অথবা, টমাস হবসের প্রকৃতির রাজ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ টমাস হব্স ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দির অন্যতম দার্শনিক ও ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলকারী টমাস হবস ‘প্রকৃতির রাজ্য' নামক তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। ইংল্যান্ডের চরম দুর্দিনে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে অসীম ক্ষমতাশীল স্থায়ী সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই তিনি রাজশক্তির সমর্থনে তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'লেভিয়েথান' রচনা করেন।
টমাস হবসের প্রকৃতির রাজ্যের বৈশিষ্ট্যঃ মানব প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করেই হবস তার প্রকৃতির রাজ্যের চিত্র অঙ্ক করেছেন। নিম্নে এর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলোঃ
(১) রাজনৈতিক সংগঠনকে অস্বীকারঃ রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে হবসের মতে মানুষ যে অবস্থায় বাস করতো তাকে বলা হতো প্রকৃতির রাজ্য। মানব প্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখেই হবস তার প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রকৃতির রাজ্যে কোনো সমাজ ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না।
(২) লোভ ও স্বার্থের প্রাধান্যঃ হবস মনে করেন, নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবে মানুষ সেখানে অসভ্য ও বর্বর জীবনযাপন করত। জীবনের নিশ্চয়তা বা সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। প্রত্যেক মানুষই যেহেতু স্বার্থপর ও লোভী তাই প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থ ও লোভ চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত ছিল।
(৩) সংঘাতের সৃষ্টিঃ হবসের ধারণায় সকল মানুষই প্রায় সমান। কাজেই প্রকৃতির রাজ্যে কেউ নিজেকে অন্য কারো অপেক্ষা ছোট ভাবতো না। সবকিছুই সমানভাবে পাবার আকাঙ্ক্ষা প্রত্যেকের মনে জাগে। কিন্তু একই বস্তু দু'জনে একই সঙ্গে পাবার আকাঙ্ক্ষা করলে তাদের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়।
(৪) নিঃসঙ্গ জীবনঃ সংঘাতে যে জয়ী হয় সেও নিরাপদ হতে পারে না। একে অপরকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে। ফলে লাভ, নিরাপত্তা ও প্রাপ্তির আশায় উভয়ের মধ্যে অবিরাম গতিতে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে প্রকৃতির রাজ্যে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা ছিল সকলের সাথে সকলের, ফলে সেখানে মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, হতভাগ্য, কদর্য, নিষ্ঠুর ও সংক্ষিপ্ত।
(৫) যুক্তির অবহেলাঃ প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের শত্রু ছিল। তারা সর্বক্ষণ দ্বন্দ্ব কলহ, খুন খারাবি ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল। এ রকম ভয়াবহ যুদ্ধ অবস্থা সেখানে সব সবসময়ই বিরাজ করত। এরূপ ভয়ংকর অবস্থায় মানুষের বুদ্ধি বিবেকের চর্চা, যুক্তিকে কাজে লাগানোর অবকাশ যেখানে মোটেই ছিল না।
(৬) ন্যায়ের অনুপস্থিতিঃ তার মতে, ন্যায়-অন্যায় বোধ তখন মানুষের মধ্যে ঘটেনি। হবসের কথায় যেখানে সাধারণ ক্ষমতা নেই, সেখানে আইন নেই, সেখানে বিচারও নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধীন সভ্য সমাজেই একমাত্র ন্যায়-অন্যায় বোধ থাকতে পারে। হবস বর্ণিত প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ বন্য পশুদের মতো জীবনযাপন করত।
(৭) দায়িত্বহীনতাঃ টমাস হব্স মনে করেন যে, প্রকৃতির রাজ্যে দায়িত্বহীনতা বিরাজমান ছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষের মধ্যে কোনো দায়িত্ব জ্ঞান ছিল না। তখন মানুষের মনে কোনো চিন্তা-চেতনা ছিল না। তারা সর্বদা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকতে বেশি পছন্দ করতো। একে অপরের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতো না।
(৮) যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়াঃ প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ভয়াবহ অবস্থায় ছিল। এক সময় মানুষ এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য উপায় খুঁজতে শুরু করে। কারণ প্রকৃতির রাজ্যে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। এখানে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারেনি। কেন মানুষ শান্তির অন্বেষায় প্ররোচিত হয়েছিল এ সম্পর্কে হবস বলেন, মুক্তিবাদিতা প্রকৃতির রাজ্যে মানুষকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে প্ররোচিত করেছিল।
(৯) চুক্তি সম্পাদনঃ হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ নিঃস্ব, অসহায়, দূর্বল ও দূর্বিসহ জীবনযাপন করতো। প্রকৃতির রাজ্যের এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মানুষ নিজেরা নিজেদের মধ্যে সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করেছেন বলে হবস মনে করেন।
হবসের মতে প্রকৃতির রাজ্যঃ হবসের মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। প্রকৃতির রাজ্য ছিল ভয়াবহ ও দূর্বিষহ। সেখানে মানুষে মানুষে সর্বদা বিবাদ লেগেই থাকত। কেননা প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকত। জোর যার মুল্লুক তার- এই ছিল প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থা। সেখানে কোনো সরকার ছিল না বিধায় কোনো আইনও ছিল না। এরূপ অবস্থায় মানুষ সর্বদাই ভয়ভীতি ও মৃত্যুর ভয়ে দিনাতিপাত করতো। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ ছিল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও পরশ্রীকাতর। আর মানুষের জীবন ছিল সঙ্গীহীন, অসহায়, নোংরা, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী। হবস প্রকৃতির রাজ্যে মানুষে মানুষে বিবাদের তিনটি কারণের কথা বলেছেন। (১) অন্যের সবকিছু আত্মসাৎ করার প্রবণতা, (২) নিজের কোনোকিছু অন্যকে না দেয়ার প্রবণতা এবং (৩) সম্মান ও গৌরব অর্জনের প্রবণতা। এককথায় বলা যায় যে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল অসহনীয় ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ।
হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের উৎপত্তি ঘটছে তার মানবপ্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনার মাধ্যমে। তার সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বক্তব্য ছিল- রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত এবং প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হতো। প্রকৃতির রাজ্যে প্রকৃতির নিয়মের আওতাধীনে মানুষ প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করত। কিন্তু কালক্রমে প্রাকৃতিক আইনের কার্যকারিতা ও প্রাকৃতিক অধিকার উপভোগ করা অনিশ্চিত ও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতি হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় ও সুচিন্তিতভাবে পরস্পর চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে। এ চুক্তির দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক সংগঠনের হাতে মানুষ সমস্ত ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক অধিকার হস্তান্তর করে, তারা সামাজিক অধিকার ও নিরাপত্তা লাভ করে। হবসের দ্বিতীয় প্রাকৃতিক বিধানানুসারে, প্রাকৃতিক রাজ্যের সকল মানুষ তাদের যাবতীয় প্রাকৃতিক অধিকার তৃতীয় কোনো এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিমণ্ডলীর হাতে নিঃশেষে সমর্পণ করে দেয়। তার মতে, সমর্পণ কর্মটি সাধিত হয় নিম্নলিখিতভাবে সম্পাদিত সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে; আমি অমুক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংস্থাকে ক্ষমতা প্রদান করছি এবং আমার নিজেকে শাসন করার যাবতীয় ক্ষমতা তার নিকট সমর্পণ করছি এই শর্তে যে, তুমিও ঠিক অনুরূপ প্রণালীতে তোমার যাবতীয় কাজের জন্য তাকে ক্ষমতা প্রদান কর এবং তোমার নিজেকে শাসন করার অধিকার তার নিকট হস্তান্তর করো।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে হসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়ঃ (১) সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রাধান্য (২) শান্তি ও নিরাপত্তা চুক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ (৩) জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে চুক্তি সম্পাদন (৪) সামাজিক চুক্তি অপরিবর্তনীয় ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত (৬) চুক্তি সার্বভৌমত্বের ভিত্তি।
পরিশেষঃ অতএব, উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, প্রকৃতির রাজ্যের ভয়াবহ অবস্থা নিরসনের জন্য হবস চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে মহাশক্তিশালী শাসকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ