প্রশ্নঃ হবসের মতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা কী? এ প্রসঙ্গে সার্বভৌমিকতার সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক বিষয়ে হবসের অভিমত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, টমাস হবসের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর। এ প্রসঙ্গে সার্বভৌমত্বের সাথে ব্যক্তি সম্বন্ধ বিষয়ে হবসের অভিমত আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম দার্শনিক ও ইউরোপের রাজনৈতিক দর্শনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলকারী টমাস হবস ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন ইংল্যান্ডের অরাজক অবস্থা দেখে হবস সার্বভৌম শাসকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই তিনি ‘লেভিয়াথান' নামক গ্রন্থে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জোরালো মন্তব্য পেশ করেন। আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাসে টমাস হবসের সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কিত মতবাদ এক উল্লেখযোগ্য মতবাদ। তিনি তার রাষ্ট্রদর্শনে সার্বভৌমিকতার সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেন।
হবসের মতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাঃ হবসের মতে, সার্বভৌয় ক্ষমতা হলো এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিমণ্ডলী যার কাছে জনগণ নিজেদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে তাদের যাবতীয় প্রাকৃতিক অধিকার সমর্পণ করে দিয়ে তার যাবতীয় কাজকে নিজেদের বলে স্বীকার করে নেয়। এ ব্যক্তি বা ব্যক্তিমণ্ডলীর লক্ষ্য হলো জনগণ কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতাক তার নিজস্ব বিবেচনা অনুযায়ী জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যে নিয়োজিত করা। হবসের সার্বভৌমত্বের ধারণা তার সামাজিক চুক্তির মতবাদ হতে গৃহীত হয়েছে। তার সময় মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে অসহনীয় ও কদর্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করত।
প্রাকৃতিক পরিবেশের এ অবস্থা হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। জনগণের মঙ্গলের জন্য এক শাসকের দ্বারা রাজ্য শাসনের এক নীতির প্রতি আগ্রহী হয় এবং সকলের সম্মিলিত অধিকার শাসকের হাতে অর্পণ করে। এভাবে পারস্পরিক সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রে সার্বভৌম সরকার গঠন করে। কাজেই এটি এক প্রকার একতরফা চুক্তি। ফলে রাজা আর জনগণের নিকট দায়ী রইলেন না, তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন। এর অব্যবহিত ফলস্বরূপ রাজা স্বৈরাচারী শাসক হয়ে উঠলেন। এভাবে হবস তার সার্বভৌমত্ব ধারণার মাধ্যমে তৎকালীন ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের স্বৈরাচারী শাসনের পক্ষে সমর্থন করেন।
হবস সার্বভৌম ক্ষমতাকে চরম ক্ষমতার আধার বলে মনে করেন। সার্বভৌম শাসকের ইচ্ছাকে অপর কোনো ঊর্ধ্বতন বা অধ্বস্তন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাষ্ট্রে সার্বভৌম শাসকের সমকক্ষ অন্য কোন কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। সার্বভৌম শাসকই সকল ক্ষমতার উৎস ও ব্যাখ্যা প্রদানকারী। তিনি যাবতীয় আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। হবস বলেন যে, কেউ সার্বভৌম শাসকের ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারে না, যেহেতু সমগ্র জনগণ স্বেচ্ছায় সার্বভৌম হস্তে তাদের সমস্ত ক্ষমতা বিনা শর্তে অর্পণ করেছে।
সার্বভৌমত্বের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক বিষয়ে হবসের অভিমতঃ টমাস হবসের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বে সার্বভৌমের সাথে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তারা একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হবস বলেছেন, মানুষ পরস্পরবিরোধী সহজাত প্রবণতা দ্বারা শাসিত। এগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো শান্তিপূর্ণ ও আরামপ্রদ জীবনযাপনের অভিপ্রায় এবং দ্বিতীয়টি হলো বেদনাময় ও যন্ত্রণাময় জীবনের ভয়াবহতা এড়িয়ে চলার ইচ্ছা। সুতরাং ব্যক্তি তার নিজের প্রয়োজনেই সার্বভৌম ক্ষমতার সৃষ্টি করেছে। সুতরাং সার্বভৌমের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নিম্নরূপ-
(১) শাসক ও শাসিতের সম্পর্কঃ সার্বভৌমত্ব তত্ত্বে সার্বভৌম হলো রাজা বা শাসক। তিনি জনগণের নিকট দায়ী নন। তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ তাদের সম্মিলিত অধিকার রাজার হাতে সমর্পণ করে। আর ব্যক্তি হলো প্রজা বা শাসিত। তারা সার্বভৌম শাসকের নিকট তাদের ক্ষমতা অর্পণ করে তাদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে।
(২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদে বিশ্বাসীঃ সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণের পর সার্বভৌম বা শাসক সকল ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রে সার্বভৌম শাসকের সমকক্ষ অন্য কোন কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। আর প্রজাদের সকল আনুগত্য শাসকের প্রতি প্রকাশ করতে হবে। এমন কি শাসক যদি গির্জাকে স্বীকৃতি না দেয় তাহলে জনগণ গির্জার প্রতিও আনুগত্য প্রকাশ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে জনগণের আনুগত্য এককেন্দ্রিক ও একমুখী হতে হবে।
(৩) সার্বভৌম জনগণের ক্ষতি করবে নাঃ সার্বভৌম জনগণের ক্ষতি করবে না। সার্বভৌমের প্রতি জনগণ ততদিন আনুগত্য প্রকাশ করবে যতদিন পর্যন্ত জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার এবং জীবনের অস্তিত্ব সংরক্ষণ করতে পারবে। হবসের মতে, সার্বভৌমিকতা কাউকে আত্মহত্যার নির্দেশ দিতে বা তার অস্তিত্ব সংরক্ষণের মৌল অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
(৪) সার্বভৌম শক্তি ব্যক্তির নিকট দায়ি ননঃ হবসের চুক্তির শর্তানুযায়ী সার্বভৌম শক্তি চুক্তির ঊর্ধ্বে। সার্বভৌম শাসকের ইচ্ছাকে জনগণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাষ্ট্রে সার্বভৌম শাসকের সমকক্ষ কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। এই চুক্তি অনুযায়ী, সার্বভৌম বা শাসক শাসিত বা ব্যক্তির নিকট হতে ক্ষমতা লাভ করলেও তিনি শাসিত বা ব্যক্তির নিকট দায়ি নন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হবসের সার্বভৌমিকতার ধারণা রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার সার্বভৌমিকতায় স্বৈরতন্ত্রকে স্বীকার করলেও জনস্বার্থকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ব্যক্তির প্রয়োজনের তাগিদেই ব্যক্তির স্বার্থেই সার্বভৌমিকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং হবস তার সার্বভৌম শক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ডের তৎকালীন বিরাজমান অবস্থা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ