ভূমিকাঃ ম্যাকিয়াভেলী ছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ধারক ও বাহক। তার প্রকৃত নাম নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী। আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা তার করস্পর্শে হয়ে ওঠেছে সমৃদ্ধ আর সৃজনশীল। ম্যাকিয়াভেলী ১৪৬৯ সালে ইতালীর ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো The Prince ও Discourse.উভয় গ্রন্থে তিনি আধুনিক যুগের রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিককে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।
ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে তার ধারণাঃ ধর্ম ও নৈতিকতা ম্যাকিয়াভেলীর ধারণা তার রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ দিক। তার রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে তার ধারণা। মেকিয়াভেলীই হলো প্রথম রাষ্ট্রদার্শনিক যিনি ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে পৃথক করেছেন। প্রাচীন যুগে নৈতিকতা ও মধ্যযুগে ধর্মকে আমরা রাষ্ট্র চিন্তার মূল নিয়ামক হিসেবে দেখতে পাই। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগে ধর্ম ও নৈতিকতা ছিলে একই সূত্রে গাঁথা। এদিক থেকে ম্যাকিয়াভেলীই হচ্ছেন প্রথম চিন্তাবিদ যিনি এ দুটো জিনিসকে অত্যন্ত নির্মমভাবে পৃথক করেছেন।
ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে এরূপ মনোভাবের কারণঃ নৈতিকতা সম্পর্কে তার ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এদুটি ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে এরূপ ধারণার কারণ ছিল নিম্নরূপ-
(১) রাজনীতির পৃথকীকরণঃ ধর্ম ও নৈতিকতাকে আলাদা করার কারণ হলো রাজনীতির পৃথকীকরণ। তিনি রাজনীতিকে ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের বহিগ্রাস থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন ও স্বনির্ভর বিজ্ঞানে পরিণত করতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি নামক ধারণা থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র করতে।
(২) ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠাঃ একজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানুষ ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সুশীল করা অসম্ভব। তিনি বলেন মানুষ যেহেতু স্বভাবত স্বার্থপরও প্রতারক, সুতরাং তাকে নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে অরণ্যে রোদন করারই শাসন।
(৩) তৎকালীন প্রেক্ষাপটঃ ইতালীর তৎকালীন প্রেক্ষাপট ম্যাকিয়াভেলীকে ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি মুক্ত করার প্রেরণা যুগিয়েছে। এখন ইতালীতে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আদৌ কোনো স্থান ছিল না। মূল্যবোধের রাজ্যে তখন বলেছিল এক চরম সংকট। একজন বাস্তব চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি তার এই ধারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কল্যাণের পক্ষে কাজ করার অনুপ্রেরণা পান।
(৪) রাষ্ট্রের উপযোগীঃ ম্যাকিয়াভেলীর ধারণা ছিল যে, ধর্ম ও নৈতিকতা ছিল রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী। তিনি মনে করেন যে, ধর্ম ও নৈতিকতা পথ অনুসরণ করে রাষ্ট্র যদি তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে তা হবে সর্বাপেক্ষা উত্তম। তার মতে, ধর্ম ও নৈতিকতা ছাড়া রাষ্ট্রের কল্যাণ আসতে পারে না।
(৫) ধর্মের পরিচয়ঃ ম্যাকিয়াভেলির মতে, ধর্ম হলো একটি মৌলবাদী হাতিয়ার যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠী আত্মিকভাবে বিকশি হয় এবং বস্তুবাদী কর্মকে নিশ্বেষ্ট করে তোলে। তার মতে, 'মানুষকে পার্থিব কাজে বিমুখ করে শোষণ করার হাতিয়ারের নাম হলো ধর্ম।
(৬) ধর্মের স্বতন্ত্র বিকাশঃ ম্যাকিয়াভেলি ধর্মকে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, ধর্মের বিকাশ হবে প্রায়োগিক, যৌক্তিক ও স্বতন্ত্রভাবে যাতে নিরপেক্ষভাবে সবাই এর সুষমা গ্রহণ করতে পারে। তবে এ স্বতন্ত্র বিকাশধারা কখনই রাষ্ট্রীয় কর্মের ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না।
(৭) ধর্ম পারলৌকিক বিষয়ঃ ম্যাকিয়াভেলি বলেন, রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। রাষ্ট্র হচ্ছে পার্থিব ব্যাপার আর ধর্ম হচ্ছে পারলৌকিক ব্যাপার। ধর্ম একটি স্বতন্ত্র বিষয় যা জনগণ পারলৌকিক কল্যাণের জন্য পরিচর্যা করবে। এ সম্বন্ধে তিনি আরো বলেন,ধর্ম হলো পারলৌকিক বিষয় যা পারকালীন মুক্তির জন্য মানুষ চর্চা করে থাকে।
(৮) নৈতিকতার পরিচয়ঃ ম্যাকিয়াভেলি নৈতিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, নৈতিকতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক আদর্শ ধারণা যা রাজ্য শাসনে রাজাকে উভয় সংকটে পতিত করে। এজন্য তিনি রাজাকে নৈতিকতার দ্বৈতরূপ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
(৯) দ্বৈত নৈতিকতার যৌক্তিকতাঃ দ্বৈত নৈতিকতার মাধ্যমে রাজা তার রাষ্ট্রীয় কল্যাণসাধন করতে পারবে। এতে কোনো ক্ষতি হবে না। রাজাকে যেকোনো উপায়ে রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন করার জন্যই ম্যাকিয়াভেলি দ্বৈত নৈতিকতাকে সমর্থন করেছেন। অবশ্য রাষ্ট্রের কল্যাণ অর্জিত হলে সকল শ্রেণীর মানুষ উপকৃত হবে।
(১০) শাসক ও শাসিতের নৈতিকতাঃ শাসকের মাপকাঠি ও শাসিতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হবে বলে ম্যাকিয়াভেলি অভিমত ব্যক্ত করেন। তার মতে, শাসক তার নিজস্ব নৈতিকার ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্র শাসন করবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা নীতিসম্মত, শাসকের ক্ষেত্রে তা নীতিসম্মত নাও হতে পারে।
সমালোচনাঃ ম্যাকিয়াভেলীর ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কিত ধারণার নেতিবাচক দিককে উপেক্ষা করা চলেনা। তার এই মতবাদ-বহুমুখী সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, যাহা নিম্নরূপঃ
(১) ঐক্য বিনষ্টঃ সমালোচকদের মতে, ম্যাকিয়াভেলী শাসককে রাষ্ট্রগঠনকারী রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্টকারী এবং নীতির উৎখাতকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, দূর্নীতির মূল্যচ্ছেদ করে রাষ্ট্রে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কিনা সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
(২) দূরদৃষ্টির অভাবঃ ম্যাকিয়াভেলীর অন্তর্দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর ছিল বটে কিন্তু তার দূরদৃষ্টির অভাব ছিল যথেষ্ট তিনি কেবল বর্তমান নিয়ে ভেবেছেন কিন্তু ভবিষ্যত সম্পর্কে মোটেই সচেতন ছিলেন না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনীতি, ধর্মও নৈতিকতা সম্পর্কে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে পৃথক করেন। ম্যাকিয়াভেলীর পূর্বে অপর কোন দার্শনিকের পক্ষে এটা সম্ভব হয়নি। ইতালীর তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই মতবাদ প্রবর্তন করেন।
0 মন্তব্যসমূহ