আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি বিস্তারিতভাবে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি বিস্তারিতভাবে আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ আওরঙ্গজেব ছিলেন মুঘল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তার মৃত্যু পর্যন্ত মুঘল শক্তির যশ ও প্রতিপত্তি অটুট ছিল। অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু থাকার পরও ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত খাটি মুত্তাকী মুসলিম হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতিগুলাে আলােচনার পূর্বে এ নীতি প্রবর্তনের কারণ উল্লেখ প্রয়ােজন। তাই প্রথমে এ নীতি প্রবর্তনের কারণ ও পরে এগুলাে সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে।

আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি পর্যালােচনাঃ

ক. ধর্মনীতি প্রবর্তনের কারণঃ

১. ইসলামের একনিষ্ঠ সেবকঃ সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে যেসব অনৈসলামিক কাজ অবাধ গতিতে চলছিল তা নিষিদ্ধ করে আওরঙ্গজেব নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি শিয়া ও হিন্দুদের প্রতি দুর্বলতাবশত স্বীয় ধর্ম বিসর্জন দেয়াকে ঘৃণা করতেন।

২. পিতা কর্তৃক প্রভাবিতঃ আওরঙ্গজেব স্বীয় পিতা শাহজাহানের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সম্রাট শাহজাহান ছিলেন শরীয়তের বিধি-বিধান পালনে অধিক রক্ষণশীল। তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই আওরঙ্গজেব ধর্মনীতি প্রবর্তনে সক্রিয় হন।

৩. আকবরের নীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়াঃ সম্রাট আকবর স্বীয় মেধা ও বুদ্ধি বলে যেসব ধর্মনীতি প্রবর্তন করেছিলেন, তাতে অনেক ভ্রান্ত নীতি নিহিত ছিল। মূলত এসব ভ্রান্ত নীতি সংস্কারের জন্য আওরঙ্গজেব ইসলামের আলােকে ধর্মনীতি প্রবর্তনে প্রয়াসী হন।

৪. শিক্ষার প্রভাবঃ বাল্যকাল থেকেই আওরঙ্গজেব ইসলামী আদর্শে লালিত পালিত হয়েছেন। তাই তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন ও প্রতিফলনে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব শাসন ক্ষমতা সুদৃঢ় করে। এজন্য তিনি ধর্মনীতি প্রবর্তনে মনােনিবেশ করেন।

৫. ইসলাম প্রতিষ্ঠাঃ আওরঙ্গজেব ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান ও আইন-কানুন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি সমগ্র ভারতে কুরআন সুন্নাহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু করে মুঘল সাম্রাজ্যকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াসে ধর্মনীতি প্রবর্তন করেন।

৬. হিন্দু রাজপুতদের শত্রুতাঃ সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের শাসনামলে হিন্দু রাজপুতরা হিন্দু জাগরণ আন্দোলন পরিচালনা করে। এ আন্দোলন ছিল পরােক্ষভাবে ইসলামকে বিনাশ করার সচেতন প্রচেষ্টা। আওরঙ্গজেব তাদের ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র ও অসৎ উদ্দেশ্য খর্ব করার জন্য ধর্মনীতি প্রবর্তন করেন।

খ. ধর্মনীতিসমূহঃ

১. সেজদা প্রথা নিষিদ্ধকরণঃ মুঘল আমলে প্রজাসাধারণ রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে বাদশাকে সেজদা করত, যা ইসলামের রীতিনীতি বিরােধী কাজ। আওরঙ্গজেব এ শিরক প্রথা নিষিদ্ধ করে তদস্থলে ইসলামী শরীয়তের অনুপম অভিবাদন সালাম প্রদানের প্রথা প্রবর্তন করেন।

২. গানবাদ্য ও অশ্লীলতা বন্ধঃ আওরঙ্গজেব স্বীয় রাজদরবারে সকল প্রকার নৃত্যগীত, উৎসব অনুষ্ঠান ও যাবতীয় অশ্লীলতা নিষিদ্ধ করেন। তিনি মদ, জুয়া ও বেশ্যাবৃত্তি হারাম ঘােষণা করে এর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

৩. জ্যোতিষশাস্ত্র নিষিদ্ধকরণঃ আওরঙ্গজেব রাজদরবারে অনৈসলামিক জ্যোতিষশাস্ত্রবিদদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করে তাদের বিতাড়িত করেন। এমনকি তিনি সৌর মাসের পরিবর্তে চান্দ্র মাসের গণনা পুনঃ প্রবর্তন করেন।

৪. ইসলামী রীতিনীতি প্রবর্তনঃ আওরঙ্গজেব মুঘল রাজদরবারে স্বর্ণ ও মণিমুক্তা দ্বারা সম্রাটের দেহ ওজন প্রথা, হিন্দুদের দশহারা অনুষ্ঠানে সম্রাটের যােগদান, হিন্দু রাজাদের অনুসরণে কপালে তিলক ধারণ ইত্যাদি অনৈসলামিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে ইসলামী রীতিনীতি প্রবর্তন করেন।

৫. শিরক বিদয়াত নিষিদ্ধকরণঃ আওরঙ্গজেব প্রশাসন ও দেশ থেকে সব ধরনের শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কার দূর করে নওরােজ নামক অনুষ্ঠান ও মুসলমান পীর বুজুর্গদের কবরস্থানে বাতি দেয়া নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।

৬. দর্শন প্রথা নিষিদ্ধঃ প্রজারা সকাল বেলা ম্রাটের চেহারা দর্শনকে ইবাদত মনে করত। তারা যতক্ষণ রাজদর্শন না পেত ততক্ষণ পানাহার থেকে বিরত থাকত। সম্রাট আওরঙ্গজেব এ ভ্রান্ত প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

৭. অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতাঃ আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যে বিদ্যমান সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন। তবে তিনি রাষ্ট্রের প্রয়ােজনেই হিন্দু ধর্মনীতি নতুন করে সংস্কার করার প্রয়ােজন অনুভব করেন।

৮. হিন্দু ধর্ম সংস্কারঃ হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে পূজার নামে অনৈতিক ও অশ্লীল কার্যাবলি প্রচলিত ছিল, আওরঙ্গজেব এসব প্রথা নিষিদ্ধ করেন। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য তিনি হিন্দু সমাজে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা, হােলি খেলা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “কোনাে উদ্দেশ্য বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, কেবল ন্যায়ের খাতিরেই তিনি এসব কার্য সম্পাদন করেছিলেন।”

৯. জিযিয়া কর পুনঃ প্রবর্তনঃ সম্রাট আকবর ১৫৭৯ সালে হিন্দুদের ওপর থেকে জিযিয়া কর প্রত্যাহার করেছিলেন। পরবর্তীতে আওরঙ্গজেব ইসলামী রাজস্ব ব্যবস্থার অনুকরণে রাষ্ট্র কর্তৃক জানমালের নিরাপত্তা ও সামরিক দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতির বিনিময়ে অমুসলিম প্রজাদের ওপর জিযিয়া কর আরােপ করেন।

১০. শাহী দরবারে যাবতীয় অশ্লীলতা নিষিদ্ধঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব শাহী দরবারে নৃত্য উৎসব, ঘুষ, মদ, জুয়া, বেশ্যাবৃত্তি ও অশ্লীলতাসহ যাবতীয় ইসলাম বিরােধী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।

সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযােগঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি সম্পর্কে কতিপয় ঐতিহাসিক তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযােগ এনে ইতিহাস প্রণয়ন করেছেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাে হলাে-
১. তিনি রাজনীতির মধ্যে ধর্মকে জড়িত করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন।
২. তিনি সুপরিকল্পিতভাবে অমুসলিম ভূমিকে মুসলিম ভূমিতে পরিণত করেন।
৩. ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে তিনি হিন্দু ধর্মের বিশেষ ক্ষতি সাধন করেন।
৪. তিনি হিন্দুদের মন্দির ও টোল ধ্বংস করেন।
৫. তিনি হিন্দু কর্মচারীদের বরখাস্ত করেন।
৬. হিন্দুদের ওপর জিযিয়া কর পুনঃ প্রবর্তন করেন।

অভিযােগসমূহ ভিত্তিহীনঃ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অভিযােগসমূহ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ আওরঙ্গজেব তাঁর পূর্ববর্তী সম্রাটদের ন্যায় প্রজার সন্তুষ্টি বিধানের নিমিত্ত ইসলামী আদর্শ জলাঞ্জলি দেননি বলেই তার বিরুদ্ধে এসব অভিযােগ আনা হয়েছে, যা ঐতিহাসিকদের মন্তব্যেই প্রমাণিত। যেমন-

১. পরিব্রাজক হেমিলটন বলেন, “প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম এবং আল্লাহর উপাসনা করত। সুতরাং হিন্দু মুসলিম মিলনে আওরঙ্গজেব কুঠারাঘাত হানেননি।”

২. ‘মুন্তাখাবুল লুবাব’ গ্রন্থ রচয়িতার মতে, “একমাত্র সেসব হিন্দু মন্দিরই ধ্বংস করা হয়েছিল, যা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের ঘাঁটিরূপে বিবেচিত ছিল এবং যেসব মন্দির সরকারি অনুমতি ছাড়া নির্মিত হয়েছিল।

৩. এলফিন স্টোন বলেন, “আওরঙ্গজেবের আমলে কোনাে হিন্দুই ধর্মের জন্য নিপীড়িত হয়নি।”

ধর্মনীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াঃ আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির বিরুদ্ধে ইসলাম বিদ্বেষীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ধর্মনীতির প্রতিক্রিয়া স্বরূপই মারাঠা, রাজপুত, জাঠ, শিখ প্রভৃতি হিন্দু সম্প্রদায় আওরঙ্গজেবের শাসন কর্তৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেছিল।

উপসংহারঃ আওরঙ্গজেব মুঘল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। কাফি খানের মতে, “আওরঙ্গজেব ধর্মানুরাগী, কঠোর পবিত্র জীবনযাপন ও ন্যায়পরায়ণতায় বিশেষভাবে অনন্য ছিলেন। সাহস, কষ্টসহিষ্ণুতা এবং ন্যায়বিচারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক