হিউমের আত্মসত্তাবিষয়ক বা আত্মবিষয়ক মতবাদ সমালােচনাসহ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ হিউমের আত্মসত্তাবিষয়ক বা আত্মবিষয়ক মতবাদ সমালােচনাসহ আলােচনা কর।

অথবা, আত্মা সম্পর্কে হিউমের মতবাদ সমালােচনাসহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সত্তাদর্শন সম্পর্কে হিউম কী মতামত ব্যক্ত করেছেন? তার একটি সমালােচনামূলক ব্যাখ্যা দাও। .

ভূমিকাঃ পাশ্চাত্য দর্শনে মনকে আত্মার সাথে অভিন্ন করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পশ্চিমের দার্শনিকরা মন ও আত্মাকে সমার্থক বলে মনে করেন। মন বা আত্মাকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্ম-তত্ত্ব, ব্যবহারিক বা অভিজ্ঞতামূলক এবং ভাববাদী নামক তিনটি মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। চরম সন্দেহবাদী দার্শনিক হিউমের মতবাদ আলােচনা করা হলাে-

হিউমের আত্মসত্তাবিষয়ক মতবাদঃ ডেভিড হিউম একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। তিনি মনকে কোনরূপ আধ্যাত্মিক দ্রব্য বলে স্বীকার করেন না। কারণ তার মতে, অভিজ্ঞতাবহির্ভূত কোনাে কিছুর অস্তিত্ব নেই।

অভিজ্ঞতার সাহায্যে চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা ব্যতীত মনের কোনাে আধ্যত্মিক সত্তার কোনাে সন্ধান পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতার মধ্যে অপরিবর্তনীয় মন বা আত্মার কোনাে রূপ অস্তিত্ব নেই। সুতরাং হিউমের মতে, মন হচ্ছে অভিজ্ঞতালব্ধ মানসিক প্রক্রিয়াসমূহের সমষ্টি।

মন বা আত্মা মানসিক বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াসমূহের ঐক্য-বিধায়ক কোনাে সত্তা নয়। মানসিক প্রক্রিয়াসমূহ অনুষঙ্গ নিয়মের সাথে সম্পৃক্ত। অনুষঙ্গের নিয়মগুলাের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন করে। এই নিয়মগুলাে হচ্ছে – (১) সান্নিধ্য নিয়ম, (২) সাদৃশ্য নিয়ম ও (৩) পারম্পর্য নিয়ম।

পরস্পর নিকটবর্তী, সাদৃশ্য এবং অনুবর্তী প্রক্রিয়াগুলাে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে। এজন্য কোনাে স্থায়ী অপরিবর্তনশীল আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা কল্পনা বিশেষ।

হিউম বার্কলির অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর মতবাদে বিশ্বাসী। এ মতের ওপর ভিত্তি করে তিনি বলেন যে, চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা ব্যতীত এদের মূলীভূত সত্তা হিসেবে কোনাে ‘মন' বা 'আত্মা'র অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায় না। সুতরাং মন বা আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাসযােগ্য নয়। হিউমের মতে, কোনাে কোনাে দার্শনিক মন বা আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে যে মত পােষণ করেন, তা সম্পূর্ণভাবে কল্পনাপ্রসূত। কারণ তিনি মনে করেন, আমাদের আত্মার সংবেদনের দিকে তাকালে আমরা একমাত্র সংবেদনকেই দেখতে পাই। সংবেদন ছাড়া মন বা আত্মার কোনাে সন্ধান পাই না। সহজভাবে বলা যায়, আমাদের সংবেদনের বিষয়বস্তু কোনাে না কোনাে সংবেদন মন বা আত্মা নয়। হিউমের মতে, বিভিন্ন সংবেদনের মূলীভূত স্থায়ী সত্তা হিসেবে মন বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

ডেভিড হিউম একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। তার মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়, যা অভিজ্ঞতায় নেই তার অস্তিত্বও নেই। অভিজ্ঞতায় আমরা কোনাে অপরিবর্তিত আত্মার সাক্ষাৎ পাই না। অভিজ্ঞতায় আমরা যে আত্মার দেখা পাই তা হলাে, আমাদের মানসিক বৃত্তিগুলাের সমষ্টি। সংবেদন, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি নিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহ। এ মানসিক প্রক্রিয়াগুলাে পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াগুলাের মাঝে ঐক্য সৃষ্টির জন্য মন বলে কোন দ্রব্য নেই।

তিনি বলেন, মন বা আত্মা কোনাে আধ্যাত্মিক দ্রব্য নয়। মন হচ্ছে কেবল সংবেদনের সমষ্টি মাত্র। হিউম আমাদের মনকে একটা রঙ্গমঞ্চ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন, রঙ্গমঞ্চে যেমন একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে, তেমনি আমাদের অভিজ্ঞতাও একটার পর একটা হয়ে চলেছে। এই অভিজ্ঞতার সমষ্টি বা সংবেদনের সমষ্টিকেই তিনি মন বলে অভিহিত করেছেন। এ সম্পর্কে তার উক্তি হল, “কোনাে মানুষই বিভিন্ন সংবেদনের সমষ্টি বা সগ্রহ ছাড়া অতিরিক্ত কিছু নয়। এই সংবেদনগুলাে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে একের পর এক অনুগমন করে এবং এগুলাে নিয়ত পরিবর্তনশীল।”

সমালােচনাঃ হিউমের মতবাদটি ত্রুটিযুক্ত। নিম্নে ত্রুটিসমূহ উল্লেখ করা হলাে-

(১) হিউমের মত ত্রুটিপূর্ণঃ মন বা আত্মা অভিজ্ঞতাপূর্ণ সত্তা। এটি প্রত্যক্ষণের বিষয় নয়, কিন্তু অস্তিত্বশীল। মন অস্তিত্বশীল না হলে মনের ক্রিয়া বা অবস্থা অস্তিত্বশীল হতে পারে না।

(২) এ যুক্তি সত্য নয়ঃ হিউমের মতে চিন্তা, অনুভূতি এবং ইচ্ছের মাধ্যমেই আমরা মনের অস্তিত্ব লাভ করি। কিন্তু এই যুক্তিটি সত্য নয়। কারণ, মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়, বরং আত্মসচেতনতার মাধ্যমেই আমরা আত্মা বা মন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকি।

(৩) এ মত আত্মসচেতনতা ব্যাখ্যা দেয় নাঃ হিউমের মতবাদটি আত্মসচেতনতার ব্যাখ্যা দিতে অপারগ। ‘মন’ যদি মানসিক প্রক্রিয়ার সমষ্টি হয়, তবে মনের পক্ষে আত্মসচেতন হওয়া সম্ভব নয়। মনকে একটি আধ্যাত্মিক ঐক্য হিসেবে স্বীকার করলে মনের পক্ষে মানসিক প্রক্রিয়াদির ঐক্য বিধান করা সম্ভব।

(৪) হিউমের এ মত গ্রহণযােগ্য নয়ঃ ‘মন’ জ্ঞান প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের কাজ করে থাকে। মন যদি মানসিক প্রক্রিয়ার সমষ্টি হয় তবে মনের পক্ষে উক্ত কাজ করা সম্ভব নয়।

(৫) হিউমের মতবাদ বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেয় নাঃ হিউমের মতবাদটি স্থিতি, প্রত্যাশা ও প্রত্যাভিজ্ঞার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। ‘মন’ যদি অনুভুতি ও ধারণার সমষ্টি হতাে, তবে এটি পূর্বলব্ধ ধারণা ও অনুভুতিকে স্মরণ রাখতে পারত না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, মন এক সময়ে যা প্রত্যক্ষণ করে, অন্য সময়ে তা স্মরণ করতে পারে। সুতরাং ‘মন’ যখন সংবেদনকে ব্যাখ্যা করে কেবল তখনই জ্ঞান সম্ভব হয়।

(৬) অভিজ্ঞতা নিয়ে মনকে ব্যাখ্যা করা যায় নাঃ অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে পারে না। হিউমের মতবাদটি অভিজ্ঞতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অভিজ্ঞতাবাদ মনকে স্বীকার না করে, জ্ঞানের ব্যাখ্যা দানে সচেষ্ট। কিন্তু ‘মন' যখন সংবেদনকে ব্যাখ্যা করে কেবল তখনই জ্ঞান সম্ভব হয়।

(৭) হিউমের এ মত ব্যক্তিগত অভিন্নতা ব্যাখ্যা দিতে পারে নাঃ হিউম মনের প্রকৃতিগত ঐক্য স্বীকার করেননি। সুতরাং তার মতবাদ আমাদের ব্যক্তিগত অভিন্নতা ব্যাখ্যা করতে পারে না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হিউমের এ মতবাদকে সন্তোষজনক মতবাদ বলা চলে না। যদিও এ কথা সত্য যে, তার মতবাদ মন সম্পর্কে চিরাচরিত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। আসল কথা হলাে, তার মতবাদ একটা আত্মঘাতী নঞর্থক মতবাদ। মনস্তত্ত্বের ইতিহাসে এ মতবাদের তেমন কোনাে বিশেষ মূল্য নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক