসরণের ক্ষেত্রে ঘণ্টাধ্বনি হলো নিরপেক্ষ উদ্দীপক। প্যাভলভ পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখালেন যে, শিক্ষণের ফলে কুকুর ঘণ্টাধ্বনি শুনে লালা নিঃসরণ করে।

প্যাভলভের পরীক্ষণঃ হজমের ক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা চালানোর সময় প্যাভলভ একটি বিষয় লক্ষ্য করেন। তার গবেষণায় ব্যবহৃত কুকুরটির মুখে মাংসের টুকুরা দিলে সে যেমন লালা নিঃসরণ করত, তেমনই তার পায়ের শব্দ শুনে এবং খাবারের পাত্র দেখেও লালা ক্ষরণ করত। এই পর্যবেক্ষণের ফলে প্যাভলভ একটি পরীক্ষণের পরিকল্পনা করেন। প্যাভলভ সূক্ষ্মভাবে এই পরীক্ষণটি চালানোর জন্য একটি শব্দ প্রতিরোধক কক্ষ ব্যবহার করেছিলেন। পরীক্ষণে ব্যবহৃত কুকুরটি ছিল ক্ষুধার্ত। কুকুরটি যাতে বেশি নড়াচড়া করতে না পারে সেজন্য তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ভিন্ন একটি কক্ষ থেকে গবেষক কুকুরটির ক্রিয়াকলাপ দেখতে পেতেন কিন্তু কুকুরটি তাকে দেখতে পেত না। কুকুরের মুখে যান্ত্রিক উপায়ে মাংসের টুকুরা দেয়া হতো। অস্ত্রোপচার করে কুকুরটির চোয়ালে লালাগ্রন্থির সঙ্গে কাঁচের নল এমনভাবে লাগান হয়েছিল যাতে লালা কাচের নল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।

সাপেক্ষণের বৈশিষ্ট্যঃ প্যাভলভের পরীক্ষণ থেকে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়ার কতগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। সেগুলো হলো সাপেক্ষ প্রতিবর্তীর অর্জন প্রক্রিয়া- চিরায়ত সাপেক্ষণ পরীক্ষণে লক্ষ্য করা যায় যে, একটিমাত্র প্রচেষ্টায় সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্রথম বার সাপেক্ষ ও অসাপেক্ষ উদ্দীপকটিকে সূক্ষ্মভাবে উপস্থিত করা হলে পরবর্তী প্রচেষ্টায় শুধুমাত্র সাপেক্ষ উদ্দীপকটি দিয়ে পরীক্ষা করা হলে দেখা যাবে, অল্পমাত্রায় লালা ক্ষরণ হয় অথবা একেবারেই হয় না, কিন্তু সাপেক্ষ ও অসাপেক্ষ উদ্দীপক যত বেশিবার যৌথভাবে উপস্থিত করা হয় শুধুমাত্র সাপেক্ষ উদ্দীপকটি তত বেশি মাত্রায় লালা ক্ষরণ সৃষ্টি করে এবং অবশেষে তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌছে।

উদ্দীপকের সার্বিকীকরণঃ প্যাভলভ আবিষ্কার করেন, সাপেক্ষ উদ্দীপকটির সদৃশ অন্যান্য উদ্দীপকের সাহায্যেও সাপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়াটি সৃষ্টি করানো সম্ভব হয়। এই ঘটনাকেই বলা হয় উদ্দীপকের সামান্যীকরণ সার্বিকীকরণ। মনে করা যাক, এটি কুকুরকে প্রথমে ঘণ্টাধ্বনিতে লালা নিঃসরণ শিক্ষা দেওয়া হলো।

সাপেক্ষণে নৈকট্যঃ সাপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়া প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাপেক্ষ ও অসাপেক্ষ উদ্দীপকের মধ্যে নৈকট্য থাকতে হবে। আমরা জানি, সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলো সাপেক্ষ উদ্দীপকের সাথে অসাপেক্ষ উদ্দীপক জুড়ে দেওয়া। অর্থাৎ সাপেক্ষ উদ্দীপক (cs) এবং অসাপেক্ষ উদ্দীপক (us) যুগপৎ অথবা আনুক্রমিকভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে উপস্থিত না করা হলে সাপেক্ষ প্রতিবর্তী প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সাপেক্ষ উদ্দীপক ও অসাপেক্ষ উদ্দীপকের মধ্যবর্তী সময়কে বলা হয়, অন্তর্বর্তীকাল (Interstimulus Interval)।

বিলম্বিত সাপেক্ষণঃ সাপেক্ষ প্রতিবর্তী প্রতিষ্ঠার জন্য সংক্ষিপ্ত অন্তর্বর্তীকাল সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি, সাপেক্ষণ সাধারণত সাপেক্ষ উদ্দীপক ও অসাপেক্ষ উদ্দীপক খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অথবা যুগপৎ উপস্থিত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথমে সাপেক্ষ উদ্দীপক ও পরে অসাপেক্ষ উদ্দীপক করা হয়। কিন্তু সাপেক্ষ ও অসাপেক্ষ উদ্দীপকের আনুক্রমিকতা ও ব্যবধান পরিবর্তন করেও সাপেক্ষণ করা সম্ভব হয়।

সাপেক্ষ প্রতিবর্তীর অবলুপ্তিঃ সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া প্রতিষ্ঠার পর যদি অসাপেক্ষ উদ্দীপকটি বাদ দিয়ে বারবার শুধুমাত্র সাপেক্ষ উদ্দীপকটিকে উপস্থিত করা হয়, তাহলে সাপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়া ক্রমশ লোপ পায়। আগেই বলা হয়েছে, সাপেক্ষ প্রতিবর্তী সৃষ্টি হওয়ার মূল শর্ত হলো সাপেক্ষ ও অসাপেক্ষ উদ্দীপকের যুগপৎ বা আনুক্রমিক উপস্থিতি। কিন্তু সাপেক্ষ প্রতিবর্তী প্রতিষ্ঠার পর শুধুমাত্র সাপেক্ষ উদ্দীপকটিকে এককভাবে বারবার উপস্থিত করা হলে ক্রমশ সাপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়া কম হতে থাকে এবং অবশেষে লোপ পায়। উল্লিখিত উদাহরণে কুকুরটিকে খাদ্য না দিয়ে শুধুমাত্র ঘণ্টাধ্বনি উপস্থিত করলে ঘণ্টাধ্বনির প্রতি লালা নিঃসরণ ক্রমশ কমতে থাকবে এবং অবশেষে ঘণ্টাধ্বনিতে আর লালা নিঃসৃত হবে না। এভাবে অসাপেক্ষ উদ্দীপক (বল বৃদ্ধি)-এর অনুপস্থিতিতে সাপেক্ষ প্রতিবর্তীর শক্তি ক্রমশ কমে যাওয়াকে বলা হয় অবলুপ্তি বা বিলুপ্তি।

স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাগমনঃ সাপেক্ষণ পরীক্ষণে আরেকটি ঘটনা লক্ষ্য করার মতো। কোনো একটি সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়ার বিলুপ্তি ঘটলে পরে প্রাণীটিকে কিছুক্ষণ যেমনঃ ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম দিয়ে আবার সাপেক্ষ উদ্দীপকটি উপস্থিত করা হলে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াটি আবার কিছুটা শক্তি ফিরে যায়। এই ঘটনাকে বলা হয় স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাগমন। যেমন একটি কুকুরের ঘণ্টাধ্বনির প্রতি লালা ক্ষরণ প্রতিক্রিয়াকে বিলুপ্ত করার পর ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম করে আবার সেটিকে পরীক্ষণাগারে নিয়ে আসার পর ঘণ্টাধ্বনি উপস্থিত করলে পুনরায় বেশ কিছু পরিমাণ লালা ক্ষরণ করবে। এতে প্রমাণিত হয় যে, একটি উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সংযোগ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এই সংযোগের কিছুটা শক্তি বর্তমান থাকে। অবশ্য এই অবশিষ্ট সংযোগকে পুনরায় সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করানো যায়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, প্যাভলভের সাপেক্ষণ তত্ত্ব ব্যাখ্যাগত দিক থেকে ছিল সুস্পষ্ট ও ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই তত্ত্ব প্রদান করে তিনি একদিকে যেমন মনোবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি অন্যদিকে শিক্ষণ ত্বত্ত্বকে আরো বেশি প্রাঞ্জল ও আলোচনামুখী করে তুলতে সক্ষম হন। তাই তুলনামূলকভাবে শিক্ষণ তত্ত্ব ব্যাখ্যায় তার তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য ছিল। এ তত্ত্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় জটিলতা লক্ষ্য করা গেলেও তা অনেকাংশে গ্রহণযোগ্য ছিল বলা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক