ম্যাকিয়াভেলিকে কেন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলা হয়েছে আলোচনা কর


প্রশ্নঃ ম্যাকিয়াভেলিকে কেন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলা হয়েছে আলোচনা কর।

অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনে ম্যাকিয়াভেলির অবদান আলোচনা কর। তাকে তুমি কোন অর্থে একজন আধুনিক চিন্তাবিদ হিসাবে মনে করবে?

ভূমিকাঃ আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ম্যাকিয়াভেলী ১৪৬৯ খৃষ্টাব্দে ইতালীর ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো 'The Prince' এবং 'Discourse.' ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক আন্দোলন রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের ফলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চার্চের এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সামন্ত প্রভুদের প্রাধান্য বিলুপ্ত করে জাতীয় রাষ্ট্র উদ্ভাবনের যে প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ম্যাকিয়াভেলীর রাষ্ট্রদর্শনে। তৎকালীন ইউরোপীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ধারাকে সমর্থন করে এর গতিকে ত্বরান্বিত ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলীর পদক্ষেপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলার কারণঃ ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় যার কারণে আমরা তাকে আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তাবিদ বলে গণ্য করতে পারি। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ 

(১) রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথকীকরণঃ ম্যাকিয়াভেলীই হচ্ছেন প্রথম চিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে মুক্ত করেন। রাষ্ট্রের ওপর অন্য কোন পার্থিব বা অতিপ্রাকৃত শক্তি যে থাকতে পারেন না তা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন এবং আধুনিক চিন্তার সূত্রপাত করেন। তার মতে, ধর্ম হচ্ছে আধ্যাত্মিক ব্যাপার। তিনি রাষ্ট্রকে ধর্মীয় পরিমন্ডল থেকে দূরে রেখে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। এ জন্য ম্যাকিয়াভেলী রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

(২) নৈতিকতার ঊর্ধ্বেঃ ম্যাকিয়াভেলীর রাষ্ট্র দর্শনের মনোভাব রাষ্ট্রনীতিকে নৈতিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে তার উপর স্থান দেবার ফলে- লক্ষ্যই যৌক্তিকতা বিধান করে, প্রয়োজন কোন আইন মানে না, প্ৰভৃতি মারাত্মক প্রতিক্রিয়াগুলির সূচনা হয়। ব্যক্তির জীবনে যা অন্যায়, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা অন্যায় নাও হতে পারে।

(৩) জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীঃ ম্যাকিয়াভেলীকে যেসব কারণে প্রথম আধুনিক চিন্তানায়ক বলে অভিহিত করা হয়, জাতীয়তাবাদের আদর্শ তার প্রধানতম কারণ। তিনি মনে করেন যে, ঐতিহ্য এবং আইন ব্যবস্থার অভিন্নতা একটি জনসমাজকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। ঘোড়শ শতাব্দীতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও সংস্কারে ম্যাকিয়াভেলীর ভূমিকা ছিল অন্যতম।

(৪) জাতীয় রাষ্ট্রের প্রবক্তাঃ প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রচিন্তা নগর রাষ্ট্রভিত্তিক, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা বিশ্বরাষ্ট্র বা বিশ্ব সমাজ কেন্দ্রিক কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ম্যাকিয়াভেলী জাতীয় রাষ্ট্রের জনক। শক্তিশালী শাসকের দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের কথা তিনিই প্রথম বলেন।

(৫) আধুনিক কূটনীতির জনকঃ ম্যাকিয়াভেলী আধুনিক কূটনীতির জনক। মানুষের কূটচরিত্রের স্পষ্ট বক্তা হিসেবে শাসককে রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত যে সমস্ত পরামর্শ দান করেছেন তা আধুনিক কালে রাষ্ট্র সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে দিক দর্শন হিসাবে ভূমিকা পালন করছে। তার মতবাদ কুখ্যাত এমন অপবাদ দিলেও জাতীয় এবং আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে তা এতটুকু ম্লান হয়নি।

(৬) আইন প্রণেতা হিসাবেঃ আইনের প্রয়োজনীয়তা এবং আইনের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে পৌর ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশসাধনের ব্যাপারে মত পোষণ করে প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন এবং আধুনিককালের নিয়মতন্ত্রবাদের শুভ সূচনা ঘটিয়েছিলেন।

(৭) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাঃ রাষ্ট্র নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা হচ্ছে ম্যাকিয়াভেলীর শ্রেষ্ঠ অবদান। সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী রাষ্ট্রকে কল্পনা করা হতো এক অতিপ্রাকৃত প্রতিষ্ঠানরূপে। শাসনকর্তা ছিলেন ঈশ্বরের নিকট দায়ী এবং আইন-কানুন ছিল ঐশীবাদী। ম্যাকিয়াভেলী ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্র হল একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান।

(৮) প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বঃ ম্যাকিয়াভেলী একদিকে রাজতন্ত্রের সমর্থন করেছেন, অপরদিকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণকারী জনগণের তথা প্রজাতন্ত্রের গুণগান করেছেন। প্রথমটির উদ্দেশ্য ছিল সুসংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সংস্কার সাধন করা এবং দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হলো প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

(৯) শাসনকার্যে জনগণের ভূমিকাঃ রাজতন্ত্রের সমর্থক হলেও ম্যাকিয়াভেলী বিশ্বাস করতেন, যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে তা অধিক স্থায়ী হয়। তিনি মনে করতেন, শাসন ব্যবস্থায় যতবেশী জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় দেশের জন্য তা তত বেশী মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর হয়।

(১০) রাজনীতির নতুন ধারাঃ ম্যাকিয়াভেলী আধুনিক যুগের প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি রাষ্ট্রচিন্তার জগতে বাস্তব অবদান রাখেন। তিনি রাজনীতিকে মধ্যযুগের ধর্মীয় বাহুপাশ এবং সনাতন বিধান থেকে মুক্ত করেন। তিনিই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সূচনা করেন। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সূর্য উদিত হয়।

(১১) সার্বভৌমত্বের ধারণাঃ ম্যাকিয়াভেলিই প্রথম আধুনিক সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি প্রথম স্পষ্টভাবে একচ্ছত্র শাসকের হাতে কর্তৃত্বের চরম ক্ষমতা ন্যস্ত করার মাধ্যমে এবং একে অন্য কিছুর অধীন না করে সার্বভৌমের আধুনিক ব্যাখ্যা দান করেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সার্বভৌমত্বের বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

(১২) নৈতিকতার আধুনিক ব্যাখ্যাঃ ম্যাকিয়াভেলি তার রাষ্ট্রদর্শনে নৈতিকতার আধুনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি এর দুটি মানদণ্ড নির্ধারণ করেন। একটি হলো সরকারি নৈতিকতা এবং অপরটি হলো ব্যক্তিগত নৈতিকতা। এদিক থেকে তাকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলে অভিহিত করা হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, আমরা ম্যাকিয়াভেলীকে একজন আধুনিক চিন্তাবিদ হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি। তিনিই প্রথম চিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানকে ধর্ম ও গীর্জার প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের মর্যাদা দান করেন। রাষ্ট্র, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, কূটনীতি, আইন প্রণয়ন ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি যে যুগোপযোগী মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তা পরবর্তীকালেও রাষ্ট্রচিন্তায় যথেষ্ট খোরাক যুগিয়েছে। এই জন্য তাকে একজন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলেও আখ্যায়িত করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক