রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবদান মূল্যায়ণ কর


প্রশ্নঃ রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবদান মূল্যায়ণ কর।

পূর্বকথাঃ জন লক ১৬৩২ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। জন লক সর্বকালের এবং সর্বযুগের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একজন। তার বাস্তবধর্মী চিন্তাধারা, গণতান্ত্রিক সচেতনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তাকে শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদগণের প্রথম সারিতে দাঁড় করিয়েছে। তিনি হলেন বৃটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের পুরোধা। মূলত তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসাবিদ। প্রকৃতপক্ষে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি ছিলেন নিরুৎসাহী। ধীরে ধীরে তিনি রাষ্ট্রদর্শনে পদার্পণ করেন। লকের রাজনৈতিক মতবাদ প্রধানত তার Two Treatises of Government রচনায় বিধৃত হয়। 

জন লকের অবদানঃ রাজনৈতিক চিন্তাজগতে লকের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার চিন্তাধারা আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনকে গুরুত্ববহ করে তুলেছে। তার অবদানকে নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।

(১) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তাঃ রাজনৈতিক দর্শনে জন লকের প্রথম অবদান হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের অন্যতম। ব্যক্তির অধিকার ও স্বার্থকে তিনি তার রাষ্ট্রদর্শনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ব্যক্তির স্বাধীনতা লঙ্ঘন ও উৎপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করাই ছিলো লকের রাজনৈতিক দর্শনের প্রধান উপজীব্য বিষয়।

(২) সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তাঃ জন লক হলেন বৃটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। তিনি সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্র অক্ষয় ও অমর কিন্তু সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আইন পরিষদ সম্পর্কে জন লক বলেন, 'It is not can possibly be, absolutely orbiter over the lives and fortunes of the people.'

(৩) প্রাকৃতিক অধিকারের প্রবক্তাঃ রাজনৈতিক চিন্তাজগতে লকের অন্যতম অবদান হচ্ছে প্রাকৃতিক অধিকার মতবাদ। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেন। এই চিন্তাধারা তার রাষ্ট্রদর্শনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

(৪) সম্পত্তি তত্ত্বের প্রবক্তাঃ জন লকের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হলো সম্পত্তি তত্ত্ব। তিনি সম্পত্তি তত্ত্বকে জনগণের একটি প্রাকৃতিক অধিকাররূপে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, সম্পত্তির অধিকার ব্যতীত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন।

(৫) সম্মতি তত্ত্বঃ সম্মতি তত্ত্ব তার রাষ্ট্রদর্শনের একটি বিশেষ দিক। তিনি বলেন, সরকার জনগণের সম্মতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। জনগণের এই অধিকারকে সরকার কখনও উপেক্ষা করতে পারেন না। সরকার জনগণের অছিরূপে শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমতা ধারণ করে।

(৬) সহনশীলতা তত্ত্বের প্রবক্তাঃ তিনি রাষ্ট্র দর্শনে সহনশীলতার আশ্রয় নিয়েছেন। ধর্ম ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে সহনশীলতার দার্শনিক তত্ত্বও জন লকের একটি বিশিষ্ট অবদান। তার মতে, ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো করণীয় নেই। চার্চ ও রাষ্ট্র দুটি পৃথক সত্তা। একটি অপরটির ক্ষেত্রে কোনো নীতি নির্ধারকের অধিকারী নয়।

(৭) গণসার্বভৌমত্বের প্রবক্তাঃ গণসার্বভৌমত্বের প্রবক্তা হিসেবে লকের রাষ্ট্রনৈতিক অবদান অপরিসীম। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তিনি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন। তার মতে, সরকার জনগণের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করেছেন। এই দায়িত্ব পালনে তিনি ব্যর্থ হলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে।

(৮) উদারনীতিঃ জন লক উদারনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। উদারনৈতিক ভাবধারা উন্মেষের ক্ষেত্রে লকের অবদান চিরস্মরণীয়। তার উদারনৈতিক দর্শনের মূল সূত্র ছিল 'জনগণই সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস এবং জনগণের অবাধ সম্মতি লাভ করতে না পারলে সরকার অবৈধ।'

(৯) দায়িত্বশীল শাসনের পুরোধাঃ দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠায় লকের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাণী উচ্চারণ করেন। তার মতে, সরকার তার কাজ-কর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়ী। সরকার দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে।

(১০) স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তাঃ জন লক হলেন স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম প্রবক্তা। তিনি এই নীতির মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে নিরাপদ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তার এই দর্শনের দ্বারা ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কু প্রভাবিত হন। এর ওপর ভিত্তি করে তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গঠন করেন।

(১১) আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও জন লকঃ আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উপর লকের রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব অপরিসীম বলে ব্যাখ্যাকারকরা অভিমত জানিয়েছেন। জন লকের Two Treaties on Civil Government আমেরিকান বিপ্লবের পাঠ্যবই হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল।

(১২) নিয়মতান্ত্রিক সরকারঃ জন লক নিয়মতান্ত্রিক সরকারের প্রবক্তা। তিনি স্বৈরতন্ত্র কিংবা নৈরাজ্যবাদ চাননি। তিনি জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।

(১৩) শ্রমতত্ত্বঃ জন লক সম্পত্তিতত্ত্ব বিশ্লেষণে শ্রমতত্ত্ব দান করেন। শ্রমতত্ত্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। জন লকের মতে, কোন জিনিসে যত বেশি শ্রম বিনিয়োগ করা হবে, সে জিনিসের মূল্য তত বৃদ্ধি পাবে। শ্রমের মাধ্যমে সংগৃহীত হবার পর কোনো দ্রব্য সম্পত্তিতে পরিণত হবে।

সমালোচনাঃ জন লকের রাষ্ট্রদর্শন একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। তার রাষ্ট্রদর্শনের ত্রুটিসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো- 

(১) আংশিক সার্বভৌমত্ববাদঃ সমালোচকগণ জন লকের রাষ্ট্রদর্শনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন। সার্বভৌমত্ব তত্ত্বে তিনি আইনগত সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি শুধু জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন।

(২) ভ্রান্ত মতবাদঃ জন লকের সম্পত্তি তত্ত্ব মতবাদটি একটি ভ্রান্ত মতবাদ। লকের মতে সমাজ গঠনের পূর্বেই সম্পত্তি বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ব্যতিত মানুষ সম্পত্তি ভোগ করত। তার এ ধারণা একটি ভ্রান্ত ধারণার সামিল।

(৩) অসঙ্গতিপূর্ণ সম্মতি তত্ত্বঃ সম্মতি তত্ত্বের ক্ষেত্রে জন লকের রাষ্ট্রদর্শনে ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। সমালোচকগণের মতে, রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পত্তির অধিকার ভোগ করবার নিশ্চয়তা লাভ করলেই সে তার মৌন সম্মতি প্রদান করে না।

পরিশেষঃ উপযুক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও জন লকের রাষ্ট্র দর্শন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির ফলে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তাধারায় তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে বৃটেনে গণতান্ত্রিক ধারণা তার চিন্তার ফসল। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় বলার অপেক্ষা রাখে না, 'John Locke was the forerunner of parliamentary democracy of England.'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক