অথবা, হবস ও লকের রাষ্ট্রচিন্তার তুলনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ আধুনিক রাজনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস ও জন লকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য, সামাজিক চুক্তি, সার্বভৌমিকতা, আইন, সংসদীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে উভয় চিন্তাবিদই স্ব-স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের মতবাদ প্রদান করেছেন। তাদের মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই পরিলক্ষিত হয়।
হবস ও লকের রাষ্ট্রচিন্তার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যঃ নিম্নে হবস ও লকের রাষ্ট্রচিন্তার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো-
টমাস হবস ও জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার সাদৃশ্যঃ টমাস হবস ও জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
(১) টমাস হবস ও জন লক উভয়ই অভিমত পেশ করেছেন যে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত এবং প্রাকৃতিক আইন মান্য করত।
(২) হবস ও লক উভয়েই স্বীকার করেছেন যে, প্রকৃতির রাজ্যের অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্যে মানুষ সরকার বা রাষ্ট্র গঠন করে।
(৩) হবস ও লক দুইজনই প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে দেশান্তরী হন এবং পুনরায় দেশে ফিরে আসেন।
(৪) হবস ও লক উভয়ই ইংল্যান্ডের তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের রাষ্ট্রতত্ত্ব নির্মাণ করেন।
(৫) হবস ও লক উভয়ের আলোচনায় বিধৃত হয়েছে যে সামাজিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।
টমাস হবস ও জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার বৈসাদৃশ্যঃ হবস ও লকের রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্য অধিকতর ক্রিয়াশীল। হবস ও লকের রাষ্ট্রচিন্তার বৈসাদৃশ্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
(১) মানবপ্রকৃতিঃ মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে হবস মনে করেন যে, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। মানুষকে তিনি জড় বস্তুর মতো একটি আবেগহীন যন্ত্রবিশেষ বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে জন লকের মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা ইতিবাচক। তিনি মনে করেন, মানুষ যুক্তিবাদী ও শান্তিপ্রিয়। মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা থাকলেও যুক্তি দ্বারা সেসব কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে রাখে। তিনি বলেন যে, মানুষ শুধু যুক্তিবাদী নয় এবং নৈতিক প্রাণীও বটে।
(২) প্রকৃতির রাজ্যঃ হবসের মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। প্রকৃতির রাজ্য ছিল ভয়াবহ ও দুর্বিষহ। প্রকৃতির রাজ্যে শক্তি, বল, ছলনা, প্রতারণা, লালসা ও প্রবৃত্তিরই প্রতিপত্তি। অন্যদিকে জন লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল শান্তি, সহযোগিতা ও সম্প্রতির এক সুখময় স্থান। যেহেতু মানুষ শান্তিপ্রিয় যুক্তিবাদী ছিল এবং প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা চালিত হতো সেহেতু প্রকৃতির রাজ্য ছিল শুভেচ্ছা ও প্রতিরক্ষার রাজ্য।
(৩) রাষ্ট্রের উৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদঃ হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থা ভয়াবহ ছিল। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। লকের প্রকৃতির রাজ্য আইনের দ্বারা পরিচালিত হলেও পক্ষপাতদুষ্ট বিচার, বিচারকের নির্দেশ বা আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং একই বিষয়ের ওপর নানা ধরনের আইন বা সিদ্ধান্তের কারণে প্রকৃতির রাজ্যে স্বাচ্ছন্দ্য গতি ব্যাহত হয়।
(৪) সামাজিক চুক্তিঃ হবস মনে করেন, সামাজিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। রাজা চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেন না। এটা একটা একতরফা চুক্তি। রাজা সকল চুক্তির উর্ধ্বে। তাই তিনি চুক্তির কোনো পক্ষ নন। অন্যদিকে জন লক মনে করেন যে, দুটি পর্যায়ে চুক্তি সম্পাদিত হয়। যথা- (১) সমাজ চুক্তি (২) শাসন চুক্তি। প্রথম চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় চুক্তির মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়।
(৫) সার্বভৌম ক্ষমতাঃ টমাস হবস রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে সার্বভৌমের চরমাধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সার্বভৌম হবে অবিভাজ্য, সার্বজনীন, চরম সীমাহীন এবং অপ্রকাশ বা অকথ্য। অর্থাৎ সার্বভৌমই আইন। সার্বভৌম ক্ষমতা হলো নিরঙ্কুশ। অন্যদিকে লকের সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা হবসের সার্বভৌম ক্ষমতার ন্যায় নিরঙ্কুশ এবং সর্বশক্তিসম্পন্ন ছিল না। লকের মতে, সার্বভৌম শাসক সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হবেন।
(৬) সরকারের শ্রেণীবিভাগঃ হবস সরকারকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ (১) রাজতন্ত্র, (২) অভিজাততন্ত্র ও (৩) গণতন্ত্র। এই তিন ধরনের সরকারের মধ্যে তিনি রাজতন্ত্রকে সবচেয়ে উত্তম বলে মনে করেন। অন্যদিকে লকও সরকারের তিনটি ভাগের কথা বলেছেন। যথাঃ (১) গণতন্ত্র, (২) কতিপয়তন্ত্র ও (৩) রাজতন্ত্র। জন লক এদের মধ্যে গণতন্ত্রকে সর্বাপেক্ষা উত্তম বলে মনে করেন।
(৭) ক্ষমতার উৎসঃ হবসের সামাজিক চুক্তি অনুযায়ী জনগণ তাদের সকল ক্ষমতা রাজার হাতে অৰ্পণ করে তাদের আর কোনো অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। সুতরাং হবসের মতে, রাজাই সকল ক্ষমতার উৎস। অন্যদিকে লকের মতে জনগণই প্রকৃত সার্বভৌমিকতার উৎস ও আধার। কেননা জন লকের মতে, সামাজিক চুক্তির ফলে সার্বভৌম তার অধিকার হারিয়ে ফেলে না বরং তাদের অধিকার আরো দৃঢ় হয়।
(৮) শাসনব্যবস্থাঃ হবসের মতে, তার সার্বভৌম শাসক চরম শক্তিসম্পন্ন এক সত্তা। তার সার্বভৌমিকতা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার সার্বভৌমিকতাকে গৌরবের স্বর্ণশিখরে প্রতিষ্ঠিত করে জনগণের প্রভৃতে পরিণত করেন। অন্যদিকে জন লকের রাষ্ট্রে জনসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি রাজাকে গৌরবের আসন থেকে টেনে নামিয়ে জনগণের অধীন করেছেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হবস ও লকের রাষ্ট্রচিন্তার সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্য বেশি থাকলেও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তারা এক বিশিষ্ট আসন দখল করে আছেন। তাদের রাষ্ট্রদর্শন দ্বারা তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ঘটনাসমূহ প্রভাবিত হয়েছে। হবস নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতার কথা বলেছেন, আর জন লক জনসম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। তার পরও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
0 মন্তব্যসমূহ