উপস্থাপনাঃ উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই একটি বংশ বা জাতির ইতিহাস রচিত হয়। প্রবল দাপটের মধ্য দিয়ে এক সময় যে জাতি মাথা উচু করে দাড়াতে সক্ষম হয়, আবার কালপ্রবাহে সে জাতিই দ্রুতগতিতে পতনের দিকে ধাবিত হয়। এটা ইতিহাসের এক অমােঘ নিয়ম। সে ধারাবাহিকতায় ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবেক কর্তৃক ভারতবর্ষে যে সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে ইবরাহীম লােদীর পরাজয়ের মাধ্যমে তার যবনিকাপাত ঘটে।
দিল্লী সালতানাতের পতনের কারণঃ
অভ্যন্তরীণ কারণসমূহঃ দিল্লী সালতানাতের পতনে অভ্যন্তরীণ কারণগুলাে অত্যন্ত প্রকট ছিল, যার সমাধান এক কথায় সম্ভবই ছিল না। কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ-
১. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতাঃ সুলতানের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও যােগ্যতার ওপর সুশাসন এবং সালতানাতের অস্তিত্ব নির্ভর করত। যখন সুলতানগণ অযােগ্য, দুর্বল ও অদক্ষ হতেন তখন সাম্রাজ্যে অরাজকতা, বিদ্রোহ, বিশৃঙ্খলা ও বিপ্লবের সূত্রপাত হতাে। যা দমন করতে গিয়ে সাম্রাজ্যের প্রচুর অর্থ ও জনবল ক্ষয় হতাে। এতে সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে, যা পতনের ঘণ্টাধ্বনির অশনি সংকেত দেয়।
২. উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বঃ সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতির অভাবে সকল শাসকের মৃত্যুর পরই রাজপরিবারের একাধিক সদস্যকে সিংহাসনে আরােহণের উত্তরাধিকারী হিসেবে সমর্থন দিয়ে ষড়যন্ত্রকারী অমাত্যবর্গ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতেন। এটাই মূলত সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বের মূলে কাঠারাঘাত করে এবং পতন তরান্বিত করে তােলে।
৩. বিলাসিতা ও নৈতিক অধঃপতনঃ প্রথম দিকে কয়েকজন ব্যতীত পরবর্তী সুলতানদের নৈতিক অবনতি দিল্লী সালতানাতের পতনের কারণ ছিল। শাসকগণ শাসনকার্য পরিচালনা অপেক্ষা বিলাসব্যসন, আরাম-আয়েশ ও হেরেমে অনৈতিক আমােদ প্রমােদে বেশি নিমগ্ন থাকতেন। নৈতিক অধঃপতন এবং সে সঙ্গে বিভিন্ন দুর্নীতি সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
৪. ধর্মান্ধ মনােভাবঃ অধিকাংশ সুলতানই ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ধর্মান্ধ ও সংকীর্ণ মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন। ফলে সাম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমান প্রজাসাধারণ সর্বদাই দিল্লী সালতানাতের ধ্বংস কামনা করত।
৫. ক্রীতদাসের সংখ্যা বৃদ্ধিঃ ফিরােজ শাহের আমলে রাজ দরবারে ১৮০০০ ক্রীতদাস ছিল। তাদের ভরণপােষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হতাে। ফলে রাজকোষে ঘাটতির সৃষ্টি হয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে করুণ অবস্থা দেখা দেয়।
৬. স্বেচ্ছাচারিতাঃ সুলতান বলবনের দৌহিত্র কায়কোবাদের শাসনামলে উজির নিজামুদ্দীন কুশাসন, আলাউদ্দিন খিলজীর মৃত্যুর পর তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক কাফুরের নির্যাতন, স্বার্থপরতা, অসততা, খসরু খানের কুশাসন ইত্যাদির ফলে যে দলাদলি ও অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাই তিলে তিলে ক্রমাগতভাবে সাম্রাজ্যের শক্তি ক্ষয় করতে থাকে।
৭. জাতীয়তাবােধের অভাবঃ ঐতিহাসিক উইলস হেগ বলেন, জাতীয়তাবােধের অভাবে দিল্লী সালতানাতের শাসক ও শাসিতদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। ফলে দিল্লী সালতানাতের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
৮. অর্থনৈতিক অবনতিঃ শূন্য রাজকোষ ও দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সালতানাতের পতনের অন্যতম কারণ বলে জনৈক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন। অধিকন্তু সুলতানগণ ও তাদের পত্নীদের চরম বিলাসিতার ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এরূপ অর্থনৈতিক ভিত্তিহীন রাষ্ট্রের পতন অবশ্যম্ভাবী।
৯. কেন্দ্র বিমুখতাঃ কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগের প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কখনাে সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল না। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রদেশের সেনাবাহিনী ধানাগার প্রভৃতির সর্বময় কর্তা ছিলেন। ফলে সুযােগ পেলেই তারা স্বাধীনতা ঘােষণা করত। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কেন্দ্রবিন্দু প্রবণতা দিল্লী সালতানাতের পতনের অন্যতম কারণ ছিল।
১০. অনুন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থাঃ অনুন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থার যুগে সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সম্প্রসারিত বিশাল সাম্রাজ্যে শাসন ও সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা বাস্তবিকই দুষ্কর ছিল। ফলে দূরবর্তী প্রদেশসমূহ বিদ্রোহ ঘােষণা করলে তা দমন করা। সম্ভব হয়নি। ফলে সাম্রাজ্য পতনের দিক অগ্রসর হতে থাকে।
১১. হিন্দুদের বিরােধিতাঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের শত্রুতামূলক বিরােধিতাও দিল্লী সালতানাতের পতনের জন্য কম দায়ী ছিল না। মুসলিম শাসকরা ভারতীয় হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করলেও তারা মুসলিম শাসন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই সুযােগ পেলেই তারা সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত।
১২. মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ব্যর্থ পরিকল্পনাঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে সুলতানী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি চরম শিখরে উঠেছিল; কিন্তু শেষ দিকে তার কতগুলাে ব্যর্থ পরিকল্পনায় গােটা সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। ঐতিহাসিক শামসে সিরাজ আফিফের মতে- The treasury was at a very low ebb. যার ফলে সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে।
১৩. ফিরােজ শাহ তুঘলকের বিকেন্দ্রীকরণ নীতিঃ উইলস হেগের মতে, ফিরােজ শাহ তুঘলকের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি দিল্লী সালতানাতের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ, ফিরিশতা, রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং রায় চৌধুরীও এ ঐতিহ্যগত বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পােষণ করেন।
১৪. অভিজাত শ্রেণির অনৈতিকতাঃ অভিজাত শ্রেণি ছিল দিল্লী সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ, কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দী থেকে তাদের নৈতিক অবনতি ও বিলাস। ব্যসনের ফলে দিল্লী সালতানাতের শাসনব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৫. সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাঃ দিল্লীর সুলতানগণ সব সময়ই সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করতেন। ফলে সালতানাতের শেষ দিকে শাসকদের অদূরদর্শিতা, অবহেলা ও আর্থিক দৈন্যতার কারণে সামরিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লে সাম্রাজ্যে অরাজকতা দেখা দেয় এবং দিল্লী সালতানাতের পতন ত্বরান্বিত হয়ে পড়ে।
বাহ্যিক কারণসমূহঃ উপরিউক্ত অভ্যন্তরীণ কারণগুলাে ছাড়াও নিম্নোক্ত বাহ্যিক কারণগুলােও দিল্লী সালতানাতের পতনের জন্য দায়ী ছিল। যেমন-
১৬. মােঙ্গলদের আক্রমণঃ সুলতানী আমলের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মােঙ্গল বাহিনী একাধিকবার ভারতবর্ষে আক্রমণ পরিচালনা করে সুলতানদের সর্বদা ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। শক্তিশালী সুলতানগণও তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন।
১৭. তৈমুর লঙের আক্রমণঃ বিশ্ব বিজেতা তৈমুর লঙ ১৩৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে লুটতরাজ, ধ্বংসলীলা ও নৃশংস হত্যার করুণ ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তৈমুরের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযােগে অধিকাংশ প্রাদেশিক সরকার স্বাধীনতা ঘােষণা করে।
১৮. বাবরের আক্রমণঃ সুলতানী আমলের শেষের দিকে লােদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ইবরাহীম লােদীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলতখান লােদী ও মুলতানের পিতৃব্য আলমখান কাবুলের অধিপতি জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহীম লােদীকে পরাজিত ও নিহত করেন। ফলে ভারতবর্ষে তুর্কি, আফগানদের সুদীর্ঘ ৩২০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এবং সেখানে মােগল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহারঃ সার্বিক আলােচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ভারতে সুলতানী সাম্রাজ্য দীর্ঘ দু’শতাব্দীকাল ধরে ব্যাপক ঐতিহ্য এবং নব অধ্যায়ের সৃষ্টি করলেও পরিশেষে শাসকদের কোন্দল, দুর্বলতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে তারা নিজেদের অনিবার্য পতন ডেকে আনে। তাদের পতনের বেলাভূমিতে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ