দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি দেখাও


প্রশ্নঃ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি দেখাও৷
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার সুফল আলোচনা কর।
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার গুণাবলি আলোচনা কর৷
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সুবিধা আলোচনা কর ৷
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ইতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ দুটি কক্ষ থাকলে তাকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বলা হয়। স্যার হেনরি মেইন, জে, এস, মিল প্রমুখ মনীষীর দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে সমর্থন করেছেন। হেনরি মেইনের মতে, “একেবারে না থাকার চেয়ে যে কোন ধরনের একটি দ্বিতীয় কক্ষ থাকাও ভালো।” মিলের মতে, “একটি মাত্র কক্ষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্ৰীভূত থাকলে তা স্বেচ্ছাচারী হয়। এর অর্থ হলো ক্ষমতা থাকলেই তা অপব্যবহারের পথে অগ্রসর হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অন্য কোন পরিষদ থাকলে তা রোধ করতে পারে।” ব্রাইস বলেন যে, “একটি কক্ষের ঘৃণ্য, স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হবার সুপ্ত বাসনাকে অন্য কক্ষ নিবারণ করতে পারে।” ফ্রান্সে ১৭৯৫ সালে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চালু হয়ে একনাগাড়ে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত চলে। ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ বহু দেশে দ্বিকক্ষ আইনসভা আছে।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তিঃ

১. সুচিন্তিত আইন প্রণয়নঃ দ্বিকক্ষ আইনসভার চিন্তাভাবনার পর আইন প্রণয়ন করা সম্ভব। প্রথম কক্ষের হঠকারিতা ও আবেগ দ্বিতীয় কক্ষে ধরা পড়ে এবং দ্বিতীয় কক্ষের ভুল প্রথম কক্ষে সংশোধন করতে পারে। কিন্তু এককক্ষে এ ধরনের ভুল থেকেই যায় এবং খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা দলীয় স্বার্থের প্রতি নজর রেখে জনমতের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করতে পারে। দুটি কক্ষ থাকলে এ ধরনের যে কোন প্রবণতা রোধ করতে পারে। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য এটা আবশ্যক। Lord Acton বলেন, “দ্বিকক্ষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।” (The second chamber is essential security of freedom.) মাইক্যাল স্টিয়ার্টও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে সমর্থন করেন।

২. সমস্যা বৃদ্ধিঃ টেসিটাসের মতে, দেশে যত সমস্যা দেখা দিবে তত বেশি আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা বাড়বে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দিন দিন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সে সঙ্গে জটিলতাও বাড়ছে। তাই এর সমাধানের জন্য অধিকসংখ্যক আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দিচ্ছে। এজন্য এককক্ষের পক্ষে আর এত কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য দ্বিতীয় কক্ষের আবশ্যকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. স্বেচ্ছাচারী হয় নাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেকি বলেন, সর্বক্ষমতাশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। লর্ড ব্রাইসের কথায়, এককক্ষ বিশিষ্ট আইনপরিষদ স্বভাবতই স্বেচ্ছাচারী হয়ে থাকে। এককক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা রোধে অন্য একটি কক্ষ আবশ্যক। হিচনার ও হারবোল্ডের মতে, “কোন দ্বিতীয় কক্ষ 'একটি পরীক্ষক ও —সংশোধক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং তা সদস্যগণের বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জননির্বাচিত কক্ষের কাজকে পর্যালোচনা করতে পারে।” গেটেলের ভাষায়, “উভয় কক্ষই একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সদা ব্যস্ত থাকে।”

৪. জ্ঞানী ব্যক্তির সেবাঃ আইনসভায় দেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের সেবা লাভের সুবিধা থাকে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নন অথচ প্রতিভাশালী এবং দেশ দরদি তাদের সহযোগিতা প্রাপ্তির জন্য দ্বিতীয় কক্ষে সদস্য করার ব্যবস্থা করা যায়। প্রথম কক্ষ জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবার কারণে সাধারণ ব্যক্তিগণ জনকল্যাণকর কাজের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যেতে পারেন। হিচলার ও হারবোল্ড বলেন, “দ্বিতীয় কক্ষ একটি পরীক্ষক ও সংশোধক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সদস্যদের বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচিত কক্ষের কাজকে পর্যালোচনা করতে পারে।”

৫. স্বৈরশাসনের অবসানঃ আইনসভা দেশের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান করতে পারে। প্রথম কক্ষ জনমতের বিরুদ্ধে কাজ করলে দ্বিতীয় কক্ষ তা প্রতিরোধ করতে পারে এবং আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারসাম্যতা রক্ষিত হয়। লর্ড ব্রাইস বলেন, “দ্বিকক্ষের প্রয়োজন এবং বিশ্বাস হতে উদ্ভূত হয়েছে যে, আইনপরিষদের অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ ও ঘূর্ণিত হবার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা আছে এবং এটা প্রতিরোধ করতে হলে সমান ক্ষমতার আর একটি কক্ষের প্রয়োজন।” (The necessity of two chambers is based on the belief that the innate tendency of an assembly is to become hateful, tyrannical and corrupt and needs to be checked by the existence of another house of equal authority).

৬. জনমত যাচাইঃ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় জনমত যাচাইয়ের সুবিধা থাকে। অনেকে এ আইনসভাকে জনমত যাচাইয়ের 'ব্যারোমিটার' হিসেবে অভিহিত করেছেন। এক্ষেত্রে জনমতের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া যাচাই করা যায়। অনেক দেশে দুটি কক্ষের নির্বাচন বিভিন্ন সময়ে হয়, ফলে জনমত যাচাই সুবিধাজনক হয়। জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলনের জন্য দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

৭. নিয়ন্ত্রণ সুবিধাঃ অধ্যাপক গেটেলের মতে, “আইন পরিষদের দুটি কক্ষ একে অপরকে নিয়ন্ত্রণে শাসন বিভাগকে অধিকতর সুযোগ দেয় এবং তা পরিণামে আইন ও শাসন বিভাগ উভয়ের জন্য শুভ।” (Two houses checking each other give greater freedom to the executive and in the long run secure the best interest of both departments).

৮. বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্বঃ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় বিভিন্ন শ্রেণির লোকের প্রতিনিধিত্ব করার সুবিধা থাকে। এতে বহুসংখ্যক ব্যক্তি আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করতে পারেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বেশি সহায়ক হয়। দ্যুগুই মন্তব্য করেছেন যে, সেই আইনসভা ভালো হবে যার এককক্ষ সমগ্র জনগণের এবং অন্যকক্ষ বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবে। টকভেলির মতে, বর্তমান কালে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর অত্যাচারই বহু প্রবল। তাই এ সম্পর্কে গোটা সমাজকে সতর্ক থাকা আবশ্যক। দ্বিতীয় কক্ষের দ্বারা সংখ্যাগুরুকে সঠিক প্রতিনিধিত্বশীল করা যায়।

৯. যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আবশ্যকঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের জন্য এ আইনসভা একান্ত আবশ্যক। কারণ প্রথম কক্ষ জনসাধারণের ভোটে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত এবং সমগ্র দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। অঙ্গীভূত প্রদেশগুলোর মধ্যে সমতা বিধানের জন্য দ্বিতীয় কক্ষ থাকা আবশ্যক। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিধি সভা সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করে কিন্তু প্রদেশসমূহের মধ্যে সমতাবিধান করতে পারে না। সিনেট এ দায়িত্ব পালন করে। সিনেটে ছোট বড় প্রতিটি অঙ্গরাষ্ট্র থেকে দুজন প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা আছে, ফলে সকল প্রদেশের প্রভাব একই থাকে। প্রতিনিধি সভায় তা সম্ভব নয়। সেখানে জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সদস্যের তারতম্য হয়। এজন্য বড় প্রদেশে জনসংখ্যা বেশি থাকায় সদস্যসংখ্যাও বেশি হয় এবং প্রভাবও বেশি থাকে কিন্তু সিনেট সভা তার সমতা বিধান করতে পারে।

১০. সরকারকে সচলঃ দুটি কক্ষ থাকলে সরকার সচল থাকে। এককক্ষের অবসানে অন্য কক্ষ সচল থাকে, ফলে সরকার পরিচালনায় বিঘ্নের সৃষ্টি হয় না।

উপসংহারঃ আলোচনার শেষ প্রান্তে বলা যায়, আধুনিক বিশ্ব দিন দিন জটিল রূপ নিচ্ছে। আর এ জটিল বিশ্ব মোকাবিলায় সরকারের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের বিশাল কাজ সমাধানে জোর দিতে হয় আইনসভার উপর। তাই আইনসভাকে এসব ব্যাপক কাজ সম্পাদনে দ্বিকক্ষের কোন বিকল্প নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক